ঢাবি শিক্ষার্থী ছেলের মুখে চা-শ্রমিক মায়ের করুণ গল্পগাথা

মা কমলি রবিদাসের সঙ্গে ছেলে সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন। ছবি: সংগৃহীত

সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন হতদরিদ্র এক চা-শ্রমিক মায়ের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চা-বাগানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নামমাত্র মজুরি পান মা। সেই কষ্টার্জিত টাকায় তিলে তিলে সন্তানকে এতদূর নিয়ে এসেছেন তিনি।  

মা বলেছেন, 'বাপ, তোর চাকরি হলে আমি চা-বাগানের কাজ ছেড়ে দেবো'। মায়ের এ কথা ছেলের কানে বার বার বাজে। সন্তোষের প্রতিজ্ঞা তাই বিসিএস দিয়ে পুলিশ ক্যাডার হয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটাবেন। সেই লক্ষ্যেই এগুচ্ছেন তিনি।

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে সারাদেশে আন্দোলন করছেন চা-শ্রমিকরা। সেই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

এবার দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সন্তোষ তুলে ধরেছেন সেই সংগ্রামী মায়ের করুণ জীবনের গল্পগাথা।

সন্তোষের মা কমলি রবিদাস। ছেলের জন্মের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে হারান তিনি। এরপর পড়েন অথৈ সাগরে। অভাব-অনটন ঘিরে ধরে তাকে। মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানে কাজ করে তখন তিনি দৈনিক মজুরি পেতেন ১৮ টাকা।

সন্তোষ বলেন, 'সেসময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা বাগানে যেতেন। ২০০৭ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন মায়ের মজুরি ছিল ৮৮ টাকা।'

'একদিন মা বললেন- বাজারে গিয়ে ৫ কেজি চাল নিয়ে আয়। সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় পেঁচালেন। আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন।'

'দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না। তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা ২ দিন পার করেছিলাম। তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই রেডি করে দিতেন বাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না।'

পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে ৫ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পান সন্তোষ। তখন মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে সন্তোষকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন তিনি।

২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হন সন্তোষ। তখন মা ১০২ টাকা মজুরি পেতেন। সেসময় তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সন্তোষের ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস। মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন সন্তোষের এইচএসসির রেজিস্ট্রেশনের কাজ চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ছেলেকে বলেছিলেন, 'কেউ ধার দেয়নি রে বাপ'। কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলেন সন্তোষ।

এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার ঋণ নিলেন ব্যাংক থেকে। ঋণের কিস্তি পরিশোধে মা তখন বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা। তিনি জানতেন ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়ে দিয়েছেন।

সন্তোষ বলেন, 'এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই। এ খবর পেয়ে মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে। পরে এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করলেন।'

'বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। থাকতাম জগন্নাথ হলে। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও খেতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনো একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।'

'২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা-শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে।'

'মা এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতা তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান। এই মজুরিতে কীভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার? আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না।'

সন্তোষ আবারও বলেন, 'মা বলেছেন, বাপ- তোর চাকরি হলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেবো। আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায়।'

Comments

The Daily Star  | English

Mohakhali blockade halts Dhaka's rail link

Students of Titumir College waged protest to press home their demand for upgradation of their institution as a university

47m ago