দার্জিলিংয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: ‘ভাটির মানুষের ক্ষতির অভিসন্ধি কি না দেখতে হবে’

তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, তিস্তা নদী, পশ্চিমবঙ্গ, জলপাইগুড়ি, আইনুন নিশাত,
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্ট। সংগৃহীত ফাইল ছবি

দার্জিলিং পাহাড়ে ৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'পরিকল্পিত ৩টি প্রকল্পের মধ্যে ২টি তিস্তার শাখা নদীতে হওয়ায় বাংলাদেশে পানির প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে; বিশেষত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে।'

তিস্তার শাখা নদী বড় রঙ্গিতের ওপর পরিকল্পিত তিস্তা লো ড্যাম প্রকল্প (টিএলডিপি) ১ ও ২ থেকে সম্মিলিতভাবে ৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে ভারত। এছাড়া, বালাসন ও রংভাং নদীর ওপর বালাসন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্ট থেকে ৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশদ প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) তৈরির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, এই ৩টি ছাড়াও ১০টি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডিপিআর তৈরির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে ভারত।

পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে 'রান অব দ্য রিভার' প্রকল্প বলা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহৃত পানি আবার নদীতে ফেরত দেওয়া।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ- এর ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের সঙ্গে।

আইনুন নিশাত ও ম ইনামুল হক। ছবি: সংগৃহীত

ম. ইনামুল হকের অভিমত, আগেও ভারতের এ ধরনের অনেক প্রকল্পকে রান অব দ্য রিভার বলা হয়েছে। কিন্তু কারিগরিভাবে তা হয় না। তাই ভারতের নতুন এ প্রকল্প দূরভিসন্ধিমূলক কি না সেটাও যৌথ পরিদর্শন করে দেখা দরকার।

আর আইনুন নিশাত মনে করেন, ভারতের উচিত প্রকল্পের পুরো তথ্য বাংলাদেশকে জানানো।

ম. ইনামুল হক বলেন, 'মমতা বন্দোপাধ্যায় বলছেন যে, "তিস্তায় জল নেই"। তারপর তিনি বললেন, "সিকিম জল আটকে রেখেছে"। পানি তো আর এমনি আটকানো যায় না, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামেই পানি আটকে রাখা যায়। সিকিম বলছে, তাদের জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ড্যামগুলোর সবই রান অব দ্য রিভার। অর্থাৎ তারা নদীর পানি নদীতে ছেড়ে দেবে। এটা তখনই সম্ভব যখন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয় বা বরফ গলা পানি যখন আসে তখন সেটা জমা করে ছেড়ে দেওয়া যায়।

'যখন ভাটিতে নিম্নতম প্রবাহের উপরে পানি থাকে; জমা পানি ছেড়ে দেওয়া তখনই তা অর্থবহ হয়। অর্থাৎ এজন্য নদীতে নিম্নতম প্রবাহ থাকতে হবে। তিস্তায় যে পরিমাণ পানি ছিল, ওই পরিমাণ প্রবাহই যদি থাকে তাহলে বুঝতে হবে নদীর পানি নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত সরকার দার্জিলিং পাহাড়ে ৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে। যদি রান অব দ্য রিভার বাস্তবেই হতো তাহলে "তিস্তায় জল নেই" বলতে হতো না, তিস্তায় পানি থাকতো।'

ইনামুল হক আরও বলেন, 'গজলডোবা ব্যারেজের উজানে যতগুলো ড্যাম আছে এর সবগুলোকে "রান অব দ্য রিভার" বলা হয়। কেবল গজলডোবা ব্যারেজটা ইরিগেশন; সেচ প্রকল্পে দেওয়ার জন্য। স্টোরেজ রান অব দ্য রিভার হলে নদীর পানি নদীতেই থাকার কথা, তাহলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কথা ঠিক থাকে না যে, তিস্তায় জল নেই।'

এ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আমাদের জানানো দরকার, এই যে তোমরা রান অব দ্য রিভার করছো সেটা তো একটা মিথ্যাচার। এটা টেকনিক্যালি হয় না। রান অব দ্য রিভার হলে তো নদীতে পানি থাকে। অথচ তুমি বলছো তিস্তায় পানি নেই।'

