‘আদিবাসীদের চিরতরে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে’
'বাংলাদেশের ৩০ লাখ আদিবাসীর সঙ্গে সরকার শুধুই প্রতারণা করে চলেছে। যে প্রান্তেই আদিবাসীদের বসতি রয়েছে, সেখানে দেখলেই এই বাস্তবতা আমরা প্রত্যক্ষ করি।'
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস' উপলক্ষে 'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
তিনি বলেন, '১৯৭২ সালে এ দেশের সরকার আদিবাসীদের পরিচয় হরণ করে নিয়েছিল সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে। সেই সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সব নাগরিকের পরিচয় হবে বাঙালি। তারপরে আমরা দেখি, আদিবাসীদের চিরতরে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র একটার পর একটা চলছে। আজকের শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রশ্ন, আপনারা বিগত ৫০ বছর ধরে আদিবাসীদের চিরতরে বিলুপ্ত করার যে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, সেই কাজ কি এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বড় প্রশ্ন, আপনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে চুক্তি সই করেছিলেন। সেই চুক্তির ২৫ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে আপনারা টানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। পার্বত্য অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় যে লড়াই-সংগ্রাম, তাতে আপনার সরকার কতটুকু সম্মান দিয়েছে, কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?'
তিনি আরও বলেন, 'পার্বত্য অঞ্চলের বুকে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক শাসন, নানান নীতি নানানভাবে চলছে। আজও পার্বত্য অঞ্চলে যে সামরিক শাসন, তথা পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের অস্তিত্ব কৌশলে বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্র তা অব্যাহতভাবে চলছে। তার সঙ্গে সমতলের আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংরক্ষণে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়ে আছে সেগুলো সমাধানে সরকার কোনোভাবেই আন্তরিক নয়। বিগত সময়ে আদিবাসীদের ওপর চলেছে শুধুই দমন, পীড়ন, নির্যাতন, নিপীড়ন। ভূমি হারানোর যন্ত্রণা যার আছে, যে পরিবার স্বজন হারিয়েছে, নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে, সেই পরিবার ভালোভাবে এই যন্ত্রণা বোঝে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের যে বাস্তবতা, সেখানে এমন একটি পরিবার নেই যে পরিবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি, যে পরিবার বঞ্চিত হয়নি, শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়নি।'
পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে সন্তু লারমা বলেন, 'আজ পার্বত্য অঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই উন্নয়ন কার স্বার্থে? একটু গভীরভাবে ভাবলেই তা স্পষ্ট হয়। আজ পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তাঘাট করা হচ্ছে পর্যটনের জন্য, পাহাড়িদের জন্য নয়।'
এ বছর জাতিসংঘ ঘোষিত 'আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে'র প্রতিপাদ্য বিষয় 'ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা'। প্রতিপাদ্য উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, 'গোটা বাংলাদেশের আদিবাসী নারী সমাজ নানাভাবে শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনে, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিগ্রস্থ কার্যক্রমে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত।'
'আমরা প্রত্যক্ষ করি, সরকার শুধু আদিবাসীদের বিলুপ্ত করে নয়, আদিবাসীদের সমস্ত কিছু হরণ করে, তাদেরকে সর্বস্বান্ত করার মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব চিরতরে বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করতে চায়,' যোগ করেন তিনি।
আজ সকাল ১১টায় বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে সমাবেশের উদ্বোধন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।
মামুনুর রশীদ বলেন, 'প্রতি বছর ৯ আগস্ট ঘুরে আসে। সেই কবে শান্তি চুক্তি হয়েছে, তারপর এতগুলো বছর পার হয়ে গেল। অথচ, এর যে পরিণতি দেখতে চেয়েছিলাম সেটা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলে আমাদের যে আদিবাসী বন্ধুদের হত্যা করা হয়েছে, তারও কোনো সমাধান বা বিচার কেউ পায়নি।'
তিনি আরও বলেন, '১৯৭১ সালে আমরা যখন বিচার পাইনি, ভোটে নির্বাচিত হয়েও ক্ষমতায় যেতে পারিনি, তখন কাঁধে রাইফেল তুলে নিয়েছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যখন সমাধান পাননি, তখন রাইফেল কাঁধে নিয়েছিল। এরপর একটা সমাধানের পথ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম।'
'এ দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা কমছে বলে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলব, তাদের সংখ্যা কমছে না। তারা লুণ্ঠিত হয়েছে এবং এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
সমাবেশের শুরুতে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের স্বাগত বক্তব্যের পর জাতিসংঘ মহাসচিবের লিখিত বাণী পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস।
সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) শরীফ জামিল প্রমুখ।
সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত চিঠিতে 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশনার নিন্দা জানান বক্তাদের প্রত্যেকেই।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, 'বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ—এটা বলতে আমরা খুব পছন্দ করি, সব জায়গায় প্রচার করি। কিন্তু সেই বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য আমরা কী করি তা চিন্তা করা দরকার। আদিবাসীরা বলছেন, প্রত্যেকটি জায়গায় তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাদের অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এটা কী আমাদের শোভা পায়? আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম একটি বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে। অথচ, আজ দেশে প্রতিটি স্তরে বৈষম্য।'
তিনি আরও বলেন, 'সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি জঘন্যতম হামলা হয়েছে আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে এবং এটা ধারাবাহিকভাবে চলছে। একটি স্বাধীন দেশে এটা কেন হবে? আমাদের সংবিধান পরিষ্কার বলে দিয়েছে, সকলের অধিকার সমান এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকলের নিরাপত্তা রক্ষা করা। সমতল ও পাহাড়ে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘন হচ্ছে।'
'রাষ্ট্রের অবশ্যই দায়িত্ব আছে। সেইসঙ্গে আমরা যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আছি তারাও কেন তাদের পাশে দাঁড়াই না, তাদের সঙ্গে কথা বলি না। আমরা সবাই একসঙ্গে সবার অধিকার রক্ষা করব। নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে ঘরে এবং বাইরে। আজকের যে প্রতিপাদ্য বিষয় তা দীর্ঘদিন পরে হলেও সামনে এসেছে। আমাদের নারী, যারা গৃহস্থালির কাজ করেন তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। আমরা অনেক দিন ধরে এর জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ, তারাই সমাজকে ধরে রাখে, গ্রামীণ অর্থনীতিও তাদের ওপর নির্ভর করে,' যোগ করেন তিনি।
'জাতীয় আদিবাসী নারী পরিষদে'র সভাপতি বাসন্তী মুর্মু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ২ জন সংসদ সদস্য মনোনয়নের দাবি জানিয়ে বলেন, 'ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন একজন সাঁওতাল নারী। আর বাংলাদেশে সংসদে বসে আমাদের নির্যাতনের কথা বলবে এমন কেউ নেই।'
নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশি কবির বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন এসেছে যে, আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এই ধরণের বক্তব্য মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এটা তাদের জানা দরকার, ইতিহাস জানা দরকার। যখনই চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, যখনই বাধা-নিষেধ এসেছে, তখনই শক্তভাবে আমরা প্রতিবাদ করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'উন্নয়নের নামে ব্যক্তিগতভাবে একটি শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থে মুনাফা লাখ করার জন্য আদিবাসীদের জমি দখল করে সেখানে বিভিন্ন প্রকল্প করা হচ্ছে। শুধু আদিবাসী না, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের জায়গা নেওয়া হয়। এটা বন্ধ করতেই হবে।'
বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'তারা মানুষকে গণমানুষ মনে করেন, নাগরিক মনে করেন না। আপনারা (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) যেমন আপনাদের অধিকার আইনগতভাবে চর্চা করতে পারছেন না, তেমনি আমরাও নিছক গণমানুষ হয়ে বসে আছি। আমরাও আমাদের অনেক অধিকার চর্চা করতে পারছি না। আমাদের অনেক বড় একটি অধিকার হচ্ছে ভোটাধিকার, সেটাও চর্চা করতে পারি না।'
তিনি আরও বলেন, 'জাতিগত দাবি আদায়ের জন্য কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। তার মধ্যে রয়েছে, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের আলাদা করে উল্লেখ না করে সবাইকে এক প্লাটফর্মে থাকতে হবে, সকল আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে, দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না।'
Comments