‘যার কাছে দাবি করছি তিনিই চান আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হোক’

‘যার কাছে দাবি করছি তিনিই চান আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হোক’
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’র সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ‘আদিবাসী নারী পরিষদ’ এর সভাপতি বাসন্ত্রী মুর্মু প্রমুখ। ছবি: স্টার

'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক দল ক্ষমতায় এসেছে। যারা ক্ষমতায় আসছে, তাদের পরিচয়টা আমাদের জানতে হবে। বিভিন্ন জায়গাতেই আমরা দাবি উত্থাপন করি। যার কাছে দাবি করছি, তিনি নিজেই চান আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাক। তাহলে তিনি কীভাবে আমাকে অধিকার দেবেন?'

'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' উপলক্ষে আজ বুধবার আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন 'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম'র সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।

তিনি বলেন, 'প্রতি বছর আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় জাতিসংঘ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু, জাতিসংঘের নির্দেশে তো বাংলাদেশ চলে না। আরও অনেক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আছে, তারা জাতিসংঘের কথায় কাজ করে না। ততটুকুই করে, যতটুকুতে সংশ্লিষ্টদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। এ বছর আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ নির্ধারিত যে প্রতিপাদ্য বিষয়, তা বাংলাদেশ সরকার কতটা পালন করবে, তা দেশকে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের ওপর নির্ভর করে।'

এ বছর জাতিসংঘ ঘোষিত 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে'র প্রতিপাদ্য বিষয় 'ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা'। এই প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, 'নারীর অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে তথা বিশ্বে নারীকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবা যায় না, এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নারীকে বাদ দিয়ে ভাবা যায় না। সেই নারীর অবস্থান কোথায়? সামাজিকভাবে তার অবস্থায় কোথায়, আর রাষ্ট্রীয়ভাবে তার অবস্থান কোথায়? উভয়ক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান কি সম্মানজনক? আসলে না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ভেদাভেদ-মুক্ত না, বৈষম্যমুক্ত না। সেখানে নারী হিসেবে, সমাজের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবনচক্র আতুর ঘর, শয়ন ঘর ও রান্না ঘরে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ, সভ্যতা বিকাশের গোড়াপত্তন ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অবদান রেখেছে নারী।'

সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনের উল্ল্যেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য কী? আমাদের দেশে আজ যদি গণমানুষের জন্য গণমুখী শাসন ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আদিবাসী কথাটি সাংবিধানিক না বলে মন্ত্রণালয়ের ওপর সরকারের যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলো সেটা হতো না। আদিবাসী কথাটি যেন ব্যবহার করা না হয়, তার জন্য প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এই সরকার একটি শব্দের জন্য তারা পুরো প্রশাসনকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। তাহলে সেই সরকারকে আমরা কীভাবে চিহ্নিত করব? সেই সরকার কি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিমুক্ত, গণমুখী বা প্রগতিশীল? তথাকথিত একটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যে সরকার সাম্প্রদায়িক, যে সরকার অগণতান্ত্রিক, যে সরকার প্রগতি বিরোধী, যে সরকার ধনী-গরিবের বৈষম্যের স্বীকৃতি দেয়, মানুষকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে, সেই সরকার আমাদের জন্য কী করতে পারে, তা বোঝাই যায়।'

সন্তু লারমা বলেন, 'অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এই বাংলাদেশের জন্ম দেওয়ার নেতৃত্বে কারা ছিল, সেই বিষয়টির মীমাংসা না করে বাংলাদেশের নাগরিক যারা আছি, তারা নানা কথা বলি। আদিবাসীদের পরিচয়ের বিষয় নিয়ে কথা হলো না। আমার পরিচয় আমি দিতে চাই। এটা আমার অধিকার। আমি কী নামে পরিচিত হব, সেটা আমার অধিকার। কিন্তু, সরকার সেটা দেয়নি, সেই স্বীকৃতি দিচ্ছে না।'

'১৯৭২ সালের সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বসবাসকারী সবাই বাঙালি বলে পরিচিত হবে। তাহলে আমাদের পরিচয় তো ওখানেই শেষ করে দেওয়া হলো। এরপর অনেক সংশোধনী হয়েছে, নানাভাবে এটা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ, সংশোধনীতে উপজাতি বলা আছে, সম্প্রদায় বলা আছে, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বলা আছে, নৃগোষ্ঠী বলা আছে। আমাকে বলতে বলা হচ্ছে, আমার পরিচয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এটা তো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে হতে পারে না,' যোগ করেন তিনি।