তাই রান অব দ্য রিভার ধারণাটি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না- তা বোঝার জন্য বাংলাদেশকেই উদ্যোগী হয়ে যৌথ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন এই পানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, 'যৌথ পরিদর্শন করে দেখা দরকার, এটা আসলে রান অব দ্য রিভার, নাকি ভাটির মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি দূরভিসন্ধিমূলক প্রকল্প।'

এ বিষয়ে আইনুন নিশাতের বক্তব্য, 'তিস্তার ওপরে ইতোমধ্যে অনেকগুলো রান অব দ্য রিভার বানিয়েছে ভারত সরকার। সেগুলো মনে হয় সিকিম অঞ্চলে অবস্থিত। রান অব দ্য রিভারে সাধারণত কোনো পানি খরচ হয় না। পানিটা এমনভাবে প্রবাহিত করা হয় তাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এতে কোনো জলাধার নেই। পানি আবার নদীতে ফেরত আসে। কিন্তু আমার ধারণা, সিকিমে যে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করা হয়েছে, হয়তো সেখান থেকে কিছু পানি প্রত্যাহার হচ্ছে। হয়তো কিছু সেচ প্রকল্প আছে।'

তাই উজানে আসলে কী হচ্ছে, তার পুরো তথ্য বাংলাদেশের পাওয়া উচিত বলে মনে করেন আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, 'ভারতের উচিত বাংলাদেশকে এটা জানানো।' বলেন তিনি।

এই বিশেষজ্ঞের অভিমত, রান অব দ্য রিভার ধারণাটি পরিবেশসম্মত হলে কিছু জলাধার নির্মাণ করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা উচিত। তিনি বলেন 'এটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে করতে পারে। এতে কম খরচে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে এটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতে পারে। সবচেয়ে বড় উপকার হবে—বর্ষার সময় কিছু পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ছাড়তে পারলে।'

আইনুন নিশাত বলেন, 'বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানি বর্ষার সময় আসে, তা দিয়ে এখানে বন্যার সৃষ্টি হয়, নদী ভাঙন বাড়ে। কাজেই জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে এর প্রকোপ কিছুটা কমানো উচিত। এই জলাধার নির্মাণ ভারতেই সম্ভব। শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের ২টি প্রকল্প থেকেই প্রধান চাহিদা থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে, সেখানে কোনো মতে পানির ব্যবস্থাটা হয়। ভারত তিস্তা নদীর বাঁ তীরে ও দার্জিলিংয়ের বাম দিকে কুচবিহার অঞ্চলে সেচের জন্য আরও কিছু পানি নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে খবরের কাগজে পড়ছি।

'তাহলে বর্ষা পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে আমন মৌসুমে যে সেচ দেওয়া হয়, সেটাও চাপের মুখে পড়বে।'

এই সমস্যার সমাধানের পথ বাতলে দিয়ে তিনি বলেন, 'বর্ষার পানির ক্ষতির দিকটা কমানো, শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়ানো আর বর্ষা পরবর্তী সময়ের সমস্যা সমাধান—সবগুলোই সম্ভব বড় জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে। এই কাজটি যৌথভাবে করা উচিত। এই লক্ষ্যে দুদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন এবং চুক্তি করেছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আপাত দৃষ্টিতে রান অব দ্য রিভার পরিবেশসম্মত এবং এতে পানি প্রবাহের তেমন তারতম্য হওয়ার কথা না। কিন্তু পুরো প্রকল্পটি কীভাবে পরিচালিত হবে, তার অবকাঠামোতে কী আছে—জলাধার আছে কি না সেগুলো বোঝা দরকার।

'বর্ষার পানিটা ধরে রেখে বন্যার প্রকোপ কমানো, সেই পানিতে বর্ষা পরবর্তী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ২ দেশের চাহিদা মেটানো এবং শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়ানোর যে বিপুল সম্ভাবনা আছে সেটা তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি যেন অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অবসানের কাজে ব্যবহার করা হয় সেভাবে পরিকল্পনা করা উচিত।'

তাই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago