সড়ক যেন ময়লার ভাগাড়
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম পুরনো শহর দিনাজপুর। এই শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাটের অবস্থা এখন বেহাল। নেই তেমন ড্রেইনেজ ব্যবস্থা। শহরের যেখানে সেখানে জমে আছে আবর্জনার স্তূপ। তার উপর যানজটের ভোগান্তি। অবহেলিত এই শহরে ৩ লাখের বেশি মানুষের বসবাস।
গত রোববার, দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ রাস্তায় নেমেছিলেন শহরের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে আবর্জনা অপসারণে। এর আগেও, এমন দৃশ্য দেখেছে দিনাজপুর শহরবাসী।
দিনাজপুর পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। পদাধিকার বলে এর প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. প্যাটারসন। তখন দিনাজপুরের জনসংখ্যা ছিল ১০-১২ হাজার।
১৮৯৮ সালে ঔপনিবেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে পৌরসভার সাধারণ নির্বাচন হয়। করদাতাদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দিনাজপুরের তৎকালীন মহারাজা গিরিজা নাথ রায় পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বর্তমানে ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে দিনাজপুর একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা যার আয়তন ২৪ দশমিক ৫০ বর্গ কিলোমিটার। পৌরসভার অধীনে রাস্তার আছে প্রায় ১৭৪ কিলোমিটার। এসব রাস্তার অধিকাংশই খালখন্দে ভরা।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দিনাজপুরে রাস্তাঘাটের তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। বেশির ভার রাস্তার বিটুমিন উঠে গিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত।
এম ইকবালুর রহিম দিনাজপুর সদর (দিনাজপুর-৩) আসনে গত ৩ নির্বাচনে টানা জয়লাভ করেছেন। অন্যদিকে, পর পর ৩ বারই বিএনপি নেতা সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও দলীয় কোন্দলের কারণে প্রতিটি নির্বাচনে পরাজিত হন। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে দিনাজপুর পৌরসভার সবধরনের উন্নয়ন। ১৫ বছর ধরে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন শহরবাসী।
বিষয়টি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও বিব্রত।
গত মে মাসে, দিনাজপুরের প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময় সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান প্রশ্ন তুলে বলেন, উন্নয়ন তো সব জায়গাতেই কমবেশি হয়েছে, দিনাজপুর শহরের কেন এই অবস্থা।
দিনাজপুর শহরের সড়ক ও জনপথ বিভাগের একমাত্র রাস্তাটি ছাড়া পাড়ামহল্লার প্রায় সবকটি রাস্তার বেহাল দশা। গত মাসে শুধুমাত্র শহরের মালদহপট্টি এলাকায় ৩০০ মিটার রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে।
দিনাজপুর শহরের মডার্ন মোড় থেকে ঘাসিপাড়া-বালুয়াডাঙ্গা-পাটুয়াপাড়া-ক্ষেত্রীপাড়া-রামনগর-গোলাপবাগ, মিশনরোড, থানামোড় হয়ে বড়বন্দর-ছোটগুড়গোলা-বড়গুড়গোলা-রাজাবাটী-মহারাজা স্কুলমোড়, সুইহারী মোড় থেকে কালুরমোড় হয়ে রাজবাটী-ফকিরপাড়া রাস্তা গত ১৫ বছরে সংস্কার হয়নি। মহল্লার অলিগলির রাস্তার অবস্থাও করুণ।
দিনাজপুর শহরের ৩ বছর ধরে অটোরিকশা চালাচ্ছেন রবিউল ইসলাম। খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তার অটোরিকশার কোনো না কোনো যন্ত্রাংশের সমস্যা হয়। চলাচলে সময়ও লাগে বেশি।
আক্ষেপ করে এক সরকারি কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কোনো কিছুতেই চড়ে শান্তি নেই। খালি ঝাঁকুনি আর ঝাঁকুনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'এটা কারো না কারো ব্যর্থতা আর দিনাজপুরবাসীর দুর্ভাগ্য।'
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি রেজা হুমায়ুন কবির চৌধুরী শামিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক সময়ের শান্তির শহর দিনাজপুর এখন বসবাসের অযোগ্য। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি।'
ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটি গত সোমবার দিনাজপুর পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে একটি করে ভ্যান দিয়েছে যাতে অন্তত শহরের রাস্তা থেকে আবর্জনা সরানো যায়।
দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নওশাদ হোসেনের অভিযোগ, বর্তমান মেয়রের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে দিনাজপুরবাসী নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না। আর মেয়রের ভাষ্য, তিনি বিএনপিপন্থী হওয়ায় পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দ পান না।
অভিযোগ আছে, দিনাজপুর সদরের সংসদ সদস্য এম ইকবালুর রহিম ও মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে দিনাজপুর শহরের করুণ দশা।
দ্বন্দ্বের কথা না বললেও, শহরের বেহাল অবস্থা নিয়ে এম ইকবালুর রহিমেরও অভিযোগ আছে। তার অভিযোগ, দিনাজপুর পৌরসভার উন্নয়নের জন্য টাকা ছাড় করিয়ে আনার পর কাজ না করায় সেই টাকা ফেরত গেছে। মেয়রের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো দ্বন্দ্ব নেই; যদি থাকে তা শহরের উন্নয়ন নিয়ে। মেয়র দিনাজপুর শহরের ব্যাপারে আন্তরিক নন। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তিনি কোনো কাজ করছেন না।
এমপি হিসেবে তার এটি দেখার দায় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা দেখার জন্য একটি মন্ত্রণালয় আছে। জেলা প্রশাসককে কেন শহরের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। এটা দিনাজপুরবাসীর দুর্ভাগ্য।
তবে, সম্প্রতি শহরের রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।
গত মঙ্গলবার প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড হতে ফরিদপুর গোরস্থান হয়ে স্টাফ কোয়ার্টার মোড় হতে খেরপটটি হয়ে আরবান হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত এবং পুলহাট বড়পুল হতে ফরিদপুর কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তার পুনর্নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন তিনি।
তবে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
প্রশ্ন করা হলে জাহাঙ্গীর আলাম স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নানান কারণে তিনি কাজ করতে পারছেন না। তবে, সম্প্রতি কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।
মশার উপদ্রব
দিনাজপুর প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও এখানে মশা নিধনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শহর পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পৌরসভার। কিন্তু শহরের যেখানে সেখানে ময়লার স্তূপ নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর নিজেই পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করি।
তিনি স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাকে বিষয়টি দেখার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান ডেইলি স্টারকে।
Comments