যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বাসদের ‘টালবাহানায়’ ক্ষুদ্ধ ৩১ নারী অধিকারকর্মী

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) একাংশের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিষ্পত্তির প্রশ্নে দলটির 'টালবাহানায়' ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ৩১ নারী অধিকারকর্মী।

আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। একইসঙ্গে আরও অভিযোগ করা হয়েছে যে, পূর্বে উত্থাপিত এ ধরনের অভিযোগ দলের নেতৃস্থানীয়রা আমলে না নিয়ে, নানাভাবে অস্বীকার করে ধামাচাপা দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা বিস্ময় ও ক্ষোভের সাথে লক্ষ করছি যে বাসদ অভিযোগ নিষ্পত্তির কোনো গণতান্ত্রিক এবং সম্মানজনক পথ অবলম্বন না করে বরং কালক্ষেপণ এবং অভিযোগকারীদের কালিমালেপনের চিরায়ত পিতৃতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করছেন। একটি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের এই আচরণ আমাদের স্তম্ভিত করেছে।'

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'বাংলাদেশে যৌন হয়রানিবিরোধী আন্দোলনের অংশীজন হিসেবে আমরা জানি যে এই ধরনের অভিযোগ উত্থাপন কোনো নারীর জন্য সহজ না। ভুক্তভোগী নারীরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা হওয়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে জনপরিসরে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছেন এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে একাধিক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, বাসদের প্রাক্তন কর্মীগণ ভুক্তভোগীদের এই দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। একইসঙ্গে তারা যৌন নিপীড়ন ও শোষণমূলক লিঙ্গীয় সম্পর্কের চর্চাকে সংগঠন থেকে সমূলে উৎপাটনের জন্য একটি যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল এবং নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে। আমরা তাদের দাবির সাথে সম্মতি ও সংহতি প্রকাশ করছি।'

যে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার সঙ্গে যৌন হয়রানির  মতো অভিযোগ আমলে নেওয়ার কথা ছিল বাসদ তা করেনি মন্তব্য করে বিবৃতিদাতারা বলেন, 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে তারা যেভাবে প্রথমে অস্বীকার করে এবং পরে অভিযোগটিকে দলের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়, বাসদও একইভাবে অভিযোগ নিষ্পত্তি না করে যিনি হুইসেলব্লোয়ার তার বিরুদ্ধেই সাংগঠনিক কাজে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে। বাসদ এবং তার অঙ্গসংগঠনের কাছে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ছাত্রলীগের যৌন নিপীড়ন প্রতিবাদযোগ্য। কিন্তু নিজ দলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে সর্বোতভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের নেতাদের "অযৌন", "ত্যাগী" ও  "আদর্শবাদী" ভাবধারার কথা তুলে। এটি আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। 

'বাসদের একাধিক কর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুক্তভোগী এবং তাদের পাশে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের প্রতি যৌনবাদী মন্তব্য  ছুঁড়ে দিয়েছেন। যেমন- অভিযোগকারী নারীরা অভিযুক্তকে প্রলুব্ধ (যৌন ইঙ্গিতময় আচরণ করেছে) করার চেষ্টা করেছে, অভিযোগকারী সমাজের নিয়ম মেনে চলা নারী নয় (নর্তকী, পার্টি অফিসে সিগারেট খায়) ইত্যাদি। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া ভিক্টিম ব্লেইমিয়ের ন্যাক্কারজনক উদাহরণ এবং বাসদের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির লজ্জাজনক বহিঃপ্রকাশ। আমরা এ ধরনের আচরণ ও বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই।'

বাসদের অনেকে তাদের নিজ দলে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের দাবিকে সমাজতান্ত্রিক দলের জন্য অপ্রয়োজনীয়  উল্লেখ করেছেন জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, 'তারা বলেছেন এ ধরনের নীতিমালা কেবল বুর্জোয়া  প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। দলের কিছু কর্মীর দাবি, দলের অভ্যন্তরে এ ধরনের অভিযোগ অতীতে নিষ্পত্তি হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, অভিযোগ যদি সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে তাহলে দলের প্রাক্তন নারী কর্মীরা কেন সাংগঠনিক চর্চায় লিঙ্গীয় নিপীড়ন ও যৌন দাসত্বের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন?  আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই,  স্থান-কাল-পাত্রভেদে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা বদলায় না। হোক পরিবার বা বিপ্লবী সংগঠন কিংবা ক্যাম্পাস— ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন সকল ক্ষেত্রেই অবাঞ্ছনীয়, অন্যায় এবং গুরুতর অপরাধ। বাসদের নেতা-কর্মীদের এ ধরণের বক্তব্য তাদের স্থূল পুরুষালী চিন্তা এবং লিঙ্গীয় ও যৌন রাজনীতি নিয়ে তাদের অমীমাংসিত রাজনৈতিক অবস্থানের স্মারক।'

বিবৃতিতে নারী অধিকারকর্মীরা জানতে চান, 'সাম্প্রতিক সময়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলো নিরসনে কালক্ষেপণ ও অভিযোগকারী সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা ছাড়া বাসদ সাংগঠনিকভাবে আর কি উদ্যোগ নিয়েছে?  যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালাকে বুর্জোয়া বলে খারিজ করে দিয়ে এ ধরনের অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য কি বিকল্প বিপ্লবী পন্থা বাসদ অবলম্বন করছে?'

বিবৃতিদাতাদের ভাষ্য, 'আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, লিঙ্গীয় সমতার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে, যৌন সহিংসতার ঘটনাকে কভারআপ করার মধ্যে দিয়ে বাসদ আদর্শচ্যুত হয়েছে এবং জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক বৈধতা  হারিয়েছে।'

এমন পরিস্থিতিতে বাসদের প্রতি এই বিবৃতিদাতারা আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'অভিযুক্ত নেতাদের সাংগঠনিক পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে  সুষ্ঠু তদন্তের পথ  তৈরি করুন। এছাড়া এই রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণের আর কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই।'

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা ও আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী রাণী য়েন য়েন, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাজনীন শিফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শরমিন্দ নীলোর্মি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজলী শেহরীন ইসলাম, থাইল্যান্ডের মাহিডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধিকারকর্মী রোজীনা বেগম, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক মনিরা শরমিন, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. নাসরিন খন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যকর্মী ডা. সাদিয়া চৌধুরী, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. নাসরিন সিরাজ, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক-লেখক ড. মাহা মির্জা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক শিল্পী বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু ও মার্জিয়া রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. নাফিসা তানজীম নিপুণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আইনুন নাহার ও ফাহিমা আল ফারাবি, অ্যাক্টিভিস্ট মারজিয়া প্রভা, কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তানিয়াহ্ মাহমুদা তিন্নি, শিক্ষক ও নোয়াখালী নারী অধিকারের সভানেত্রী লায়লা পারভীন, আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত লেখক-গবেষক সায়েমা খাতুন, যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সাদাফ নূর, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন, অধিকারকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, সাংবাদিক ও গবেষক ড. সায়দিয়া গুলরুখ এবং লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ।

Comments

The Daily Star  | English
US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

The endgame of the Ukraine war remains uncertain with US policy likely to be influenced by the outcome of the US election.

3h ago