ওএমএসের দীর্ঘ সারি থেকে হতাশা নিয়ে ফিরছে মানুষ

ট্রাক থেকে ওএমএসের পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ সারি। ছবি: স্টার

'ভোরে শুধু পানি খেয়ে রওনা দিয়েছি, দেরি করিনি, যদি গিয়ে লাইনের শুরুতে দাঁড়াতে না পারি সেই ভয়ে।' কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার লালবাগ এলাকার শহীদ নগরের বাসিন্দা ৮০ বছর বয়সী রেনু বিবি।

বয়সের ভারে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন রেনু। তারপরও মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাওয়া ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির চাল-আটা কিনতে রাজধানীর আজিমপুর অগ্রণী স্কুল সংলগ্ন ট্রাকের কাছে এসেছেন তিনি।

রেনু যখন বাসা থেকে রওনা দিয়েছেন, তখন কিছুটা অন্ধকার। তিনি একটি চোখে দেখতে পান না, অপর চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'দোকানে চাল-আটার দাম অনেক বেশি। তাই সরকারিভাবে বিক্রি হওয়া এই চাল-আটা কিনতে এসেছি। আমাদের ভাগ্য খারাপ। নইলে কি আর এত কষ্ট করতে হয় পেটে দুইটা ভাত দেওয়ার জন্য। আল্লাহ কি আমাদের এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিবে না?'

গত ২৭ নভেম্বর রেনু যখন এসব কথা বলছিলেন তখন সকাল প্রায় ৭টা। লাইনে তখন ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ, আর রেনু লাইনের প্রায় মাঝামাঝিতে ছিলেন।

তিনি বলেন, 'গত রোববার (২৫ নভেম্বর) লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। আজ চাল-আটা নিতেই হবে। কারণ, বাজারে দাম অনেক বেশি।'

ভোর থেকে অপেক্ষার পর রেনু সকাল ১০টার দিকে ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি আটা কিনতে পেরেছিলেন।

৫ কেজি চাল ও ২ কেজি আটায় কোনোরকমে রেনুর ৫ সদস্যের পরিবারের ৩ দিন চলে যায়। এরপর আবার তাকে এসে লাইনে এসে দাঁড়াতে হয়। তিনি জানান, গুলিস্থানের একটি মার্কেটে কাজ করা তার একমাত্র ছেলেই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

ওএমএসের ট্রাকের পিছনে তখন নারী, প্রবীণ, যুবক, তরুণ, সন্তানসম্ভবা নারী ও শিক্ষার্থীরা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়েছে।

রেনুর মতো, ঢাকার হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষ ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্য কেনার চেষ্টায় থাকেন। তাদের সারি প্রতিদিন হচ্ছে দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সারির একটি বড় অংশ প্রতিদিন খালি হাতে ফেরেন পণ্য শেষ হয়ে যাওয়ায়।

খাদ্য অধিদপ্তর ওএমএস কর্মসূচির আওতায় প্রতিদিন একজনের কাছে সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল ও ৪ কেজি আটা বিক্রি করে। এর দাম ২২২ টাকা। তবে বাজার থেকে কিনলে একই পরিমাণ চাল ও আটার দাম পড়ে ৫০০ টাকার বেশি।

খাদ্য অধিদপ্তর প্রতি বছরই ওএমএসে চাল, আটাসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করে। তবে, করোনা মহামারির আগে ওএমএসের ট্রাকের পেছনে এত বেশি ভিড় দেখা যেত না।

লাইনে দাঁড়ানো ৬ মাসের সন্তানসম্ভবা কাজী শিরিন বলেন, 'গত ৪ দিন লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-আটা কোনোটাই কিনতে পারিনি। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে খুব ভোরে উঠতে পারি না। যখন ট্রাকের কাছে পৌঁছাই, তখন লাইনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে যান।'

তিনি জানান, তার স্বামী যে বেতন পান, তা দিয়ে বর্তমানে সংসার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই কিছুটা স্বস্তির জন্য কম দামে ওএমএসের পণ্য কিনতে এসেছেন।

দেশের বাজারে চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনে কী প্রভাব পড়ছে, তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত মাসে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাব বলছে, গত ১ বছরে মোটা চালের দাম ৭ শতাংশ, খোলা আটার দাম ৭৬ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২২ শতাংশ, মশুর ডালের দাম ২৯ শতাংশ, চিনির দাম ৪৭ শতাংশ ও ডিমের দাম ৮ শতাংশ বেড়েছে।

গত ১ সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টার ৮টি ওএমএসের ট্রাকসেল স্পট ঘুড়ে দেখেছে। প্রায় সব জায়গাতেই দুপুর ১২টার আগেই পণ্য শেষ হয়ে যায়। খালি হাতে ঘরে ফেরেন অনেক মানুষ।

সব জায়গায়তেই চাল-আটা পেতে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। যেমন: সকাল ৭টার দিকে শেওড়াপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় ৩০ জনের মতো মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের হাতে লেখা ছিল সিরিয়াল নম্বর।

নীলক্ষেত মোড়ে সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে আটা শেষ হয়ে গেলেও চাল ছিল। সেই পরিমাণ চাল ১০ জনের কাছে বিক্রি করতে পেরেছিলেন বিতরণকারী কর্মীরা।

সেই লাইনে থাকা আকলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, গত ২৩ ও ২৪ নভেম্বর তিনি দাঁড়িয়েছিলেন লাইনে। কিন্তু চাল-আটা কিনতে পারিনি।

তিনি বলেন, 'আজও কিনতে পারিনি। ১১টার দিকে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রাকের সামনে আমি পৌঁছানোর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।'

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিবেশকেরা জানান, প্রতিটি ট্রাকের জন্য প্রতিদিন ২ হাজার কেজি চাল ও ১ হাজার কেজি আটা দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় কোন জায়গায় তারা বিক্রি করবেন। কোন দিন কোন জায়গায় বিক্রি হবে, তা নির্দিষ্ট করা নেই।

খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরে ২০০টি স্থানে ট্রাক ও দোকানের মাধ্যমে চাল-আটা বিক্রি হয়।

চলতি বছরের শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় চাপ বাড়ছে। এ কারণেই ওএমএসের ট্রাকগুলোর পেছনে লাইন দিন দিন বড় হচ্ছে বলে মনে করছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, 'খাদ্য নিরাপত্তার ওপর যে চাপ, এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটাকে এড়িয়ে গেলে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এর পরিমান বেশ কম। এর আওতা আরও বাড়তে হবে। আমি আশা করব নীতি নির্ধারকরা বর্তমান পরিস্থিতিটা অনুধাবন করবেন।'

'পণ্য বিক্রির বিষয়টা কিভাবে আরও সিস্টেমেটিক করা যায় সেটাও দেখা উচিত। কারণ যাদের পাওয়ার কথা তারা নানান কারণে পণ্য পাচ্ছেন না', যোগ করেন তিনি।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে তাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, কথা বলা সম্ভব হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English
probe committee for past elections in Bangladesh

Govt launches probe into last 3 national polls

The government has formed a committee to investigate allegations of corruption, irregularities, and criminal activities in the three national elections held in 2014, 2018, and 2024.

7h ago