ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য: পদ্মায় চলছে চোর-পুলিশ খেলা

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও পদ্মা নদীতে নৌকা নিয়ে ইলিশ মাছ ধরছেন জেলেরা। ছবি: স্টার

দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রতি বছরের মতো এবারো ইলিশ মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা চলবে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত।

নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের জন্য সরকার চাল বরাদ্দ দেয়। এ বছর অভিযান শুরু প্রায় ১০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনও বরাদ্দের চাল পাননি জেলেরা। ফলে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই মাছ ধরছেন অনেকে।

অধিকাংশ জেলে মাছ ধরতে না পারায় বাজারে মাছের প্রাপ্যতা যেমন কমে গেছে, তেমনি বিপাকে পড়েছে জেলে পরিবারগুলো।

সরেজমিনে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পাবনার সুজানগর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ১৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীতে চলছে অবাধে মা ইলিশ মাছ নিধন।

স্থানীয় মৎস্য বিভাগের দাবি, নিয়মিত অভিযান চালিয়েও মাছ নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না।

সুজানগরের সাতবারিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিকেল থেকে কয়েকশ মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো নদী।

অভিযানের ভয় থাকলেও, জীবিকার তাগিদে মাছ ধরা বন্ধ করছে না সাধারণ জেলেরা।

সুজানগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুর কাজমি জামান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৭ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর থেকেই নদীতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে মৎস্য বিভাগ। তবে অভিযান অব্যাহত থাকলেও, নদীতে মাছ ধরা থামানো যাচ্ছে না।'

এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, 'সুজানগর উপজেলায় তালিকাভুক্ত প্রায় ৪ হাজারের বেশি জেলে রয়েছে। তাদের মধ্যে এ বছর ১ হাজার ২৫০ জন জেলেকে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধের এ সময়টিতে ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'অভিযানের শুরু থেকেই তাদের সজাগ করা হলেও সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই অনেকে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। আমরা যখনই সংবাদ পাচ্ছি, তখনই অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু আমরা নদীতে নামলেই, দূরে থেকে তা লক্ষ্য করে দ্রুত তারা পালিয়ে যায়।'

'উপজেলার প্রায় ১৫ কিলোমিটার নদী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হলেও চোর-পুলিশ খেলার মতো পালিয়ে বেড়ায় জেলেরা। ফলে বেশিরভাগ অভিযানেই মাছসহ হাতেনাতে জেলেদের ধরা যাচ্ছে না', বলে জানান তিনি।

মাছ ধরা বন্ধ করতে হলে নদীর পুরো এলাকায় একযোগে অভিযান চালাতে হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সহায়তা দরকার।'

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর নদীতে মাছ অনেক কম পাওয়া গেলেও মহাজনের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নদীতে মাছ ধরতে হচ্ছে তাদের।

সাতবারিয়া কাঞ্চন পার্ক এলাকার জেলে নুরাল খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর এ সময় প্রতিদিন নদীতে জাল ফেলে অন্তত ২০-২২ কেজি মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এ বছর ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে জাল ফেলেও ৭-৮ কেজির বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।'

তিনি জানান, এ বছর নদীতে পানির গভীরতা অনেক বেশি এবং নদীতে স্রোতও অনেক বেশি। এর ফলে, নদীতে ইলিশ মাছ ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের প্রত্যেকের মাথার ওপর বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা। মহাজনের ঋণ পরিশোধ করে সংসার চালানোর জন্য ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নদীতে নামতে বাধ্য হই।'

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুজানগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুর কাজমি জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের দুরবস্থার কথা মাথায় রেখে তালিকাভুক্ত প্রতিটি জেলে পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বরাদ্দের চাল হাতে পাওয়া গেছে। অচিরেই তা জেলেদের মাঝে বণ্টন করা হবে।'

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও পদ্মা নদীতে নৌকা নিয়ে ইলিশ মাছ ধরছেন জেলেরা। ছবি: স্টার

দেশের বৃহত্তম স্বার্থের কথা চিন্তা করেই এ কয়দিন নদীতে বের জাল দিয়ে মা মাছ নিধন বন্ধ রাখার আহ্বান জানান তিনি।

জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞার ১০ দিনেও সরকারের বরাদ্দকৃত চাল হাতে পাননি তারা।

সাতবারিয়া এলাকার জেলে নুরাল জানান, গত বছর মাছ ধরা বন্ধের শেষ সময়ে ১৫ কেজি চাল পেয়েছিলেন। এ বছর এখনো চাল পাননি তারা।

তিনি বলেন, 'নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, ঘরে চাল নেই। এতগুলো দিন মাছ না ধরলে বেঁচে থাকব কীভাবে?'

সাতবারিয়া এলাকার আরেক জেলে শুকুর আলি বলেন, 'ইলিশ ছাড়া অন্য মাছ ধরতে গেলেও দুর্ভোগ। অথচ ঘরে খাওয়ার চাল নেই। বরাদ্দের চাল পাব কি না, জানি না।'

এ ব্যাপারে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, 'চাল বরাদ্দ দেয় জেলা প্রশাসন, আর জেলেদের মধ্যে বরাদ্দের চাল তুলে দেয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। এ বছর জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ব্যস্ত থাকায় বরাদ্দের চাল উত্তোলন করতে দেরি হয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যেই বরাদ্দের চাল বিতরণ করা হবে।'

বরাদ্দের চাল ঠিকমতো না পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, 'প্রতিটি জায়গায় বরাদ্দের ২৫ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছি। যদি ঠিকমতো চাল না পায়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনে জেলেরা অভিযোগ করতে পারেন।'

নদী এলাকার আশেপাশে গোপনে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ মাছ। সাতবারিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেকেই অন্য মাছের সঙ্গে কিছু ইলিশ মাছও নিয়ে এসেছেন। পাত্রের নিচে লুকিয়ে রেখেই এগুলো বিক্রি করা হচ্ছে।

না প্রকাশ না করার শর্তে এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, 'নদীতে অন্য মাছ ধরার জন্য জাল ফেলে ২টি ইলিশ পেয়েছিলাম। তাই বিক্রি করতে নিয়ে এসেছি।'

সুজানগরের সাতবারিয়া, নাজিরগঞ্জ, সাগরকান্দিসহ পদ্মা নদীপাড়ের বিশাল এলাকা জুড়ে গোপনেই ইলিশ মাছ বিক্রি করছেন জেলেরা। অনেকেই বড় ঝুরিতে ইলিশ রেখে উপরে অন্য কোনো মাছ সাজিয়ে রেখেছেন প্রশাসনের নজর এড়াতে।

মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, ইলিশ ধরা বন্ধের জন্য অভিযান চলার কারণে বাজারে অন্য মাছও পাওয়া যাচ্ছে না।

সাতবারিয়ার মাছের আড়তদার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ মন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আসে আরতে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে অধিকাংশ জেলে নদীতে নামতে ভয় পাচ্ছেন। উপরন্তু নদীতে পানি বেশি থাকায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, আরতে মাছের আমদানি একেবারে নেই বললেই চলে।'

'যে জেলেরা গোপনে মাছ ধরেন, তারা গোপনেই বিক্রি করেন। ফলে, বাজারে মাছ নেই', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
future of bangladesh after banning awami league

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

15h ago