আঙুলের ছাপ না মেলায় ফিরছেন ভোটাররা, গোপনকক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তারা

'ভ্যাসলিন লাগাইলাম, এখন কয় বালু দিয়া আঙুল ঘষতে, ধুর ভোটই দিমু না, তাই চইলা যাইতাছি'
নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে এসে ভোটারদের অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলার অভিযোগ উঠেছে। ছবিটি বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব হোসনে আরা। কয়েরবার চেষ্টা করেও তার আঙুলের ছাপ না মেলায়, তাকে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়। অন্তত ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর মিলিয়ে ভোটার তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়। কিন্তু আঙুলের ছাপ মেলাতে আবারও চেষ্টা করা হলেও মেলেনি। পরে বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়েই চলে যান তিনি।

আজ বুধবার দুপুরে পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ চিত্র দেখা যায়।

এ কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফজর আলী বলেন, 'কয়েকবার চেষ্টা করেও তার (হোসনে আরা) আঙুলের ছাপ মেলাতে পারিনি। কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অনুযায়ী তিনি এ কেন্দ্রেরই ভোটার।'

ভোট দিতে না পেরে বিরক্ত হোসনে আরা বলেন, 'কতক্ষণ বইসা ছিলাম, ভ্যাসলিন লাগাইলাম, এখন কয় বালু দিয়া আঙুল ঘষতে। ধুর ভোটই দিমু না, তাই চইলা যাইতাছি।'

এই বলে বাড়ির পথে হাঁটা ধরেন এ বৃদ্ধা।

একই কেন্দ্রে আঙুলের ছাপ মেলেনি ৪৫ বছর বয়সী হালিমারও। দায়িত্বরত নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, হালিমার আঙুলে মেহেদি লাগানো থাকায় ছাপ মিলছে না। পেট্রোলিয়াম জেলি লাগানোর পর কয়েকবার তারা চেষ্টা করেও ছাপ মেলেনি।

ভোট দিতে না পেরে কেন্দ্র থেকে ফিরে যেতে দেখা যায় ২৬ বছর বয়সী মো. হৃদয়কেও। এ যুবক বলেন, 'চার-পাঁচবার চেষ্টা করেও ছাপ মেলেনি। আমাকে বলছে বাসা থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র আনার জন্য। দেখি, বাসায় গিয়ে কার্ড পেলে আবার ভোট দিতে আসব।'

'এত টাকা দিয়া মেশিন বানাইয়া যদি ছাপই না মেলে, তাইলে লাভ কী হলো?', যোগ করেন এ ভোটার।

সকালে হাটাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও একাধিক ভোটারকে এভাবে ফিরে যেতে দেখা যায়।

বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, 'কয়েকজনের আঙুলের ছাপ মিলছে না। তাদের ছাপ মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। না মিললে পরবর্তীতে কী করা যায় দেখছি।'

গোপন কক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তারা

কাঞ্চন পৌরসভা নির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কয়েক জনকে গোপনকক্ষে দেখা গেছে।

পৌরসভার অন্তত তিনটি কেন্দ্রে গোপনকক্ষে ভোটারদের সঙ্গে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারদের দেখা গেছে। তারা ভোটারদের ইভিএমে ভোট দিতে গোপনকক্ষে প্রবেশ করে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ভোটারের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ভোট দেওয়ার সময় গোপন কক্ষে কেউ থাকতে পারবেন না।

১ নম্বর ওয়ার্ডের তারৈল বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত থাকা অবস্থায় গোপন কক্ষে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে দেখা যায়। তিনি ভোটারকে ইভিএমে ভোট দেবার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সেখানে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ভোটারের সাথে গোপনকক্ষে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আপনি এখানে পাঁচ মিনিট দাঁড়ান, দেখবেন মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বারবার বুঝিয়ে দেয়ার পরেও তারা ঠিকমতো ভোট দিতে পারছে না। তাই তাদের দেখিয়ে দিচ্ছিলাম।'

জানতে চাইলে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম সিদ্দিকী বলেন, 'গোপন কক্ষে কেউ থাকতে পারবেন না। যদি যান্ত্রিক কোনো ত্রুটির ব্যাপার থাকে সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। কিন্তু ভোট দেবার সময় কেউ থাকতে পারবেন না। এমনটা হবার কথা নয়।'

গোপনকক্ষে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার ছবি দেখালে আশরাফুল আলম বলেন, 'এমনটা হয়ে থাকলে ওই কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছেন। এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা হবে।'

যদিও কেন্দ্রটিতে থাকা প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের ভাষ্য, সকাল থেকেই এই প্রক্রিয়ায় ভোটগ্রহণ চলছে। তারা দু-একবার এ ব্যাপারে কর্মকর্তাদের নিষেধও করেছেন কিন্তু কেউ শোনেননি।

একই চিত্র দেখা যায় কেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রতিটি ভোটকক্ষে। পোলিং কর্মকর্তারা গোপনকক্ষে ঢুকে ভোটারদের ভোট প্রদানে সহায়তা করছিলেন।

বেলা ২টার দিকে তারৈল বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটিতে ভোটারের সাথে গোপনকক্ষে অন্য ব্যক্তি উপস্থিত থেকে পছন্দের বাইরে অন্য প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ পেয়ে পরিদর্শনে আসেন কাউন্সিলর প্রার্থী পনির হোসেন।

তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগও জানান। এ সময় এ প্রার্থীর সাথে কেন্দ্রে উপস্থিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে উচ্চবাচ্যও হয়।

পনির বলেন, 'গোপন বুথে নাকি নির্বাচন কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্টরা ঢুকে ভোটারদের পছন্দের মার্কার বাইরে অন্য মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করছেন। এ অভিযোগ দিতে গেলে আমার সাথে ম্যাজিস্ট্রেট খারাপ ব্যবহার করে কেন্দ্র থেকে চলে যেতে বলেন। আমি প্রার্থী, অভিযোগ পেলে তো জানাবোই। ভোটকক্ষে তো কেউ থাকতে পারবে না, ভোটার ছাড়া।'

বিষয়টি নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। এমনটা হবার কথা নয়। সকল কর্মকর্তাদের এমন কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু ভোটাররা অনেকেই ইভিএমে স্বতঃস্ফূর্ত না হওয়াতে কোনো কর্মকর্তা হয়তো সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এটাও না করতে বলা হয়েছে।'

Comments