মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: রিপাবলিকান ‘হাতি’ ও ডেমোক্র্যাট ‘গাধার’ লড়াই

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এক অর্থে হাতি ও গাধার লড়াই। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এক অর্থে হাতি ও গাধার লড়াই। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। ১৮৫৩ সালের পর থেকে হোয়াইট হাউজে থাকা সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই এই দুই দল থেকে এসেছেন। এবারের নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে 'হাতি' ও 'গাধা' ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। কেন রিপাবলিকানদের প্রতীক হাতি? ডেমোক্র্যাটরাই বা কেন গাধাকে বেছে নিল দলের প্রতীক হিসেবে? এ প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের বেশ পেছনে যেতে হবে।

অ্যান্ড্রু 'জ্যাকঅ্যাস' জ্যাকসন

স্বাধীন দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সূচনালগ্নে এই দুই দলের একটিরও অস্তিত্ব ছিল না। জর্জ ওয়াশিংটনের দলের নাম ছিল ফেডেরালিস্ট পার্টি, আর টমাস জেফারসনের দলের নাম ছিল ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি।

উনিশ শতকের শুরুর দিকে ফেডেরালিস্ট পার্টি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চার প্রার্থী অংশ নেন। তাদের চারজনই ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান দলের সদস্য। সেখানে একজন প্রার্থী ছিলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। সাবেক এই মিলিটারি জেনারেলকে প্রথমে প্রার্থিতা দেওয়া হয়েছিল 'ডামি ক্যান্ডিডেট' হিসেবে—আরেকজন হেভিওয়েট বা মূল প্রার্থীর ভোট কমাবেন, এই আশায়।

টমাস ন্যাস্টের কার্টুন, গাধা চরিত্রে একজন ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেসম্যান। ছবি: আর্কাইভ।
টমাস ন্যাস্টের কার্টুন, গাধা চরিত্রে একজন ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেসম্যান। ছবি: আর্কাইভ।

কিন্তু বাকিদের অবাক করে দিয়ে জ্যাকসন সেই নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পান, প্রায় ৪২ শতাংশ। তবে কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় ধাপে যায় নির্বাচন। সেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থী জোট করে জ্যাকসনকে প্রেসিডেন্সি-বঞ্চিত করেন।

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টির জ্যাকসন ও তার সমর্থকরা ভালো ভাবে নেয়নি। তারা নতুন একটি রাজনৈতিক দলের ডাক দেয়, যার নাম হবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। সেই সময়কার মার্কিন রাজনীতির ভিত্তি ও ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিবিদদের মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন জ্যাকসন। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সমর্থিত গণমাধ্যম জ্যাকসনকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে শুরু করে। কিছু পত্রিকা তাকে 'জ্যাকঅ্যাস' বলে সম্বোধন করতে শুরু করে। রাজনৈতিক কার্টুনেও গাধার ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে জ্যাকসন ও তার অনুসারীদেরকে ইঙ্গিত করতে শুরু করে পত্রিকাগুলো।

জ্যাকসন এই সমালোচনাকে বরণ করে নেন। সেই 'অ্যাস' বা গাধাকেই বানান তার দলের প্রতীক। এই প্রতীক নিয়েই ১৮২৮ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হারান জ্যাকসন।

এই ছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির শুরু। প্রায় দুশ বছর পর, অ্যাস শব্দের অর্থ এবং গাধার ইংরেজি নাম বদলে গেলেও আজও সেই গাধাই এই দলের প্রতীক। এই প্রতীক নিয়েই নভেম্বরের নির্বাচনে লড়বেন কমলা হ্যারিস।

রিপাবলিকান হাতি

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উত্থানের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায় ডেমোক্র্যাটিক-রিপাবলিকান পার্টি। 'হুইগ পার্টি' নামের আরেকটি দল জাতীয় রাজনীতিতে তাদের জায়গা নেয়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বিরোধিতা করা এই দলের সদস্য ছিলেন আব্রাহাম লিংকন।

তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে যায় এই পার্টি। লিংকন এবং দাসপ্রথা-বিরোধী হুইগরা মিলে গড়েন নতুন একটি রাজনৈতিক দল—রিপাবলিকান পার্টি।

