শিক্ষার্থীদের দাদু ডাকেই খুশি উমেদ আলী, পারানির কড়ি নেন না

উমেদ আলীর নৌকায় চড়ে একসঙ্গে ১০-১২ শিক্ষার্থী খাল পার হতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি এই কাজটি আনন্দের সঙ্গেই করে আসছেন। ছবি: স্টার

বর্ষাকাল আসলে উমেদ আলীর কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। এ সময় ধরলা নদীর চ্যানেল বড়াইবাড়ী খালটি পানিতে ভরে ওঠে। চর বড়াইবাড়ী থেকে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে সমস্যায় পড়ে যায় খুদে শিক্ষার্থীরা । তখন উমেদ আলী তার নৌকা নিয়ে ভরসা হয়ে দাঁড়ান এসব শিক্ষার্থীদের পাশে। এমনকি তাদের কাছ থেকে পারানির পয়সাও নেন না।

কিন্তু নৌকায় যাত্রী পার করে পারানির টাকা না নেওয়ার মতো 'বিলাসিতা' সাজে না দরিদ্র উমেদ আলীর। কেবল শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি অপরিসীম মমতা ও দায়বোধ থেকেই তিনি তাদের কাছ থেকে টাকা নেন না।

নৌকায় করে বড়াইবাড়ী খাল পার হতে লাগে ৮-১০ মিনিট। চর বড়াইবাড়ী গ্রাম থেকে ৬৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে বড়াইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। উমেদ আলীর নৌকায় চড়ে একসঙ্গে ১০-১২ শিক্ষার্থী খাল পার হতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি এই কাজটি আনন্দের সঙ্গেই করে আসছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি দাদু হিসেবে পরিচিত।

বর্ষা মৌসুমে স্কুল শুরুর আগে এবং ছুটির পরে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে পার করেন উমেদ আলী। এ সময় এটা তার রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ছবি: স্টার

২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক উমেদ আলীর বয়স ৬৬ বছর। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নে ধরলা নদীর তীরে চর বড়াইবাড়ী গ্রামে তার বসবাস। শরীরে দানা বেঁধেছে নানা রোগব্যাধি। কিন্তু কর্মযজ্ঞ থামেনি তার। ছেলে-মেয়ে সবার বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা থাকেন আলাদা সংসারে। স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে (৬০) নিয়ে উমেদ আলীর সংসার।

উমেদ আলীর সম্পদ বলতে আছে ৩ শতাংশ জমির ওপর তৈরি একটি বসতঘর আর একটি নৌকা। নৌকায় চড়ে মাঝেমধ্যে মাছ ধরেন। সরকারের দেওয়া বয়স্ক ভাতা পান।

উমেদ আলীর ভাষ্য, ভালোলাগা থেকেই তিনি নৌকায় করে বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীদের পার করেন। এ কাজটি না করলে বর্ষাকালে চরের শিশুরা স্কুলে গিয়ে পড়তে পারত না।

বড়াইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান বড়াইবাড়ী খালের পাশেই। ছবি: স্টার

তিনি বলেন, 'শিশুরা সবাই আমাকে দাদু ডাকে। এতেই আমি খুশি। রোগের কারণে আগের মতো মাছ ধরতে পারি না। যা আয় করি তাতে কোনোরকমে সংসার চলে।'

বড়াইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান বড়াইবাড়ী খালের পাশেই। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে স্কুল শুরুর আগে এবং ছুটির পরে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে পার করেন উমেদ আলী। এ সময় এটা তার রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফি খাতুনের ভাষ্য, 'দাদু (উমেদ আলী) খুবই ভালো মানুষ। তিনি তার নৌকায় খুব যত্ন করে আমাদের খাল পার করান।'

শিক্ষার্থী আঁখিমনির বাবা এরশাদুল আলম বলেন, 'বছরের প্রায় ৬ মাস বড়াইবাড়ী খালে পানি থাকে। উমেদ আলী এভাবে সহযোগিতা না করলে চরের শিশুরা বর্ষাকালে স্কুলে আসতেই পারত না।'

বড়াইবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাহের আলী জানান, এই বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯৩ জন। এরমধ্যে কেবল চর বড়াইবাড়ী থেকেই আসে ৬৫ জন। বর্ষাকালে চরের শিক্ষার্থীদের স্কুল আসতে নির্ভর করতে হয় নৌকার ওপর।

সাহের আলী বলেন, 'উমেদ আলীর নিজেরই ঠিকমতো ২ বেলা খাবার জোটে না। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায়-স্বানন্দে শিক্ষার্থীদের পারপারের কাজটি করে যাচ্ছেন। আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করতে চাইলেও তিনি তাতে রাজি হননি।'

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোর্শেদা বেগমের কাছে উমেদ আলী একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি বলেন, 'উমেদ আলীর নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় চরের শিশুরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh lost over Tk 226,000cr for tax evasion: CPD

CPD estimated that around 50 percent of this amount has been lost to corporate tax evasion.

38m ago