নাব্যতা সংকটে অচলপ্রায় বাঘাবাড়ী নৌবন্দর

নাব্যতা সংকটে বাঘাবাড়ী বন্দরসংলগ্ন বড়াল নদীতে ড্রেজিং চালাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকটের কারণে অচল হয়ে পড়তে বসেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের কার্যক্রম।

বন্দরসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ কম ভেড়ে। তারপরেও আগের বছরগুলোতে একই মৌসুমে দৈনিক ৫ থেকে ৬টি জাহাজ বন্দরে ভিড়ত। এ বছর সপ্তাহেও ৫-৬টির বেশি জাহাজের দেখা মিলছে না। ফলে বন্দরের বেশিরভাগ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান এই নৌবন্দরটি স্থাপিত হয় গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বেশিরভাগ সার এ বন্দরের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া সিমেন্টের ক্লিংকার, কয়লা, পাথরসহ আরও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভেড়ে এ বন্দরে।

কিন্তু চলতি মৌসুমে নাব্যতা সংকট তীব্র হওয়ায় তেলবাহী জাহাজগুলো লোড কমিয়ে কোনোভাবে বন্দরে আসলেও সারবাহী জাহাজগুলোর বেশিরভাগ এখন যশোরের নওয়াপাড়া ঘাট ও খুলনা বন্দরে নোঙর করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় চলতি শুষ্ক মৌসুমে উত্তরের জেলাগুলোতে সার ও জ্বালানি তেল সরবরাহের ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে বাঘাবাড়ী বন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি সচল করে তুলতে যত দ্রুত সম্ভব ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বন্দরের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি উঠেছে।

অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নদীতে ড্রেজিং চালু আছে। নাব্যতা কম থাকায় জাহাজগুলোকে কম লোড নিয়ে চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হলেও কেউ তা মানছে না। ফলে অতিরিক্ত মালবোঝাই জাহাজ চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুস্ক মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকে। এ সময় যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবো চর জেগে ওঠায় অতিরিক্ত মালবোঝাই জাহাজ চলাচলে সমস্যা হয়। তাই নভেম্বর থেকে পরবর্তী ৪-৫ মাস নদীতে সাড়ে ৬ ফুট থেকে ৭ ফুট ড্রাফ্‌ট লোড নিয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু সে নির্দেশনা উপেক্ষা করে অধিকাংশ জাহাজ ১০ থেকে ১২ ফুট ড্রাফ্‌ট লোড নিয়ে চলাচল করছে।'

এদিকে জাহাজ চালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে কম লোড নিয়ে জাহাজ চালালে জাহাজ মালিকদের অনেক লোকসান হয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাঘাবাড়ী ঘাটে জাহাজ নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এমভি ফয়সাল-৭ এর মাস্টার (জাহাজ চালক) ডেইলি স্টারকে জানান, চট্টগ্রাম থেকে ২০ হাজার বস্তা চাল নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে আসার পথে নাব্যতা সংকটের কারণে আরিচা ঘাটে থেমে যেতে হয়। পরে সেখান থেকে ২টি ছোট বাল্কহেডে করে এই চাল বাঘাবাড়ী ঘাটে নিয়ে আসা হয়েছে।

এই জাহাজ চালকের ভাষ্য, নাব্যতা সংকটের কারণে ১০ ফুট ড্রাফ্‌ট লোড নিয়ে নগরবাড়ীর পরে আর জাহাজ চালানো যায় না। নগরবাড়ী নৌবন্দর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত মোল্লার চর, ব্যাটারির চর ও প্যাচাকোলাসহ অন্তত ৪-৫টি পয়েন্টে বড় বড় ডুবো চর জেগে ওঠায় জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

চট্টগ্রাম থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা এমভি ওটি শিপারস ওয়ার্ল্ড-১ এর মাস্টার সবুজ মিয়া বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে কমপক্ষে ১২ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে আসি। কিন্তু এখন ৮ লাখ লিটার তেল নিয়ে আসতে হচ্ছে।'

সবুজ মিয়ার ভাষ্য, সার কিংবা বা অন্য কোনো পন্যবাহী জাহাজ মাঝ নদীতে আনলোড করে তা লাইটারিং জাহাজে করে নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু জ্বালানি তেলবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে সেটা করা সম্ভব হয় না।

লোড কমিয়ে জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করার উদ্যোগটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয় মন্তব্য করে সবুজ আরও বলেন, 'অপর্যাপ্ত ড্রেজিংয়ের কারণে নাব্যতা সংকট দূর হচ্ছে না।'

তাই নাব্যতা ফিরিয়ে এনে বাঘাবাড়ী ঘাটকে পুরোপুরি সচল করতে পর্যাপ্ত ড্রেজিংয়ের দাবি জানান তিনি।

চাল সরবরাহ কমেছে

বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের খাদ্য গুদামের ফুড ইন্সপেক্টর (ভারপ্রাপ্ত) মাসুদ রানা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক লোড নিয়ে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় এখানে চাল সরবরাহ কমে গেছে।

তিনি বলেন, 'তবে খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিটি জাহাজ মাঝ নদীতে আনলোড করে পণ্য বন্দরে আনা হচ্ছে। এতে পণ্যের পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ছে।'

তিনি আরও জানান, পণ্য পরিবহন সচল রাখতে বাঘাবাড়ী বন্দরের নৌচ্যানেলটি দ্রুত খনন করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।

বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, 'ইতোমধ্যে যমুনার ৩টি পয়েন্টে খননকাজ শুরু হয়েছে। তবে এ মৌসুমে পানি অব্যাহতভাবে কমতে থাকায় সংকট থেকেই যায়। তবে সাড়ে ৬ থেকে ৭ ফুট লোড নিয়ে জাহাজ চলাচলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। ৮ ফুটের বেশি ড্রাফ্‌ট লোড নিয়ে জাহাজ চালানো হলেই ডুবোচরে আটকে যাওয়ার আশংকা থাকে।'

কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বন্দরের শ্রমিকরা

এদিকে নাব্যতা সংকটে জাহাজ চলাচলে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের সার বহনকারী জাহাজগুলোর বেশিরভাগই এখন যশোরের নওয়াপাড়া ঘাট কিংবা খুলনা নৌবন্দরে নোঙর করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। পরে ট্রাকে করে এসব জাহাজের পণ্য বাঘাবাড়ী বন্দরসহ উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বাঘাবাড়ী ঘাটের শ্রমিকদের সর্দার জাহাঙ্গীর আলম সর্দার জানান, আগে শুষ্ক মৌসুমেও প্রতিদিন কমপক্ষে ৪-৫ টি জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়ত। ৫ শতাধিক শ্রমিক সারাদিন কাজ করে পুরো সার খালাস করার আগেই আরেকটি জাহাজ চলে আসত। কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। এখন সপ্তাহেও ৫-৬টির বেশি জাহাজ আসছে না। ফলে বন্দরের বেশিরভাগ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

বন্দর কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, 'উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌবন্দরটি আধুনিকায়নের জন্য ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বন্দরে জেটি স্থাপন, ওজন স্টেশন স্থাপনসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংযোজন করা হবে। পাশাপাশি নদীতে পর্যাপ্ত ড্রেজিং করে সবসময় মালবাহী জাহাজ চলাচলের উপযোগী রাখা হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

5h ago