শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যের কারখানায় পরিণত হয়েছে: আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ। ছবি: স্টার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যের কারখানায় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ।

আজ শনিবার ৬০তম শিক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) আয়োজিত সমাবেশে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।

আনু মুহাম্মদ বলেন, 'শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অধিকারের চেয়ে শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করতে যে ধরনের নীতির প্রয়োজন, সে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, '১৯৬২ সালে স্বৈরশাসনের সময়ে শিক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছিল। সেই ষাটের দশকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক আমরা দেখেছি। সেই উন্নয়ন দশকের বিশাল বিজ্ঞাপনও আমরা দেখেছি। আরেকটি উন্নয়ন দশক দেখেছি আশির দশকে, সেখানেও ছাত্র আন্দোলন দিয়েই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। ১৯৮২ এবং ৮৩ সালে যে ছাত্র আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল, সে ছাত্র আন্দোলন কিন্তু স্বৈরাচারকে হটিয়েছিল। এ আন্দোলনগুলোর মধ্য দিয়ে শরীফ শিক্ষা কমিশন এবং মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে অনেক দাবি উঠেছিল।'

'সে দাবির মধ্যে সবার জন্য অভিন্ন এবং অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করা, গণতান্ত্রিক এবং জন্মগত অধিকার হিসেবে দেশের শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বজনের শিক্ষাকে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করার দাবি ছিল', যোগ করেন তিনি।

ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার অধিকতর বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'কুতরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ছিল। যে কমিশনের পক্ষে স্বাধীনতাত্তোর সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। সে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের অগ্রসর দাবিগুলো এখনও বাস্তবায়িত হতে দেখিনি।'

আনু মুহাম্মদ বলেন, 'দেশের জনসংখ্যার সর্বাধিক হচ্ছে তরুণ। তরুণরাই এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। দেশে যে ধরনের উন্নয়ন ধারা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে উন্নয়নের নামে নদী-নালা, খাল-বিল ধ্বংস করা হচ্ছে। দেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ধরনের চুক্তি এবং সম্পদ লুণ্ঠন এবং পাচারের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারাই এখন ক্ষমতায় আছেন। এ ক্ষমতাবানগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের মধ্যে তৈরি হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক বিভিন্ন ব্যবস্থা।'

তিনি আরও বলেন, 'জঙ্গিবাদী চিন্তা হলো সেই চিন্তা, যা অন্য কোনো চিন্তাকে গ্রহণ করে না৷ অন্যের মতকে গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকা এবং যে কোনো মত নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলে হামলা করাই যদি জঙ্গিবাদী মতাদর্শ হয়, তাহলে বর্তমান সরকার ও তাদের ছাত্রসংগঠন জঙ্গিবাদী মতাদর্শ থেকে কীভাবে আলাদা হলো? তাদের মতাদর্শও তো জঙ্গিবাদী মতাদর্শ৷ কারণ তারা মনে করে, তারা যা বলবে সেটাই ঠিক, তারা যেভাবে ইতিহাস বলবে সেভাবেই মানতে হবে, তারা যেটাকে উন্নয়ন বলবে সেটাকেই উন্নয়ন বলতে হবে৷ এর বাইরে কেউ যেতে পারবে না৷ এই অবস্থানটাই তো জঙ্গিবাদী মতাদর্শ।'

'সরকার বলছে যে তারা খুব জঙ্গিবিরোধী লড়াই করছে৷ কিন্তু জঙ্গিবাদী মতাদর্শ ধারণ করে একটা সরকার কী করে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই করবে? জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান শক্তি হচ্ছে সৃজনশীলতা, ভিন্নমত, প্রশ্ন উত্থাপন ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা৷ এর মধ্য দিয়ে তরুণদের সক্ষমতা বিকশিত করতে পারলে তরুণরা কারও অস্ত্র বা রোবট-কম্পিউটারে পরিণত হবে না', যোগ করেন তিনি।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখি৷ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি অনুমোদিত হবে কি না, তা নিয়ে কিছুদিন আগে কথাবার্তা হয়েছে৷ কিন্তু এটা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, ছাত্ররাজনীতি আর সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস- দুটো এক কথা নয়৷ ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চেতনার একটা প্রকাশ৷ এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকায় আসতে পারে৷ সন্ত্রাসী রাজনীতির একটা ধরন এখন ছাত্রলীগের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ৷ স্বাধীনতার আগে যখন আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরশাসন ও উন্নয়ন-দশক চলছিল, তখন তার পৃষ্ঠপোষকতায় এনএসএফ নামের একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি হয়েছিল৷ এনএসএফের কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের প্রতিবাদী তৎপরতার ওপর আক্রমণ।'

