‘কৃত্রিম সংকট’, দাম বেশি দিলে পাওয়া যায় সার
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় ইউরিয়াসহ অন্যান্য সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট তৈরিতে বিসিআইসি অনুমোদিত ডিলারদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
শৈলকুপা পৌরসভাসহ ১৪ ইউনিয়নে বিসিআইসি অনুমোদিত ১৫ সার ডিলার ছাড়াও ইউনিয়নগুলোতে ৯ জন সাব-ডিলার আছেন।
অভিযোগ আছে, সরকার অনুমোদিত এই ডিলারদের অনেকেই সরকারি নির্দেশনা না মানায় দেখা দিয়েছে সারের কৃত্রিম সংকট। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিতে।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি আমন মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ জন্য প্রায় ৫৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া, টিএসপি, ডিওপিসহ অন্যান্য রাসায়নিক সারের প্রয়োজন।
কৃষকদের অভিযোগ, শৈলকুপাসহ জেলার ৬ উপজেলায় আমনের ভরা মৌসুমে সংকট দেখিয়ে ডিলাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। এ কারণে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমনের আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ১ হাজার ১০০ টাকার ইউরিয়া সারের বস্তা তাদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকায়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ডিলারদের ক্রয় রশিদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সার বিক্রির নিয়ম থাকলেও বেশি দামে বিক্রির কারণে ডিলাররা মেমো দিচ্ছেন না।
কৃষকরা জানান, ডিলারদের কাছে সরকার-নির্ধারিত দামে ক্রয় রশিদসহ সার কিনতে গেলে, সার নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর বেশি দামে নিলে সার পাওয়া যাচ্ছে।
তারা জানান, ডিলাররা বিভিন্ন দোকানদারের নামে শত শত বস্তার ক্রয় রশিদ দিচ্ছেন। সাধারণ চাষিদের কাছে ক্রয় রশিদ ছাড়া বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।
তারা আরও জানান, ডিলার পর্যায়ে ৫০ কেজির ১ বস্তা ট্রিপল সুপার ফসফেটের (সাদা-কালো) সরকারি মূল্য ১ হাজার টাকা হলেও, কৃষকদের কাছে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
ডিলার পর্যায়ে ডিএপি সার ৭০০ টাকা হলেও কৃষকদের কাছে তা ৮২০-৮৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৯ নম্বর মনোহরপুর ইউনিয়নের ডিলার গোলাম নবী, ৮ নম্বর ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের নিধির সাহা, ১২ নম্বর নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়নের জগলুল বাদশা বিসিআইসির শর্ত ভঙ করে ২০০৯ সাল থেকে শৈলকুপা শহরে সার বিক্রি করে আসছেন।
অন্তত ৫০ জন সাব-ডিলার পৌর শহরে সার-কীটনাশক ব্যবসা করছেন। এতে গ্রামাঞ্চলে সার ও কীটনাশকের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে।
এসব কিনতে কৃষকদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
নির্দিষ্ট গোডাউনে ইউরিয়া সার না রেখে গোপনে অন্যত্র রেখে বিক্রির অভিযোগে সম্প্রতি এক ডিলারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে সার-বীজ মনিটরিং কমিটি।
ওই ডিলারের কাছ থেকে সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া সার উদ্ধার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার শৈলকুপার ৭ নম্বর হাকিমপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার আলম মোল্লার গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করে উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা লিজা।
অভিযানে সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া কম পাওয়া যায়।
পৌরসভার সাব-ডিলার শমসের মোল্লার কাছে সার কাছে বিক্রির অভিযোগে আলম মোল্লাকে জরিমানা করা হয়।
আলম মোল্লা উপস্থিত না থাকায় তার ছেলে নোমান পারভেজ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা দেন এবং সাড়ে ৩০০ বস্তা সার ফিরিয়ে আনা হয়।
আলম মোল্লার ছেলে নোমান পারভেজের দাবি, 'বিক্রির উদ্দেশে নয়, গোডাউনে জায়গা কম থাকায় সার অন্যত্র রাখা হয়েছিল। জরিমানা করা হয়েছে বেশি দামে সার বিক্রির দায়ে।'
'আমাদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা অন্যায়,' দাবি করেন তিনি।
শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মাহফুজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের সার ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী বিসিআইসি সার ডিলার আলম মোল্লাকে (তার অনুপস্থিতিতে ছেলেকে) ১৫ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি বিক্রি করে দেওয়া সাড়ে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া সার ফেরত আনা হয়েছে।'
'এই ডিলার পৌর এলাকার কলেজ রোডে মেসার্স মকবুল এন্টারপ্রাইজকে লাইসেন্স ছাড়া কীটনাশক বিক্রির অনুমতি দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত', বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'কেউ সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি বা সিন্ডিকেটের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপপরিচালক আজগর আলী ও ডিটিও বিজয় কৃষ্ণ হালদার অভিযুক্ত ডিলার আলম মোল্লার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তদন্তে যান।
তারা এই ডিলারের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, রেজিস্ট্রার, সার বিক্রির মেমো দেখাতে না পারাসহ নানা অনিয়ম পান।
উপপরিচালক আজগর আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শৈলকুপার মনোহরপুর ইউনিয়নের সার ডিলার গোলাম নবী, ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের নিধির সাহা, নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়নের জগলুল বাদশা বিসিআইসি ডিলার হওয়ার শর্তভঙ্গ করে ২০০৯ সাল থেকে শৈলকুপা শহরে সার বিক্রি করে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
গত বুধবার আওশিয়া গ্রামের মজনু মণ্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিলারদের ঘরে সার তেমন দেখা যাচ্ছে না। সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকায় সার কিনতে হচ্ছে।'
একই গ্রামের হাকিম উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক বস্তা ইউরিয়ার সরকারি দাম ১ হাজার ১০০ টাকা হলেও এই দামে ডিলারদের কাছে সার পাওয়া যাচ্ছে না।'
শৈলকুপার শিক্ষক পাড়ার প্রান্তিক চাষি মুকুল আলী জানান, তার চাষের জমি মাত্র ২৫ কাঠা। ১০ আগস্ট তিনি শহরের সিনেমা হল রোড এলাকার সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী আসাদ মিয়ার দোকান থেকে ৫ কেজি ইউরিয়া কিনেছেন ২৫ টাকা কেজি দরে। বাংলা ডিএপি কিনেছেন ২৫ টাকা কেজি দরে।
শৈলকুপা বাজারের ডিলার নুরুল আলম মোল্লা ডেইলি স্টারকে জানান, তার কাছে ৫০ ব্যাগ সার ছিল।
সার থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে সার বিক্রি করায় গত ৫ আগস্ট তাকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তা ছাড়া সারের কোনো ঘাটতি নেই বলেও জানান তিনি।
একই বাজারের আরেক ডিলার নিধি সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশি দামে আমরা বিক্রি করি না। এই কাজ করেন সাব ডিলাররা।'
Comments