পঞ্চগড়ে নৌকাডুবি

একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে শিশু কন্যা নিয়ে দিশেহারা ভৈরবী

সিন্টু বর্মণের স্ত্রী ভৈরবী। ছবি: স্টার

গৃহবধূ ভৈরবী রানী টিনের চালার মাটির ঘরের বারান্দায় একটি কংক্রিটের খুঁটি ধরে কেঁদেই চলেছেন। শোকাহত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কয়েকজন প্রতিবেশী বাড়ির চারপাশে অবস্থান করলেও ছিলেন নির্বাক।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ পালনের বিষয়ে বাড়ির বাইরে বসে আলোচনা করছেন দু-একজন আত্মীয়সহ একদল গ্রামবাসী।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এমন চিত্র চোখে পড়ে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মারেয়া ইউনিয়নের বটতলী গ্রামে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারানো সিন্টু বর্মণের (৩০) বাড়িতে।  

প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ১৮ বছর আগে পিতা নরেশ চন্দ্র বর্মণকে হারিয়ে ১২ বছর বয়সী শিশু সিন্টু পিতৃস্নেহ ছাড়া মায়ের কাছে বড় হতে থাকে। সহায়সম্বল তেমন কিছু না থাকায় ছেলেবেলা থেকেই মা পার্বতী রানীর পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ শুরু করেন তিনি।   

এভাবে চলতে চলতে ২ বছর আগে একই উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের নারায়ণ চন্দ্রের মেয়ে ভৈরবী রানীর (১৮) সঙ্গে বিয়ে হয় সিন্টুর। বিয়ের বছর খানেক পরে তাদের ঘরে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান।

কন্যাকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন বোনা দম্পতির দিন অতিবাহিত হতে থাকে স্বাচ্ছন্দ্যে। এরমধ্যে পূজার আবহ শুরু হয়, আসে মহালয়ার লগ্ন ।  

সন্তান ছোট বলে এক জেঠুর সঙ্গে পাশের গ্রামের প্রাচীন বদেশ্বরী মন্দিরে ঐতিহ্যবাহী মহালয়ার ধর্মীয় আচারে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সিন্টু। সে অনুযায়ী রোববার দুপুরে তারা দুজন ওই গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে রওনা হন। কিছুক্ষণ পর খবর আসে নৌকাডুবিতে সিন্টু তলিয়ে গেছে জলে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শুরু হয় প্রতীক্ষার প্রহর। একদিন পরে সোমবার জেঠু জগদীশ ও একই গ্রামের কনিকা রানী, পারুল রানীর মরদেহ আসে। পরদিন কনিকার স্বামী হরি কিশোরের মরদেহ পাওয়া যায়। অবশেষে সিন্টুর নিথর দেহের দেখা পায় ভৈরবী।

সেদিন থেকেই কখনো লোকচক্ষুর আড়ালে, কখনো বা সম্মুখে ক্লান্তিহীন অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে তা গাল বেয়ে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ভৈরবীর মা সুমিত্রা রানী বলেন, 'জামাই বাবাজির এভাবে অকালে চলে যাওয়ার পর আমরা কিছু ভাবতে পারছি না। আমার এই অল্প বয়সী মেয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে বাকি জীবন কিভাবে চালাবে?'

৪ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন সিন্টু। দিনমজুরী করে চলতো তাদের সংসার।

সিন্টুর মা পার্বতী রানী ঘরে বসেছিলেন। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বলেন, আমার আদরের ছেলে চলে গেছে... কেন সে তাকে ছাড়া এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল... এখন কী হবে?'

সিন্টুর এক আত্মীয় সুবাস বর্মণ (২৮) জানান, সিন্টুর বাবা মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। এরপর থেকে তিনি তার মায়ের সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকতেন এবং প্রায় ২ বছর আগে ভৈরবীকে বিয়ে করেন। এখন সিন্টুকে ছাড়া সংসার চলা খুব কঠিন, বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি ।

পঞ্চগড় ও আশপাশের এলাকার হিন্দু পুণ্যার্থীরা মহালয়া উপলক্ষে গত রোববার ঐতিহ্যবাহী একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বদেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। উপজেলার আউলিয়ার ঘাটে করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে ।    

এতে করে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধারকারীরা ৩০ জন নারী, ১৭ জন পুরুষ ও ২১ শিশুসহ ৬৮ জনকে উদ্ধার করে এবং ৪ জন এখনো নিখোঁজ আছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায়।

Comments

The Daily Star  | English

Political parties with phantom addresses queue for EC nod

In its application for registration with the Election Commission, Janatar Bangladesh Party has said its central office is located on the 12th floor of Darus Salam Arcade near the capital’s Paltan intersection.

1d ago