বনপোড়া হরিণীর দেশে এমন দৃশ্য দেখতে টিকিট লাগে না
ট্রেনের জানালা দিয়ে নিসর্গের দৃশ্যাবলী দেখার সব স্মৃতি বুঝি মুছে গেল এ দফায়। দিগন্তজোড়া ফসলের খেত, ইতিউতি উঁকি দেওয়া জনপদ, বাজার, মানুষ, নদী-খাল, সেতু-কালভার্ট, বুড়ো বট কিংবা আলগোছে চলে যাওয়া মেঠোপথ—এমন মনোরম সব দৃশ্যের সবটাই যেন এক ঝটকায় চলে গেল সুদূর অতীতে।
এখন ট্রেনের জানালা মানেই যেন লেলিহান আগুন, এখন ট্রেনের জানালা মানেই যেন দুই হাত বাড়িয়ে দেওয়া অঙ্গার মানবশরীর। এখন ট্রেনের জানালা মানেই যেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
শুক্রবার রাতে বেনাপোল থেকে ছেড়ে আসা এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে যাত্রী ছিল দেড় শতাধিক। তাদের সবাই নিশ্চয় টিকিট কেটেই উঠেছিলেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে বিবেচিত এই বাহনে। কিন্তু ঢাকার গোপীবাগে এসে ট্রেনটিতে 'রাজনীতির আগুন' যে বীভৎসতা, আকুতি আর বিলাপের অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা করল, তা দেখতে দর্শকদের কোনো টিকিট কাটতে হয়নি।
বস্তুত প্রতিবার জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে সহিংসতা ও নাশকতার পালা চলে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে, তা দেখতে এখানকার আমজনতার কোনো টিকিটের প্রয়োজন হয় না।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পার করে ফেলেছে ৫২টি বছর। কিন্তু এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সেই একই দৃশ্যের চিত্রায়ন, সেই একই সহিংসতার পুনরাবৃত্তি দেখছে দেশ। যেন সেই একই রক্ত, গুলি, আগুন আর পোড়া গন্ধের ফিরে আসা। দোষারোপের রাজনীতিতেও চলছে সেই একই চাপান-উতোরের গল্প। বরাবরের মতো এসবের মাঝেই পড়ে থাকছে খরচ হয়ে যাওয়া কিছু 'সস্তা' জীবনের কথকতা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গতকালের আগুন মোট চারজনের জীবন কেড়ে নিয়েছে। গুরুতর আহত আরও আট যাত্রীর অবস্থাও খুব ভালো নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সে হিসেবে যখন তখন খরচের খাতায় নাম উঠে যেতে পারে তাদের।
এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দেওয়া আগুনে মা-ছেলেসহ চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ১৩ই ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের মধ্যে গাজীপুরের ভাওয়ালে রেল লাইন কেটে ফেলায় একই ট্রেনের সাতটি বগি উল্টে পড়ে। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয় আরও একজনের।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর আজ শনিবার দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানিয়েছে, সারা দেশে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ট্রেনসহ সাতটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে নয়টি স্থাপনায়। এর মধ্যে সাতটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চবিদ্যালয়।
একই সময়ে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, বরগুনা, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণার ১৬টি ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে
২৯৯ আসনে প্রায় ১৯০০ প্রার্থী এবার ভোটের প্রচারে তৎপর ছিলেন। বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে সমাঝোতা আর জোটের হিসাব নিকাশের মধ্যে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লড়াই হবে প্রায় দেড়শ আসনে। এর মধ্যে শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের দলীয় পদধারী।
নিজেদের শক্তি আর জনপ্রিয়তা দেখাতে গিয়ে এরই মধ্যে পঁচিশটির মতো আসনে প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারে বাধা দেওয়া, মারধর, হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতার তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের বাইরে এই নির্বাচনে থাকা অন্য দলগুলোর প্রচার এবার খুব একটা চোখে পড়েনি। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৮ দিনে দেশে নির্বাচনী সংঘাতে মোট তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় এ পর্যন্ত আড়াইশর বেশি শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী অপরাধের জন্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দলীয় সরকারের অধীনে 'প্রশ্নবিদ্ধ' নির্বাচনে কেবল ভোটের দিনেই নির্বাচনী সহিংসতায় ১৮ জন নিহত হন। ভোটের আগে-পরে সবমিলিয়ে নিহত হন অন্তত ২২ জন।
আর এই সরকারের অধীনে সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে একজন মাত্র বৈধ প্রার্থী থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। বাকি ১৪৭টি আসনে ভোট করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।
ওই দফায় বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের মধ্যে ভোট হয় ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বহু ভোটকেন্দ্র, প্রাণ হারায় ২০ জনের বেশি মানুষ।'
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিলেন শহীদ নূর হোসেন। তাকে নিয়ে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়/ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ/বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে,'।
এ ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে আরও ৩৬ বছর। তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে' এখনো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেননি আমাদের রাজনীতিকরা।
গতকাল রাতে গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ও প্রাণহানির ঘটনায় বিহ্বল দেশবাসীর ঘোর এখনো কাটছে না। ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা বগি আর জানালা দিয়ে বের হয়ে থাকা এক ব্যক্তির আধখানা জ্বলন্ত শরীর।
২০১৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী কবিতায় লিখেছিলেন, 'এইখানে দেশলাই ছাড়া আর কোনো আগুন ছিল না!/অথচ এই ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার আগ্রাসন থামাতে বড়সড় আগুনের দরকার ছিল।/এইখানে পুলিশের অকারণগাড়ি আর টহলদারি ছিল না;/রাস্তার মোড়ে র্যাবের মতো ক্রসফায়ার খাড়া ছিল না।/শুধু এক অপরূপ কুয়াশায় থিক থিক করা রূপকথামাঠ ছিল!'
গতকালের পর কবিতার সেই রূপকথামাঠের মতোই যেন হারিয়ে গেল ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা সিনেমার মতো সবকিছু। এখন সেখানেও আগুন।
Comments