রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য চুরি, ‘মূলহোতা’ শাহেদের কোটি টাকার বাড়ি

এ চক্রের মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। ছবি: সংগৃহীত

রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য চুরির সংঘবদ্ধ চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

দেড় যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সময় প্রায় ২ হাজারেরও বেশি কাভার্ড ভ্যান থেকে কয়েকশ কোটি টাকার গার্মেন্টস পণ্য চুরি করেছেন তারা।

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

র‍্যাব জানায়, এ চক্রের মূলহোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সে অনুযায়ী বন্দর থেকে চালান বহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে। তবে গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে একটি ভিডিও ফুটেজ পান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ।

সেখানে দেখা যায় যে, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরবর্তীতে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে।

এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে।

গত রাতে র‍্যাব-৪ এর পৃথক অভিযানে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে এ চক্রের ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এসময় ব্রাজিলে রপ্তানিকৃত চুরি যাওয়া পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত ১টি কাভার্ড ভ্যান উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের দাবি, শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি চক্রের মূলহোতা। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, কুলিসহ একদল লেবার।

'প্রতিটি চুরির ঘটনা সংঘটনের আগে ড্রাইভারদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানিকৃত গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাইকৃত পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হতো। চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য যদি ১২-১৫ লাখ টাকা হতো তাহলেই শুধু তারা চুরি করত,' বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন।

৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরানো হয়

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গার্মেন্ট থেকে রপ্তানির জন্য পণ্য রওনা হওয়ার পর চক্রটি চুরির কাজ শুরু করে। যানবাহন থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে আবার প্যাকেজিংয়ের পর বন্দরের পাঠিয়ে দেয় তারা। 

ব্রাজিলের চালানটি চুরির সময় শাহেদের নির্দেশে ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির মূল প্লট বাস্তবায়ন করে কাওছার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে ড্রাইভার ও হেলপার ২৯ অক্টোবর রাতে ডেমরা থানাধীন মিরপাড়ায় আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে কাভার্ড ভ্যানটি পার্ক করে। সেখানে পণ্য চুরির ঘটনাটি ঘটায়। আগে থেকে আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে অপেক্ষারত কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে শেলটারদাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৭ জন লেবার নিয়ে মূলহোতা কাওছার প্রত্যেকটি কার্টন থেকে ৩০-৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়।

এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুম ওরফে মাসুদকে রাজধানীর ডেমরা থেকে গত ২৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। অপর একটি গার্মেন্টের পণ্য চুরির ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। বর্তমানে আসামিরা জেল হাজতে রয়েছেন।

শাহেদের ২০ কোটি টাকার বাড়ি, মাছের খামার

র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেপ্তার শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ২টি ট্রাক কিনে লোকাল ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪টি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করেন তিনি। পরে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সহায়তায় গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রমের জন্য একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র গড়ে তোলেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিজে উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে যান।

শাহেদ ২০১৮ সাল পরবর্তী সময়ে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। প্রত্যেকটি চুরির ঘটনায় আয়কৃত অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেতেন তিনি। শাহেদ গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে এই গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে।

মৌলভীবাজার শহরে শাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে বলে জানায় র‌্যাব। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির ওপরে মাছের খামারসহ হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে দুটি। বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ চোর চক্রে মোট ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে এবং যার অধিকাংশ মামলায় তিনি কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচারকাজ চলছে।

গার্মেন্টস পণ্য চুরি করছে কয়েকটি চক্র

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, 'গত কয়েকবছর ধরে কয়েকটি চক্র বেপরোয়াভাবে গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে তা চোরাইপথে বিক্রি করছে। এই চুরির ব্যাপারটি জানা যায় গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির শেষ ধাপে যখন বায়ার বা ক্রেতা তার দেশে পণ্য গ্রহণ করে। ফলে ক্রেতারা চাহিদাকৃত পণ্য না পেয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে খোয়া যাওয়া পণ্যের দামের দ্বিগুণ বা তিন গুণ জরিমানা করে থাকে। পাশাপাশি ক্রয়াদেশ বাতিলসহ তাদের পরিচিত বায়ারদেরকেও বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে নিরুৎসাহিত করে। যার ফলে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এই চুরির ঘটনা রোধে ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এর একটি যৌথ প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট গার্মেন্টস পণ্য চুরি রোধে কার্যক্রম শুরু করে।

Comments

The Daily Star  | English

Drone crash triggers commotion on Ijtema ground, 40 injured

It was not immediately known how the drone fell or who it belonged to

42m ago