১৮৭৪ সালে হার্পার্স উইকলিতে প্রকাশিত টমাস ন্যাস্টের কার্টুন, যেখানে প্রথম রিপাবলিকান পার্টিকে হাতির রূপকে দেখানো হয়। ছবি: আর্কাইভ।
১৮৭৪ সালে হার্পার্স উইকলিতে প্রকাশিত টমাস ন্যাস্টের কার্টুন, যেখানে প্রথম রিপাবলিকান পার্টিকে হাতির রূপকে দেখানো হয়। ছবি: আর্কাইভ।

একই সময়ে হারপার্স উইকলি ম্যাগাজিন আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে রাজনৈতিক কার্টুনকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান টমাস ন্যাস্ট নামের এক কার্টুনিস্ট। সিএনএনের মতে, তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিখ্যাত রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট। তাকে মার্কিন কার্টুনের জনকও বলা হয়।

রাজনৈতিক-সামাজিক বিদ্রূপের স্বার্থে ন্যাস্ট তার কার্টুনে প্রচুর পশু-পাখি ব্যবহার করতেন। রাজনৈতিক কার্টুনগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের প্রায় সময় গাধা (দলের প্রতীক) হিসেবে দেখাতেন।

ষাটের দশকে লিংকনের ক্ষমতালাভ এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর রিপাবলিকান পার্টি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের ভোটার সংখ্যাও অনেক বেড়ে যায়।

১৯৭৪ সালে, মার্কিন রাজনীতিতে চলা অস্থিরতা ফুটিয়ে তুলতে একটি কার্টুন আঁকেন ন্যাস্ট। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে একটি সার্কাস হিসেবে দেখান তিনি। বিভিন্ন পশু-পাখিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। এই কার্টুনেই প্রথমবারের মতো রিপাবলিকান পার্টিকে একটি বিশাল হাতির রূপে দেখানো হয়, যার গায়ে লেখা 'রিপাবলিকান ভোট'।

ব্যক্তিগতভাবে একজন লিংকন সমর্থক, ন্যাস্ট পরবর্তীতে আরও অনেক কার্টুনে হাতিকে ব্যবহার করেন রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয়তা ও সুবিশাল ভোট ব্যাংককে বোঝাতে। ধারাবাহিকভাবে ন্যাস্টের কার্টুনে হাতির ব্যবহার একসময় বরণ করে নেয় রিপাবলিকান পার্টিও।

নরমান রকওয়েল জাদুঘরের বরাত দিয়ে রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিন জানায়, কার্টুনের মাধ্যমে ১৮৬৪ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ছয়টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছিলেন ন্যাস্ট। তাকে একসময় 'প্রেসিডেন্ট মেকার' খেতাবও দেওয়া হয়েছিল। রিপাবলিকান পার্টি কেন তার দেওয়া প্রতীক গ্রহণ করেছিল, সেটি এখান থেকেই ধারণা করা যায়।

২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

আর মাত্র কয়েকদিন পরই হাতি ও গাধার লড়াইয়ে মেতে উঠতে যাচ্ছে মার্কিনীরা। কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে আগাম ভোট শুরু হলেও পূর্ণ মাত্রার ভোটের দিন হিসেব নির্ধারণ হয়ে আছে নভেম্বরের ৫ তারিখ। বাংলাদেশের নির্বাচনের মতো 'মার্কা' নিয়ে খুব বেশি তোলপাড় না হলেও ব্যালটে সিল দেওয়ার সময় বেশিরভাগ ভোটার কমলা হ্যারিসের গাধা কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতিকেই বেছে নেবেন।

'গাধা' কমলা হ্যারিস ও 'হাতি' ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি/কোলাজ: রয়টার্স
'গাধা' কমলা হ্যারিস ও 'হাতি' ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি/কোলাজ: রয়টার্স

তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে গোটা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট? ডোনাল্ড ট্রাম্পের সগৌরবে ফিরে আসা, নাকি প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নারী হিসেবে কমলা হ্যারিসের জয়রথ? আর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মাঝে এ প্রশ্নের জবাব মিলবে। 

 

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

41m ago