দেশকে আর কখনো পরাজিত শক্তির হাতে তুলে দেব না: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অগ্নিসংযোগকারী ও রেললাইনের ফিসপ্লেট উপড়ে ফেলার সঙ্গে জড়িতদের একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসর হিসেবে বর্ণনা করে দেশকে তাদের হাতে তুলে না দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, 'যারা অগ্নিসংযোগ করছে এবং রেললাইনের ফিসপ্লেট তুলে ফেলছে তারা পরাজিত শক্তির (একাত্তরের) দোসর। আমরা কখনোই পরাজিত শক্তির হাতে দেশকে তুলে দেব না।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, যারা এ দেশে জ্বালাও-পোড়াও অগ্নিসংযোগ করে, রেল লাইনের ফিসপ্লেট তুলে ফেলে এরা পরাজিত শক্তির দালাল, পরাজিত শক্তির দোসর। কাজেই এদের না বলুন। এদের বাংলাদেশের রাজনীতি করারই কোনো অধিকার নেই। খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গি, দুর্নীতিবাজ এদের বাংলাদেশে কোনো স্থান নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার, ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছে। তারা সেই ভোটের অধিকার প্রয়োগ করবে। তারা শান্তিতে বাস করবে। উন্নত জীবন পাবে সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, 'আমরা এই দেশকে আর কখনো এই পরাজিত শক্তির হাতে তুলে দেব না।'
'বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে, শহীদদের কাছে এটাই আমাদের অঙ্গীকার,' যোগ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও নুরুল আলম রুহুল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ফয়জুর রহমান আহমেদের ছেলে ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা 'শেখ মুজিব আমার পিতা' গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করেন।
আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এবং সহপ্রচার সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মানুষ সেবা পায়। এখন মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিটি মৌলিক অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি। আজকে বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। আর এই সম্মানটা দিতে পারে না আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন ওই হানাদার বাহিনীর দোসর যারা ছিল, এরাই তাদের প্রেতাত্মা হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। আর মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আমার একটা আবেদন থাকবে প্রত্যেকটি এলাকায় যেখানে রেললাইন আছে যানবাহন চলাচল করছে, সেখানে যখন কোনো ঘটনা ঘটবে সঙ্গে সঙ্গে জনগণ যদি মাঠে নামে এরা হালে পানি পাবে না। কাজেই আমি জনগণের কাছে আহ্বান জানাবো, সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এরা কেবল ধ্বংস করতে জানে, এরা কোনো কিছু সৃষ্টি করতে জানে না। এরা কেবল মানুষ খুন করতে পারে, মানুষের জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারে না। এরা মানুষের সর্বনাশ করতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবনটাকে উন্নত করতে পারে না। আর কোথাও এ ধরনের রেলের ফিসপ্লেট তুলে ফেলা বা রেললাইন তুলে ফেলা, আগুন দেওয়া, যখনই যে করতে যাবে সরাসরি তাদের ধরতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলে চড়ে মানুষ যাবে সেখানে রেললাইন তুলে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করবে, তারা আবার কথা বলে কোন মুখে?