তিনি আরও বলেন, 'স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের মতাদর্শ নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল৷ ক্ষমতাসীন দল শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন শিল্প-কারখানা দখল ও গ্রামাঞ্চলে সন্ত্রাস তৈরি করতে থাকে৷ ভিন্নমতকে দমন করার জন্য বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করা হতে থাকে৷ সেই যাত্রাটাই ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে হতে আজকের অবস্থায় এসেছে৷ হলগুলো নির্যাতনের কারখানায় পরিণত হয়েছে৷ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে নাজুক ও অসহায় অবস্থায় থাকে৷ তারা সবচেয়ে নির্যাতিত ও অসহায়৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম-গেস্টরুম ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন একটা নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে৷ সরকারি ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চিত করতে লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা পালন করা৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌক্তিক কোনো আন্দোলন হলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করাটাই তাদের কাজ৷'

'তারা দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজদের সহযোগীতে পরিণত হয়৷ হুমকি, চাপ, নির্যাতন, ব্ল্যাকমেইল ইত্যাদির মাধ্যমে তারা তরুণদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীতে পরিণত করে৷ এমন ব্যবস্থায় ভিন্নমত, সৃজনশীলতা ও নতুন নতুন প্রশ্নের সন্ধান- এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আসে না৷ প্রশ্ন তোলাটাই এখন সবচেয়ে বড় অপরাধ৷ প্রশ্ন তোলা বা প্রশ্নকে সামনে আনার প্রক্রিয়া দুর্বল হলে সেই সমাজ একটা মৃত সমাজে পরিণত হয়৷ এমন সমাজে চিন্তার বিকাশ কীভাবে হবে? স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা সেটাই চায়', মত দেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'পাকিস্তান আমলে লড়াই ছিল ২২ পরিবারের আধিপত্য, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে৷ আজকে বাংলাদেশে সেই ২২ পরিবারের চেয়ে বেশি পরিবার ধণিক গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে৷ শীর্ষ ধনী ২২ পরিবারকে শনাক্ত করলে দেখা যাবে যে তারা পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের চেয়েও অনেক বেশি সম্পদশালী৷ এটা কীভাবে হলো? বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি বেড়েছে শ্রমিকসহ সব মানুষের পরিশ্রমে৷ অথচ শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নেই৷ তাদের শ্রমে তৈরি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে৷  এরা ব্যাংক লুট, নদী-খাল-বিল দখল ও অর্থ পাচার করে৷ এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, যেগুলো বিদ্যুৎ না দিয়েও ১১ বছর সরকারের কাছ থেকে বসে বসে ৯০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে৷ এই অর্থ আমাদের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের ৩ গুণ বেশি৷ এই লুটেরারা দেশে জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা চায়৷'

'দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো নির্যাতনের কারখানায় পরিণত হতে পারত না, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হতো না, একের পর এক ব্যাংক লুট করে লাখ-কোটি টাকা পাচার হতো না৷ যে শ্রেণি-গোষ্ঠী দেশের বিদ্যমান উন্নয়নব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারাই নিজেদের স্বার্থে এই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হাজির করছে৷ এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্যাতনের কারখানায় পরিণত করা হয়েছে৷ এর মধ্য দিয়ে তরুণসমাজের সৃজনশীলতা ও স্বাধীন বিকাশের পথকে রুদ্ধ করা হচ্ছে৷ এ ছাড়া যেগুলোকে মেগা উন্নয়নপ্রকল্প হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তার প্রত্যেকটাই অসুখ তৈরির কারখানা৷ বিদ্যমান এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শিক্ষকদের একাংশ আক্রমণের মুখে পড়েছেন, আবার শিক্ষকদেরই একটা অংশ সুবিধা নেওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করছেন', তিনি বলেন।

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'তারা এমন ধরনের তরুণ চায়, যারা হবে রোবট, কম্পিউটারের মতো একটা যন্ত্র৷ যে যন্ত্র সরকার যেভাবে চালাবে সেভাবেই চলবে৷ যত দামিই হোক, কোনো যন্ত্র নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না৷ নতুন সৃষ্টি করে মানুষের শ্রম ও মেধাশক্তি৷ স্বৈরতন্ত্রের সুবিধাভোগী সরকার ও লুটেরা পুঁজিপতি গোষ্ঠী তরুণদের স্পর্ধা, ভিন্নমত ও বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে ভয় পায়৷ সেজন্য তারা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চায়, যেখানে তরুণরা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।'

সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সভাপতিত্ব করেন ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি অনিক রায় এবং সঞ্চালনা করেন মিখা পিরেগু।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

1h ago