নারীদের শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনীতিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'আজকে যারা ক্ষমতাসীন, তারা কি আসলেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে? পারে না। তারা তাদের দলের প্রতিনিধিত্ব করে, একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। এ দেশে যারা ধনী, তারাই নির্বাচন করে, সংসদে যায়। আসলে তারা সমাজের গরিব, নিরীহ, মেহেনতি জনতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা কেবল ধনীদের প্রতিনিধিত্ব করে। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে, রাজনীতি করতে হবে। সেই রাজনীতি করতে হবে যে রাজনীতি শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।'

'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' এর সহযোগিতায় 'বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক' আয়োজিত সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, 'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, 'আদিবাসী নারী পরিষদ' এর সভাপতি বাসন্ত্রী মুর্মু প্রমুখ।

'বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক' এর আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রংয়ের সভাপতিত্বে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন 'বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম'র সহসভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা।

সেমিনারে অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, 'আদিবাসীদের সমস্যা কি শুধু আদিবাসীরাই দেখবে? অ্যাঞ্জেলস ভারত বর্ষের আন্দোলনের বিষয়ে বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির উচিত ভারতবর্ষের আন্দোলনকে সমর্থন করা। কারণ, ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণি যদি মুক্ত হতে না পারে, তাহলে ইংল্যান্ডের শ্রমিকরাও কোনোদিন মুক্ত হতে পারবে না। ঠিক একই কারণে আদিবাসীদের আন্দোলনে বাঙালিদের অংশ নেওয়া উচিত।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি দেশ ভালোভাবে চলছে নাকি খারাপভাবে চলছে তা পরিমামের মাপকাঠি হচ্ছে, সেই দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা। তারা যদি ভালো থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশের সবশ্রেণির মানুষ ভালো আছে।'

প্রতিপাদ্য বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক রুবায়েত বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যটা বেগম রোকেয়ার। সেটা এখনো আছে, রোকেয়া হলের ভেতরে অবরুদ্ধ। অথচ, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়াউর রহমান হল, এফ রহমান হলের সামনে তাদের ভাস্কর্য রাখা হয়েছে। বেগম রোকেয়াকে এখনো আটকে রাখা হয়েছে তার বিখ্যাত বইয়ের মতো। দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এভাবেই নারীদের রাখা হয়েছে।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ বলেন, 'এ দেশের গাড়ো, চাকমা, মারমাসহ সবাই মিলে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সেই দেশ শুধু বাঙালিদের হতে পারে না। কিন্তু আমরা সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের সেই অধিকার দিতে পারিনি। অনেক আন্দোলনের পর সংবিধান বদলেও সেখানে তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হচ্ছে, উপজাতি বলা হচ্ছে, কিন্তু আদিবাসী বলা হচ্ছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেড ইন্ডিয়ানদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে ন্যাটিভ আমেরিকান বলে মেনে নিয়েছে। তাহলে আমরা কেন পারি না?'

'আদিবাসীদের ভাষা যদি হারিয়ে যায়, সেটা কি শুধু তাদের ক্ষতি? বাংলাদেশকে বৈচিত্রময় দেশ হবে, আমরা বিশ্ব দরবারে অহংকার করি। যদি আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি হারিয়ে যায়, তাহলে আমরা সেই অহংকার করতে পারব না। ক্ষতিটা হবে বাংলাদেশের,' যোগ করেন তিনি।

সেমিনারে উন্মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা তাদের নানা ধরনের প্রতিকূলতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

তাদের মধ্যে পামডোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হৈমন্ত্রী সরকার বলেন, 'সারা দেশের আদিবাসীরাই খারাপ আছেন। তবে, সমতলের আদিবাসীদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।'

নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি দেখেছি আদিবাসী মেয়েরা হিজাব, বোরকা পরে বের হয় বিভিন্ন উপদ্রব থেকে বাঁচতে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago