সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন আর কতবার পেছাবে

১০ বছরেরও বেশি সময় পেরোলেও এখনো শেষ হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। এ পর্যন্ত ৯১ বার পিছিয়েছে এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়।

১০ বছরেরও বেশি সময় পেরোলেও এখনো শেষ হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। এ পর্যন্ত ৯১ বার পিছিয়েছে এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়।

সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন কেন শুধু পেছায়, দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রুনির ভাই নওশের আলম রোমান এবং র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈনের সঙ্গে।

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, 'জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন কেন শুধু পেছায়, একই প্রশ্ন আমারও। কেন এখনো এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না, সেটা নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমাদেরও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। কেন এটার বিচার হচ্ছে না, আমরা এটা জানতে চাই। আমরা চাই বিষয়টির ফয়সালা হওয়া দরকার।'

'এখনো কেন এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না, আমরা সেটার ব্যাখ্যা চাই। অনন্তকাল তো আর এটা এভাবে পড়ে থাকতে পারে না। আমি মনে করি এটা বিচারহীনতারই একটি উদাহরণ।'

'সাগর-রুনির ছেলে এখন বড় হয়েছে। সে তো তার বাবা-মার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবে। সাগরের মা জীবিত আছেন। তিনিও ছেলে-ছেলের বউয়ের হত্যার বিচার চাইবেন। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব এ হত্যাকাণ্ডের একটা সুরাহা হোক', বলেন তিনি।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'হত্যা মামলার জন্য আলাদা করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচারটা যদি সেই দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা যেত। সেখানে নির্ধারিত শিডিউল দেওয়া আছে যে কোন কোন ধারায় অভিযোগটা আসবে। এখন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর। তদন্ত প্রতিবেদন কত দিনের মধ্যে দিতে হবে, সেটারও নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। ৩৬৩ দিনের একটা সময়সীমা আছে। কিন্তু, ১০ বা ২০ বছরেও বিচার হয় না, এরকম ঘটনা আমাদের দেশে প্রচুর।'

তদন্তকারী সংস্থার গাফিলতির কারণেই এখন পর্যন্ত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, 'এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে র‌্যাবকে। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে র‌্যাবের তদন্ত করার কোনো এখতিয়ারই নেই। সিআরপিসি সংশোধন না করেই এরকম একটা বাহিনীকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে যাদের গঠন প্রক্রিয়া নিয়েই সুপ্রিম কোর্টে মামলা রয়েছে যে, তাদের গঠন প্রক্রিয়াটাই অবৈধ। এটা তদন্ত করতে দেওয়া উচিত ছিল পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনীকে। তবে, তাদেরকে দিলেও যে যথাসময়ে সেটা হবে, তা বলা মুশকিল। কারণ এখানে একটা পাওয়ার গেম আছে।'

'সবমিলিয়ে তদন্তকারী সংস্থার ব্যর্থতা ও সামগ্রিক সমন্বয়ের যে অভাব আছে, এটা সেটারই প্রমাণ। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে আমাদের আইন মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে না। এমনকি, মানুষ মারা যাওয়ার পর বিচারটাও আমরা পাচ্ছি না', যোগ করেন তিনি।

এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়াটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, 'তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ৯১ বার পেছানো থেকেই বোঝা যায় যে আইনের বিচার কতটুকু পাওয়া যায়। বিপরীতে যদি ক্ষমতাধর কেউ থাকে, তাহলে যে বিচার পাওয়া যায় না, এটা সেটারই বহিঃপ্রকাশ। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ৯২ বারের মতো সময় নিতে হলো। বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। এটা এমন কোনো বিশাল বিষয় না যে এটা তদন্ত করতে ৯২ বারের মতো সময় নিতে হবে। আমাদের পুলিশের সক্ষমতা আছে। আমাদের বিশেষায়িত বাহিনী আছে, পিবিআই আছে যারা কেবল তদন্ত করে। তাদের কাছে যেতে পারত।'

'এখন বিভিন্ন উছিলায় যদি সময় নেওয়াটাই কারণ হয়, তাহলে সেটা আলাদা বিষয়। এই যে বার বার সময় নেওয়া হচ্ছে, আদালতও এর জন্য কোনো ব্যাখ্যা চাচ্ছেন না। কিন্তু, উচিত ছিল তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া যে কেন তিনি বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু, কিছু হলো না। আদালতও সময় দিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং এটা বোঝা যায় যে, এখানে পাওয়ার গেম আছে বলেই বিষয়টি ঝুলে আছে', যোগ করেন তিনি।

সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলেই এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন শুধু পেছাচ্ছে বলে মনে করছেন নওশের আলম রোমান। তিনি বলেন, 'তারা এই হত্যা মামলার বিচার চায় না। বিচারবিভাগ, তদন্তকারী সংস্থা— সবাই সমন্বিতভাবেই এটা করছে। শুরু থেকেই ধামাচাপা দেওয়ার যে কথাটা আমরা বলেছিলাম, সেটাই হয়েছে।'

'আমাদের জায়গা থেকে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। তবে, মনে করি এ হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হবে না। কিন্তু, সারা জীবনই বিচার চেয়ে যাব', যোগ করেন তিনি।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, 'ধাপে ধাপে প্রতিবারই আদালত আমাদেরকে কিছু বলেছেন। আমরা কিন্তু তদন্তের শেষ আপডেটটা দিচ্ছি। একেবারেই যে তদন্ত সম্পর্কে কিছু বলছি না, বিষয়টি তা নয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ আলামত যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠিয়েছি, সেগুলোর যে রিপোর্ট, সেখান থেকে যে তথ্য আমরা পেয়েছি, সেটা আদালতে উপস্থাপন করেছি। র‌্যাবের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনোভাবেই কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে দোষী সাব্যস্ত না হয়, তড়িঘড়ির কারণে যেন কোনো ভুল তদন্ত না হয়, যাতে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি ফেঁসে না যায়, এটাই আদালতে আমাদের পয়েন্ট অব অর্ডার ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আদালত আমাদেরকে এবারও সময়টা দিয়েছে।'

এই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখন তদন্তে অগ্রগতি কতটুকু? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'একটা পর্যায় পর্যন্ত অগ্রগতি ছিল। কিন্তু, একটা পর্যায়ে যেয়ে আসলে এখানে অনেক কিছু বিষয় আছে। যেমন: তাদের ছেলের বয়সের কারণে আমরা তার বক্তব্য নিতে পারিনি। সে তো ঘটনাস্থলে ছিল। তদন্তে যতটুকু আমাদের পক্ষে সম্ভব, আমরা অনেক তথ্যই সংগ্রহ করেছি। কিন্তু, হত্যাকাণ্ডের পর প্রাথমিকভাবে সিআইডি এটার তদন্ত করেছিল বেশ কয়েকদিন এবং যখন ঘটনা ঘটে, তখন বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখানে গিয়েছিল। যেজন্য ফরেনসিক জাতীয় যে বিষয়গুলো তদন্তের জন্য আমাদের আলামত হিসেবে প্রয়োজন হয়, সেখানে একটু শর্টকামিং ছিল। এগুলোর অনেক কিছুই তখন আমরা সংগ্রহ করতে পারি নাই বা অনেক আলামত তখন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এজন্যই মূলত প্রকৃত দোষীকে শনাক্ত করতে দেরি হচ্ছে। এটাই হচ্ছে মূল কারণ।'

বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাসায় হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। শেরেবাংলা নগর পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল র‌্যাবকে এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

Comments