এক দশকে দেশে ভুট্টা চাষ বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ

লালমনিরহাটে ভুট্টা শুকাচ্ছেন এক নারী। ছবি: স্টার

উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের ব্রান্ডিং ফসলে পরিণত হয়েছে ভুট্টা। বর্তমানে এই জেলায় ভুট্টার চাষ বেড়েছে। ভুট্টা এখন জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। ভুট্টা চাষে বদলে গেছে এ অঞ্চলের চাষিদের জীবন। হাসি ফুটেছে তাদের মুখে।

১৯৯১ সাল থেকে হাতীবান্ধার আবুল কাসেম ভুট্টা চাষ করছেন। ওই সময় ভুট্টার ফলন ছিল কম। তাই চাষিদের আগ্রহ ছিল না। তবে, গত ৩ দশকে সেখানকার দৃশ্য পাল্টে গেছে। ওই গ্রামের সব কৃষক এখন ভুট্টা চাষ করছেন।

আবুল কাসেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উন্নত বীজ পাওয়ায় আমরা প্রতি হেক্টর জমিতে ১০-১২ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন করছি। কৃষকরা ভুট্টা চাষকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, কারণ ভুট্টা চাষে খরচ কম কিন্তু লাভ বেশি। এ ফসল চাষে লাভ হচ্ছে ৩ গুণের বেশি। আমরা অন্য ফসল চাষ করে খুব একটা লাভ করতে পারি না।'

লালমনিরহাটে ভুট্টা হাতে কৃষক। ছবি: স্টার

দেশে ভুট্টার চাহিদা বাড়ায় শুধুমাত্র তার এলাকাতেই নয়, গত কয়েকবছর ধরে ভুট্টার চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে সারা দেশে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সারা দেশে ১৪ লাখ একরের বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। এক দশক আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮৭ হাজার একর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছিল। সেসময় বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়েছিল বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে জানানো হয়েছে।

লালমনিরহাটের চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুট্টার চাহিদা বেশি থাকে। বিশেষ করে পোল্ট্রি ফিড প্রস্তুতকারীরা ভুট্টা সংগ্রহের আগে অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকে। কৃষকরা বাড়ি থেকেই ন্যায্য দামে ভুট্টা বিক্রি করতে পারেন। এজন্য বাজারে যেতে হয় না। নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরের জমিতে ভুট্টা চাষ বেশ জনপ্রিয়। কারণ এ ধরনের জমিতে উৎপাদিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টার ফলন ভালো হয়। প্রতি হেক্টরে ১১ টন পর্যন্ত ভুট্টার ফলন পাওয়া যায়।

কৃষকরা জানান, আশানুরূপ লাভ হওয়ায় ধীরে ধীরে ভুট্টা চাষে আগ্রহ বেড়েছে। এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করতে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়, যা থেকে প্রায় ৩৫-৪৫ মণ ভুট্টা পাওয়া যায়। প্রতি মণ (৪০ কেজি) ভুট্টা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এতে কমপক্ষে ২৩ হাজার টাকা লাভ হয়। এ ছাড়াও, ভুট্টা চাষে ঝুঁকি কম থাকে ও বছরে দুবার চাষ করা হয়।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এতে ভুট্টা উৎপন্ন হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। গেল অর্থ বছর ২০২১-২২ অর্থ বছরে ভুট্টা চাষ হয়েছিল ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে। আর ভুট্টা উৎপন্ন হয়েছিল ৪ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন। তার আগের অর্থ বছরে ৩৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে ভুট্টা উৎপন্ন হয়েছিল ৩ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। লালমনিরহাট জেলায় প্রায় ৫০ হাজার কৃষক ভুট্টা চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন।

বাংলাদেশ মেইজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মিজানুর হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয়দের মাঝে ভুট্টা শস্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এটি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়তা করেছে। কিন্তু ভুট্টার চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও দেশীয় চাহিদার প্রায় ২০-৩০ শতাংশ এখনো আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। দেশে ক্রমবর্ধমান পোল্ট্রি ফিড এবং বেকারি কোম্পানির কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৫৫-৬০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে। সুতরাং, আমাদের দেশের কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুট্টা অবদান রাখছে।'

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর ভুট্টার চাষ প্রায় ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। ভুট্টা দেশের কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ভুট্টা চাষে কৃষক পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছর পর আমাদের ভুট্টা আমদানি করতে হবে না।'

ভুট্টা পরিষ্কারের কাজ করছেন কয়েকজন নারী। ছবিটি লালমনিরহাট থেকে তোলা। ছবি: স্টার

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর গ্রামের কৃষক সুপেন চন্দ্র দাস বলেন, 'ভুট্টা চাষে কম বিনিয়োগ ও কম পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় এবং বাম্পার ফলন পাওয়া যায়। আমি ৬ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করি। প্রতি বছর ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি লাভ থাকে আমার। অন্যান্য ফসলের বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও ভুট্টার বাজারজাতকরণ নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয় না। ভুট্টা চাষ আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।'

লালমনিরহাটের বাউরা এলাকার বেঙ্গল পোল্ট্রি ফিড কোম্পানির প্রতিনিধি সহিদুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর তাদের ৪৫ হাজার টন ভুট্টার প্রয়োজন হয়। এই চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ স্থানীয় ভুট্টার মাধ্যমে পূরণ করা হয় এবং বাকিটা আমদানি করা হয়।

লালমনিরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান জানান, জেলায় ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে বিশেষ করে তিস্তা নদীর চর এলাকায় ভুট্টার চাষ হচ্ছে। তিস্তার চরাঞ্চলের কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে ভুট্টা চাষ। ভুট্টা এখন লালমনিরহাট জেলার ব্রান্ডিং ফসলে পরিণত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর আঞ্চলিক অতিরিক্ত পরিচালক আফতাব উদ্দিন বলেন, 'আমরা কৃষকদের ভুট্টা চাষে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকি। ভুট্টা চাষ এই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বিশেষ করে চর এলাকার কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

3h ago