১৫ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শান্তি ভূবন দাস

শান্তি ভূবন দাস
শান্তি ভূবন দাস | ছবি: সুজিত কুমার দাস/স্টার

রাজবাড়ী শহরের দক্ষিণ ভবানীপুরের মাস্টারপাড়া এলাকায় যারা বসবাস করেন অথবা খুব সকালে এই এলাকায় হাঁটতে যান তাদের সবার কাছে অতি পরিচিত মুখ শান্তি ভূবন দাস।

এই সুপরিচিতির পেছনে রয়েছে তার ১৫ বছরের স্বেচ্ছাশ্রম। চাকরি জীবনের শেষ ভাগে শান্তি ভূবন দাস সিদ্ধান্ত নেন মানুষের জন্য কিছু করবেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নেওয়ার পরে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে শুরু করেন রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া। প্রতিদিন তিনি প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা ঝাড়ু দেন।

পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ইছাপুরা গ্রামে হলেও থিতু হয়েছেন দক্ষিণ ভবানীপুরের মাস্টারপাড়ায়। স্ত্রী নমিতা দাস গৃহিনী। বড় ছেলে কামনাশীষ দাস তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক আর ছোট ছেলে দেবাশীষ দাস অটো মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার।

শান্তি ভূবন দাস

শান্তি ভূবন দাসের বয়স এখন ৭৩ বছর। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কার্যসহকারী হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম কর্মস্থল ছিল ফরিদপুর। এরপর ১৯৮১-৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজবাড়ীতে কর্মরত ছিলেন। ২ বছর খুলনায় দায়িত্ব পালন করেন, এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেন।

ভবানীপুরে তিনি কুশল ড্রিংকিং ওয়াটার নামে পানি বিপণন (জারের ভরে পানি বিক্রি) প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।

সম্প্রতি রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষা রত্না কমিউনিটি সেন্টারের দক্ষিণ পাশ দিয়ে মাস্টারপাড়ায় চলে যাওয়া সরু পথ এক ভদ্রলোককে পরিষ্কার করতে দেখা যায়।

শান্তি ভূবন দাস

স্থানীয় বাসিন্দা অনেকেই সকালে হাঁটতে বেরিয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। 'দাদা কেমন আছেন'—জানতে চাইলে তিনি সহাস্য জবাব দিচ্ছেন।

আলাপ হলে শান্তি ভূবন দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আগে থেকে আমার বাড়ির উঠান পরিষ্কার করতাম, বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার রাখতাম। ২০০৭ সাল থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা পরিষ্কার করতে শুরু করি। এক পর্যায়ে পরিকল্পনা করি, অবসরে গেলে পুরো রাস্তা পরিষ্কার করব। আমি আমার পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছি। অবসর নেওয়ার দিন থেকে পুরো রাস্তা পরিষ্কার করা শুরু করেছি।'

'আমি প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠি। এরপর বেড়িয়ে পড়ি। রত্না কমিউনিটি সেন্টার থেকে ঝাড়ু দিতে শুরু করি, ওই রাস্তার শেষ বাড়ি শ্যামল মণ্ডলের। সে পর্যন্ত পরিষ্কার করে প্রয়াত সাংবাদিক হিমাংশু সাহার বাড়ি থেকে ভক্ত স্যারের বাড়ি পর্যন্ত ঝাড়ু দেই। এরপর উত্তম কুমার সরকারের বাড়ি থেকে বুদ্ধুদের বাড়ির গলি পর্যন্ত আবর্জনা কয়েকটি স্থানে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলি। কেবল ঝাড়ু দিলে পরিষ্কার থাকে না, আর কিছু দিন পর পর রাস্তার পাশের আগাছা পরিষ্কার করি। সকাল ৭টার দিকে বাড়ি ফিরি,' বলেন শান্তি ভূবন।

