জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের কার্যকর বাস্তবায়নে টিআইবির ১৬ দফা সুপারিশ
শক্তিশালী আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপ ও সক্ষমতা, সমন্বয়হীনতা এবং সদিচ্ছার অভাবে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ বৃহস্পতিবার টিআইবির ধানমন্ডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে 'জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদের দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি' শীর্ষক পর্যালোচনা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রভাব, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সদিচ্ছা ও দক্ষতার ঘাটতি, বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক ও নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের অভিযোগ এবং একটি কার্যকর জবাবদিহিমূলক-কাঠামোর ঘাটতির কারণে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার পূরণ করতে পারেনি। পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন নীতিমালা ও কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধক সংস্থাসমূহ, সরকারি খাত, সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি, স্বার্থের সংঘাত ও সম্পত্তি-সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ, রাজনৈতিক অর্থায়ন, রিপোর্টিং প্রক্রিয়া ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা, সরকারি ক্রয় ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, তথ্যে অভিগম্যতা ও সমাজের অংশগ্রহণ, বিচার বিভাগ ও প্রসিকিউশন সেবা, অর্থপাচার প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা, পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অপরাধের দ্বারা অর্জিত সম্পদ পুনরুদ্ধার ও নিস্পত্তিকরণ অনুচ্ছেদসমূহের আইনত বাস্তবায়ন মোটামুটি পর্যায়ে হলেও, এর প্রতিটির প্রায়োগিক বাস্তবায়ন নিম্ন পর্যায়ের।
এতে উল্লেখ করা হয়, একইসঙ্গে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) কর্তৃক সক্রিয়ভাবে ই-জিপি পরিচালনার ফলে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি হয়েছে, তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে সরকারি ক্রয়ে এখনো সমস্যা রয়েছে, ক্রয়ে একচেটিয়া করণের প্রবণতা রয়েছে। আবার তথ্য কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য ও কার্যকরতা প্রত্যাশিত পর্যায়ের না। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের আইনি ও কাঠামোগতভাবে সুসংগঠিত হলেও অর্থপাচারের কার্যকর প্রতিরোধে ও পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বিরল। অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ও পারস্পারিক সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'অর্থপাচার প্রতিরোধে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক-কাঠামো থাকলেও অর্থপাচার বন্ধে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায় না। যারা অর্থ প্রচারকারী তাদের সিংহভাগই প্রভাবশালী বলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অর্থপাচারের মতো অপরাধ একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও, দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে এই সহযোগিতা ব্যবহারের মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না।'
দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধীন সরকারি কর্মকর্তাকে প্রয়োজনে গ্রেপ্তারের পূর্বে সরকারের পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতার সমালোচনা করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এমন ঘটনা দুদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল। অন্যদিকে, রাজনৈতিক অর্থায়ন নিয়েও স্বচ্ছতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনী খরচের সর্বোচ্চসীমা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু আইনি-কাঠামোতে নির্বাচনী প্রচারণায় পাবলিক ফান্ডিং বা জনসাধারণের অর্থায়নের কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত নেই। এটি শুধু নির্বাচনী ফলাফলের ওপর নয়, পুরো রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থের জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।'
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, 'দুর্নীতির কারণে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অস্বস্তি ও সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে, কারণ এর প্রভাব জনগণের মধ্যে গভীরভাবে রয়েছে। জনগণের এ ব্যাপারে মতপ্রকাশ ও কথা বলার অধিকার রয়েছে।'
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের কার্যকর বাস্তবায়নে ১৬ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো- দুদকের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং একে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত রাখা, দুদকের এখতিয়ার ও এর কার্য-পরিধি খর্ব করে আইনের এমন ধারাসমূহ এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ বাতিল করা, ২০১২ সালের সংস্করণে যে সকল অর্থপাচার-সংক্রান্ত অপরাধ দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত করা হয়েছে, সেগুলোকে পুনরায় দুদকের হাতে পুনর্বহাল করা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের এখতিয়ার স্বাধীন সত্তার (যেমন - সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) ওপর ন্যস্ত করা, সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ-সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ নিশ্চিতকরণে সম্পদের বাৎসরিক বিবরণ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি ও প্রয়োগ করা, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে গণতাস্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জাতীয় পর্যায়ে ও খাতভিত্তিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা, সরকারি খাতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা, অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের পেশাগত দক্ষতা ও কার্যকরতা বৃদ্ধি করা, পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে মিউচ্যুয়াল লিগাল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এসময় টিআইবির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম এবং প্রতিবেদন প্রণয়নকারী গবেষক ফাতেমা আফরোজ উপস্থিত ছিলেন।
Comments