'হত্যাকারীরা কখনো গণতন্ত্র দিতে পারে না। এটা দেশের মানুষকে বুঝতে হবে,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আজকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, আমরা আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। আর শহীদের রক্ত কোনোদিন বৃথা যায় না। আজকের বাংলাদেশ এই ১৫ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি এবং সেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াও এবং প্রাণহানির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা মানুষ মারার রাজনীতি করে, মানুষ মারার পরিকল্পনা করে, তারা দেশের মানুষকে কোন গণতন্ত্র দেবে।
তিনি বলেন, বিএনপি মানুষ মারার রাজনীতি করে বলেই জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন।
বিএনপি ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি বলেছিলাম গ্যাস পাবে না। আল্লাহতায়ালাও যখন সম্পদ দেয়, মানুষ বুঝে দেয়। সেই গ্যাস দিতে পারেনি। কূপ খনন করে দেখে গ্যাস নাই।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে কর্নেল রশিদ ও হুদাকে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসাল। পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতার আসন দিল। ফারুককেও চেষ্টা করেছিল নওগাঁ থেকে জিতিয়ে আনতে, পারেনি। খালেদা ঘোষণা দিলেন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বেশিদিন বসতে পারেননি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন, ৩০ মার্চ জনগণের তোপের মুখে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নাকে খত দিয়ে পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছিল। খালেদা জিয়াকে ভোট চুরির অপরাধে বিদায় নিতে হয়েছিল। একবার নয়, দুইবার বিদায় নিতে হয়েছিল।
লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, খালেদা জিয়াকে এখন অনুসরণ করে যাচ্ছে তার ছেলে। যেমন জিয়াউর রহমান, তেমন খালেদা জিয়া আর ছেলেও একটা অমানুষ।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, মানি লন্ডারিং মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আর রাজনীতি করবে না বলে ২০০৭ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, এখন বিদেশে বসে হুকুম দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'সে (তারেক) এখন দূরে বসে হুকুম দেয় আর মানুষ পোড়ায়, গাড়ি পোড়ায়। আর অ্যাক্সিডেন্ট করে মানুষ মারার পরিকল্পনা করে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তারা এখন মানুষ মারার পরিকল্পনা করে।'
বামপন্থীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কিছু অতি বামপন্থী আছেন, তারা এখন ওদের সাথে নেমে পড়েছে। কী রকম আদর্শের বিকৃতি। তারা জামায়াত-শিবির খুনিদের সাথে হাত মিলিয়েছে।
তিনি বলেন, যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিরা মনে করেছিল বোঝা, এটা চলে গেলেই ভালো, আজকে তারাই বলে, আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। আমরা বাংলাদেশের মতো উন্নত হতে চাই। আর যারা বলেছিল 'বটমলেস বাস্কেট' তারা দেখেছে যে, বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যায় না, যেটা জাতির পিতা বলেছিলেন। আজকে তাদের চক্রান্ত শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটা নির্বাচনের আগেই চক্রান্ত হয়। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এ দেশের মানুষের শক্তিই বড় শক্তি। আর সেই শক্তি আমাদের সঙ্গে আছে বলেই পরপর আমরা তিনবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছি। মাত্র ১৫ বছর একটানা সময় পেলাম। ২০০৯ সাল থেকে আজকে ২০২৩, আজকের বাংলাদেশ, বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার যে যুদ্ধ, এটা গেরিলাযুদ্ধ, জনযুদ্ধ ছিল। নারীরাও বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী আমাদের নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখত, অমানুষিক-পাশবিক নির্যাতন করত। আবার অনেককে দিয়ে রান্নাবান্নাসহ নানা কাজ করাত। এমনও ঘটনা আছে এসব নারীরা যখনই যা খবর পেতেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতেন।
তিনি বাংলার মুক্তিসংগ্রামের এমনই এক বীর নারীর ঘটনা তুলে ধরেন, যিনি পিরোজপুরে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর ক্যাম্পে রান্নার কাজ করতেন। আর যখনই যা তথ্য পেতেন তা লিখে চুলের খোপার মধ্যে রেখে দিতেন। তিনি নদী সাঁতরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে সে তথ্য পৌঁছে দিতেন। মওলানা সাঈদী (প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী) তখন লঞ্চ ঘাটে তসবিহ বিক্রি করত এবং সে ওই মেয়েটাকে ধরিয়ে দেয়। এরপর তার ওপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে। এমনকি দুটি গাড়ির সঙ্গে তাকে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে দেহ ছিন্নভিন্ন করে তাকে নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী ৭৫ এর বিয়োগান্তক অধ্যায়ের পর গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রাখা, জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্রের নামে দেশে কারফিউ গণতন্ত্র দেওয়া, নির্বাচনের নামে প্রহসন, ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করে জাতির পিতার খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা এবং তাদের মন্ত্রী বানিয়ে শহীদের রক্ত রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে এবং সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে তাদের ভোট ও রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র এবং সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম-খুনের রাজনীতিই ছিল জিয়ার রাজনীতি, বলেন তিনি।
পরবর্তীতে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ায় তার প্রচেষ্টার উল্লেখও করেন জাতির পিতার কন্যা।
Comments