বাকি দিনের কার্যাবলী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সকালে বাড়ি ফিরে গোসল করে পূজা-অর্চনা করি। তারপর নাস্তা করে সকাল ১০টার দিকে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাই। ২টায় ফিরে দুপুরের খাবার খাই। এরপর পত্রিকা পড়ি, টেলিভিশন দেখি কিন্তু কখনোই দুপুরে ঘুমাই না। বিকেলে আবারো আমার প্রতিষ্ঠানে যাই, সন্ধ্যায় বাড়িতে আসি। রাত ৯টার দিকে বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি।'

শান্তি ভূবন দাস বলেন, 'আমি সাধারণত অসুস্থ কম হই। কারণ আমি সকালের নির্মল বাতাস পাই। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ায় আমার ভালো ব্যায়ামও হয়ে যায়।'

স্বামীর এই স্বেচ্ছাশ্রমে নমিতা দাস নিজেও আনন্দিত। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। একে তো ভোরে উঠে বের হতো, আবার অনেকে নানা ধরনের কটূক্তি করতো। তিনি কারো কথায় কান না দিয়ে শীত-গ্রীষ্ম নেই—কাজ করে গেছেন। এখন আর কেউ কটু কথা বলে না।'

'বরং এক দিন ঝাড়ু না দিলে সবাই ভাবে তিনি অসুস্থ। বাড়িতে খোঁজ নিতে আসে। সবাই এখন প্রশংসা করে। টুকটাক সহযোগিতাও করে। সব মিলিয়ে বিষয়টি আমারো খুব ভালো লাগে,' বলছিলেন নমিতা দাস।

তিনি আরও জানান, রাস্তার স্ল্যাব ভেঙে গেলে শান্তি ভূবন দাস সংস্কার করিয়ে দেন। এ পর্যন্ত তিনি ১১টি স্ল্যাব সংস্কার করে দিয়েছেন। তার কাজে উৎসাহিত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা আরও ৩টি স্ল্যাব সংস্কার করেছেন।

এমনকি বাড়ির কাঁথা, সোয়েটার দিয়েও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি, জানান নমিতা।

শান্তি ভূবন দাস

মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা শ্যামল কুমার পোদ্দার জানান, 'আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি কিন্তু শান্তি ভূবন দাসের মতো এমন মানুষ দেখিনি। তিনি নিরলসভাবে দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজটি করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনি রাস্তা পরিষ্কার করছেন।'

শান্তি ভূবনের প্রশংসাগাঁথা শোনা যায় তার প্রতিবেশী বারুগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কণা রানী দাসের মুখেও। তিনি বলেন, 'আমরা তাকে মামা বলে ডাকি। তিনি কাজকে ছোট মনে করেন না। তিনি রাস্তা পরিষ্কার করেন, প্রতিবেশীদের বাড়ির প্রাচীরে জমে থাকা আগাছা পরিষ্কার করেন। যেসব বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকে তাদের বাড়ির উঠানও তিনি পরিষ্কার করে দেন। পরিচ্ছন্ন থাকার কারণে হয়তো আমাদের পাড়ায় করোনার প্রকোপ কম ছিল।'

'শুরুতে ভাবতাম পৌরসভার লোকজন রাস্তা পরিষ্কার করেছে। কারণ, আমরা ঘুম থেকে উঠেই পরিচ্ছন্ন রাস্তা পেতাম। একদিন সকালে দেখি শান্তি কাকু ঝাড়ু দিচ্ছেন। এরপর আরও কয়েক দিন দেখি। এরপর আলাপ করে জানতে পারি, নিজে থেকেই তিনি ঝাড়ু দেন,' বলছিলেন শান্তি ভূবনের সহকর্মীর ছেলে হাফিজ আল আসাদ।

শান্তি ভূবনের ভাষ্য, 'মানুষ হিসেবে এই সমাজের জন্য আমাদের সবার উচিত কিছু করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে যদি মানুষের জন্য কিছু না করি তবে মানব জীবন ব্যর্থ।'

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজবাড়ীর পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শেখর চক্রবর্তী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি আমি জানি। তিনি নিজের উদ্যোগে রাস্তা পরিষ্কার করেন। অনেক দিন ধরেই তিনি এই কাজ করে চলেছেন। এ জন্য পুরো পৌরবাসীর উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো, ধন্যবাদ দেওয়া।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

5h ago