রাঙ্গামাটিতে লিগ্যাল এইড সেবায় আস্থা বাড়ছে অসহায়-দরিদ্র মানুষের
রাঙ্গামাটির কাউখালীর ভূমিহীন ভ্যানচালক আসাদ আলী। জমানো টাকা দিয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু, কষ্টের টাকায় কেনা সেই জমি নিজের করে নিতে পারেননি।
প্রতারণার শিকার হয়ে আসাদ আলীর কেনা জমি হয়ে যায় বেদখল। শুধু তাই নয় জমির জন্য দেওয়া টাকাও আত্মসাৎ হয়ে যায়। পরে বিচারের আশায় অভিযোগ নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর পর আসাদ আলী তার কেনা জমির ১০ শতক ফিরে পেয়েছেন। আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। কিন্তু, এই বিচার পেতে তাকে কোনো খরচ করতে হয়নি। আর তা সম্ভব হয়েছে রাঙ্গামাটি জেলার লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে।
নানান সংকটের মধ্যেও স্বল্প সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি, সফল মীমাংসা ও আদালতে বিচারাধীন মামলা আপসে প্রত্যাহারসহ নানা সেবা দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলার লিগ্যাল এইড অফিস এখন আস্থার জায়গা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পুরো জেলার মানুষের কাছে।
ফলে, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের লিগ্যাল এইড সেবায় আস্থা বাড়ছে এবং আদালতে মামলাজট কমে আসছে।
বিচার বিভাগ আদালতে বিচারাধীন মামলার জট কমাতে ও সাধারণ মানুষের কাছে আইনি সেবা পৌঁছে দিতে দেশের ৬৪টি জেলায় লিগ্যাল এইড কার্যক্রম চালু করে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অধীনে জেলা পর্যায়ে বিচারপ্রার্থীদের সেবা দিচ্ছে এসব জেলা লিগ্যাল এইড অফিস।
রাঙ্গামাটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস চালু হয়। কিন্তু, বিচারক সংকটে উল্লেখজনক হারে আবেদন গ্রহণ ও মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। শুরুতে একপ্রকার ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এর কার্যক্রম চলছিল। ২০১৯ সালে এখানে শেখ মোহাম্মদ বদিউল আলম যোগ দেন। এরপর ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বিচারক হিসেবে সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে যোগ দেন।
রাঙ্গামাটি লিগ্যাল এইড অফিসের অন্যতম উদ্যোগ হলো বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক। এটি সারা দেশের মধ্যে প্রথম রাঙ্গামাটিতেই শুরু হয়েছে। এরপর বেশ কয়েকটি জেলায়ও এ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ অঞ্চল হওয়ায় এ কার্যক্রমের আওতায় ১৫০টির অধিক বিরোধপূর্ণ জমিতে গিয়ে মীমাংসা বৈঠক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে লিগ্যাল এইড অফিস সূত্র।
কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ মাসে রাঙ্গামাটি কার্যালয়ে ১ হাজার ২০৫টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। বিরোধ আপসের ফলে ১ কোটি ২২ লাখ ৪ হাজার ৯৪ টাকা টাকা আদায় এবং ৪২০টি দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক মামলা মীমাংসা হয়েছে। মামলার মীমাংসা হার ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এছাড়া আইনি পরামর্শ নিয়েছেন ১ হাজার ১৭৫। এর বাইরে আদালতে বিচারাধীন ১০১টি মামলা আপসে প্রত্যাহার হয়েছে।
মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে সংস্থাটির উদ্যোগে জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে ১০টি ও ২৮টি ইউনিয়নে লিগ্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতাদের সেখানে সম্পৃক্ত করে মানুষকে সেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এমন কী জেলার কারাবন্দীদের সঙ্গে আইনি সহায়তা নিয়ে বৈঠক শুরু হয়েছে।
রাঙ্গামাটি আদালত সূত্রে জানা গেছে, জেলার আদালতে যত মামলা আসে তার মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মামলাই লংগদু উপজেলার মানুষের। আবার এই উপজেলার মামলা নিষ্পত্তির হারেও এগিয়ে।
অসহায় মানুষের আইনি সহায়তা নিয়ে জানতে চাইলে লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ মো. জুনাইদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত মানুষকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি। কেউ মামলায় অভিযুক্ত হলে এবং আর্থিক সংকটে মামলা চালানোর সক্ষমতা না থাকলে সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা করে লিগ্যাল এইড। এছাড়া আপসে বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনগত পরামর্শ দেই আমরা। যেকোনো ব্যক্তি জেলা লিগ্যাল অফিস থেকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ পেতে পারেন।'
তিনি আরও বলেন, 'লিগ্যাল এইড অফিসে জমি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ যেমন—দেনমোহর ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত এবং আপসযোগ্য ফৌজদারি মামলা বাদী ও বিবাদীর মধ্যে আমরা মীমাংসা করি।'
'আমাদের যাতায়াতের যানবাহন নেই। পাশাপাশি জনবল সংকট আছে। তারপরও আমরা সশরীরে গিয়ে কথা বলে ও দেখে বিরোধ নিষ্পত্তি করছি। এতে সাধারণ মানুষও খুশি। সার্ভেয়ারসহ যদি জনবল ও পরিবহন সংকট নিরসন হয় সেক্ষেত্রে আমরা বেশি সেবা দিতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।'
Comments