বৈশ্বিক সংকটে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে ৪ দিনের ভারত সফর শুরু করেছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং করোনা মহামারির কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংকটের মধ্যে এই সফর ভারত ও বাংলাদেশের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রতিবেশী দেশটি তিস্তার পানি বণ্টন ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের মতো সমস্যা সমাধানে উদার ভূমিকা পালন করবে। এই ২ দেশ ভূমি ও সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান ঘটাতে সক্ষম হওয়ায় তিস্তার পানি বণ্টন ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশা বেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করতে ভারতে গিয়েছেন।

গত বছর নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন এবং শেখ হাসিনা সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম আয়োজিত একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে ভারতে গিয়েছিলেন।

ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বন্ধুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা তার সফরের প্রাক্কালে সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছিলেন, মতপার্থক্য থাকতে পারে তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিৎ।

তিনি বলেন, অভিন্ন নদী, বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারতের আরও উদারতা দেখানো উচিত। কারণ বাংলাদেশ ভাটিতে অবস্থিত।

নরেন্দ্র মোদি এই সমস্যা সমাধানে আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আপনাদের দেশেই সমস্যাটি রয়ে গেছে। আমরা আশা করি, এর সমাধান হয়ে যাবে। শুধু মাত্র গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি আমরা করেছি। আমাদের আরও ৫৪টি নদী রয়েছে। কাজেই এটা অনেক বড় একটি বিষয় এবং এর সমাধান হওয়া জরুরি। আর এই সমস্যার সমাধার নির্ভর করছে ভারতের উপর।'

প্রধানমন্ত্রীর সফর বিষয়ে গতকাল সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ইউক্রেন সংকট, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনা মহামারির মধ্যে এই সফর তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ২ প্রতিবেশী দেশ চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা বাড়াতে চায়।

তিনি বলেন, ঢাকা ও নয়াদিল্লি পানি ব্যবস্থাপনা, রেলওয়ে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ে অন্তত ৭টি সমঝোতা স্মারক সই করতে পারে।

তিনি বলেন, 'আমরা আশা করি সফরটি সফল হবে। এটি আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।'

তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশ মনে করে এই সফর ২ দেশের মধ্যে নতুন 'সহযোগিতার দুয়ার' উন্মোচন করবে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ১০টা ১৭ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ভিভিআইপি চার্টার্ড ফ্লাইটে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি পৌঁছালে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ভিভিআইপি বিমানবন্দর পালাম এয়ার ফোর্স স্টেশনে নামার পর ভারতের রেল ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা ভি জারদোশ এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইমরান তাকে অভ্যর্থনা জানান।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি তার অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'এই সফর ২ দেশের বহুমুখী সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে।'

সফরকালে প্রধানমন্ত্রী হায়দ্রাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপ রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি এই সফরকে একটি শুভেচ্ছা সফর হিসেবে দেখছেন। কারণ হিসেবে তিনি মনে করছেন, 'উভয় দেশেরেই ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে'।

তিনি বলেন, 'দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটি নির্ভর করে আমরা কীভাবে আমাদের সম্পর্ক পরিচালনা করি তার ওপর।'

বাংলাদেশে নিযুক্ত অপর সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বীনা সিক্রি বলেছেন, করোনা মহামারির মধ্যেও ২ দেশের সম্পর্কের এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার এই সফর তাৎপর্যপূর্ণ হবে।

তিনি বলেন, 'আমি মনে করি ২ প্রধানমন্ত্রী সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমি পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) সইয়ের জন্য আলোচনা শুরু করার সবুজ সংকেত দিতে পারেন। এর অধীনে ২ দেশই লাভবান হবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ।'

হাসিনা-মোদি আলোচনায় যোগাযোগ ও জ্বালানি সহযোগিতা ২টি মূল বিষয় হবে। বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং পেট্রল ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে যোগ করেন সিক্রি।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো এবং রাশিয়া ও চীন বিভিন্ন দেশকে নিজেদের দিকে টানতে চাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফরটি গুরুত্বপূর্ণ হবে। ঢাকা অবশ্যই চাইবে নয়াদিল্লি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করুক, বিশেষ করে জ্বালানি ও নিত্যপণ্য সরবরাহে।'

দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সমস্যায় রয়েছে। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে চায়, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত বলে মনে করেন শহিদুল হক।

অপর সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, এই সফর ভারত-বাংলাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনবে এমন চিন্তা কিছুটা 'সুদূরপ্রসারী'।

তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় না দেশের মানুষ এই সফর থেকে খুব বেশি কিছু আশা করবে। কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আগামী বছরগুলোতেও তা বজায় থাকবে। তবে, ২০১১ সাল থেকে ভারতের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ধীরে ধীরে কমে গেছে। তখন তিস্তা নিয়ে একটি চুক্তি প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তা সই হয়নি।'

তিনি আরও বলেন, উভয় সরকার সম্পর্কের সুবর্ণ সময় দাবি করলেও গত ১১ বছরেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সেপা সই হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের দেখতে হবে এটি বাংলাদেশি পণ্যের জন্য আরও ভাল বাজার তৈরি করে কিনা এবং ভারতীয় বিনিয়োগ উভয় পক্ষের জন্য সমসুযোগ তৈরি করে কিনা।'

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, 'বন্ধুত্বের প্রকৃত মূল্য শব্দচয়নের চেয়ে পারস্পরিকতায় নিহিত। এখনই সময় পানিকে রাজনীতিবিহীন করার এবং উভয় দেশের প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করার। বাংলাদেশ অনেক আগেই তার ভূমিকা পালন করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Fulfilling sky-high expectations Yunus govt’s key challenge

Says ICG report on completion of interim govt’s 100 days in office

1h ago