অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2025/02/09/police_bangla.jpg)
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পরেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনের উদ্বেগ কাটেনি। দেশে অহরহই ঘটছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি হত্যাকাণ্ডও।
গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সন্দেহভাজন অপরাধী, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। এ কারণে নাগরিকদের বড় একটি অংশ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় দিনের আলোয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এতে সন্ধ্যার পর বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।
পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তানভীর ইসলাম জানান, চার মাসের ব্যবধানে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় দুইবার ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ার পর এ বছরের জানুয়ারিতে আবার একই ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আর রাতে নিরাপদ বোধ করি না। আর, মোহাম্মদপুরে কোনো সময়ই নিরাপদ নয়। ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করেও জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে।'
এর মধ্যেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর ও দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটল। এ সময় বিশাল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে সরকারি তথ্যেও। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে, ডাকাতির মামলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে পুলিশ। এই সময়ে ডাকাতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৪৩টি, যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৯৮টি।
এই চার মাসে ৫৫৩টি ডাকাতির ঘটনা, ৩০২টি অপহরণ এবং ৯৪৯টি চুরির ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ৩৯৬টি ডাকাতি, ১৬০টি অপহরণ এবং ৮৫৯টি চুরির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৪৭টি খুনের ঘটনা থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের ৯৫৬টি খুনের ঘটনা থেকে সামান্য কম।
গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণপিটুনিতে ২০২৪ সালে ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯৬ জন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫১।
এ সময়ের মধ্যে মাজার ও দরগায় বহু হামলার ঘটনা ঘটে। গত ২৩ জানুয়ারি, 'গ্লোবাল সুফি অর্গানাইজেশন' এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে যে গত ছয় মাসে দেশজুড়ে ৮০টিরও বেশি মাজার ও দরগায় উগ্রবাদী গোষ্ঠী হামলা চালিয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে ৪ আগস্ট থেকে কমপক্ষে এরকম ৪০টি স্থাপনায় ৪৪ বার হামলা হয়েছে।
তবে, এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে খুব কমই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গত বছর দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিছু শীর্ষ অপরাধীর মুক্তি এবং চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ার খবরে দেশবাসীর মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে বলে পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, গেল নভেম্বরে ঢাকার মগবাজারে একটি ভবন ভাঙতে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার কাজ চালিয়ে নিতে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের তিন লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে স্থানীয় এই সন্ত্রাসীদের।
জানুয়ারিতে, শীর্ষ অপরাধী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের ভাই ওয়াহেদুল হাসান দিপু এবং অন্য একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে এলিফ্যান্ট রোডে অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী সঞ্জিদুল হাসান ইমনের বাহিনী চাঁদাবাজির টাকা দিতে অস্বীকার করায় কুপিয়ে জখম করে বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় হেলালকে আসামি করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একই ধরনের অনেক ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয়ের আবহ বিরাজ করছে। ঠিকাদারদেরকে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। চাঁদা না দিলে হুমকি দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা এমনকি অপহরণের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি সিসিটিভি ফুটেজে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের কাছে সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখা যায়।
মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ এলাকার একজন গাড়ি ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার ৩০ বছরের ব্যবসায় আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। তার দাবি, ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসীরা তার কাছে থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'রায়েরবাজার ও বেড়িবাঁধ এলাকায় ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্যে মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং কাছের কবরস্থানের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমার নিজের চোখে কিছু ঘটনা দেখার পর, আমি এখন একা চলতে ভয় পাই।'
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর ছোটখাটো অপরাধীরাও। বিভিন্ন এলাকায় এমনকি দিনের আলোতেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের ঘোরাফেরা করে ছিনতাই করতে দেখা যাচ্ছে। এমন অনেক ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
মোহাম্মদপুরে গত মাসে ছিনতাইয়ের শিকার সাত জনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের ছয় জনই আইনি জটিলতার ভয়ে মামলা করেননি। মূল্যবান জিনিস হারানোর কথা উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তারা। ছিনতাইয়ের শিকার একজন কোনো অভিযোগই দায়ের করেননি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাঝে মনোবল কমে যাওয়ায় অপরাধীরা এই সময়টাকে নিজেদের জন্য অনুকূল মনে করছে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, অপরাধীদের অপরাধ করা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। কারণ তারা মনে করছে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। এতে করে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, 'শুরু থেকেই পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার অভাব ছিল। এখন তা আস্থার সংকটে পরিণত হয়েছে।'
বাহিনীর মধ্যে মনোবল হ্রাসের বিষয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি থানার ওসি বলেন, লোকজন এখন পুলিশকে ভয় পায় না। তুচ্ছ কারণেও তারা আমাদের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে। ফলে অনেক পুলিশ সদস্য টহলে যেতে চায় না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের একজন ট্রাফিক কনস্টেবল বলেন, ট্রাফিক আইনে মামলা দিতে গেলে প্রায়ই শুনতে হয় 'পুলিশের হাতে রক্তের দাগ'।
অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'জুলাই অভ্যুত্থান বা ৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যদের হতাহতের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। এটা আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রামে, একজন ওসিকে প্রকাশ্যে দিবালোকে শত শত লোকের সামনে মারধর করা হয়েছে। ঘটনাটির ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এটি হতাশাজনক।'
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান যে পুলিশ নিজেরাই এখনও নিরাপত্তাহীন বোধ করে। ফলে তারা টহল দিতে বা তল্লাশি চালাতে অনিচ্ছুক। অনেক কর্মকর্তাই তদন্ত বা গ্রেপ্তার অভিযানের ঝুঁকি নিতে চান না।পুলিশ কর্মকর্তারা জানান যে পুলিশ নিজেরাই এখনও নিরাপত্তাহীন বোধ করে। ফলে তারা টহল দিতে বা তল্লাশি চালাতে অনিচ্ছুক। অনেক কর্মকর্তাই তদন্ত বা গ্রেপ্তার অভিযানের ঝুঁকি নিতে চান না।
Comments