গাউছিয়া কাঁচাবাজারে আগুন

‘চাইয়া চাইয়া সব পুড়তে দেখছি, কিচ্ছু করতে পারি নাই’

গাউছিয়া কাঁচাবাজারে আগুনের পুড়ে গেছে সব দোকানের মালামাল। ছবি: স্টার

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের পাইকারি বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন কাজল। গত বুধবার ২০ লাখ টাকার মালামাল দোকানে তুলেছিলেন তিনি। আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেছে তার।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গাউছিয়া কাঁচাবাজার নামে পরিচিত বাজারের পশ্চিম পাশে ছিল কাজলের দোকানটি। রোববার মধ্যরাতের ভয়াবহ আগুনে এই বাজারের শতাধিক দোকানের মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে, হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

২০২২ সালেও এই বাজারের একাংশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওইসময় পুড়ে গিয়েছিল কাজলের দোকানের অনেক মালামাল। সেই ক্ষতি সবেমাত্র পুষিয়ে উঠেছিলেন তিনি।

গাউছিয়া কাঁচাবাজারে আগুনের পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃস্ব ব্যবসায়ী। ছবি: স্টার

ছলছল চোখ নিয়ে 'জাহিদ স্টোর' নামে দোকানটির সত্ত্বাধিকারী কাজল বলেন, '১২ বছর ব্যবসা করি। চাল, ডাল, তেল, লবণ, আটাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য পাইকারি বিক্রি করি। নিতাইগঞ্জ থেকে গত বুধবার মাল তুলছি। গতবার তাও কম পুড়ছিল। এইবার কিচ্ছু বাকি নাই। নতুনভাবে দোকান দাড় করানোর ক্ষমতা আর আমার নাই।'

ভোররাত ৩টার দিকে টিনসেডের গাউসিয়া কাঁচাবাজারে আগুন লাগে। এই বাজারে চাল ও আটার আড়ত, পাইকারি মুদির দোকান, সবজি, ভোজ্যতেল, পেট্রোলিয়াম, লুব্রিকেন্ট ও হার্ডওয়ারসহ ১৩৭টি দোকান ও ২৮টি কাঁচামালের ভিটি ছিল বলে জানান গাউছিয়া কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি শঙ্কর ঘোষ।

প্রতিটি দোকানের মালামাল পুড়ে গেছে। এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তার।

বাজার থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে সাওঘাট এলাকায় বাসা কাজলের। ভোররাত ৪টায় এক ভগ্নিপতির ফোন পেয়ে আগুনের খবর জানতে পারেন তিনি।

'খবর পাইয়া বাজারে আসতে আসতে দেখি সব পুড়ে শ্যাষ। কাছে থাকলে হয়তো কিছু রক্ষা করা যাইতো', বলেন এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী।

আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর খবর পেয়েও মালামাল রক্ষা করতে পারেননি বলে জানান চাল ব্যবসায়ী আলী আজগর। প্রায় ৩০০ বস্তা চাল ছিল তার দোকানে।

আজগর বলেন, 'বাজারের উল্টো দিকে হাসপাতালে ভর্তি আমার এক ভাতিজা। তার ফোন পাইয়া সাথে সাথে বাজারে আইছি। আইয়া লাভ হয় নাই। চারদিকে তখন আগুন আর ধোয়া। ভিতরে ঢুকতে পারি নাই। ফায়ার সার্ভিস আইসা যা চেষ্টা করার করছে, কিন্তু লাভ হয় নাই। চাইয়া চাইয়া সব পুড়তে দেখছি। কিচ্ছু করতে পারি নাই।'

গাউছিয়া কাঁচাবাজারে আগুনের পুড়ে গেছে সব দোকানের মালামাল। ছবি: স্টার

বাজারের মাঝখানে উদাস চোখে বসে থাকতে দেখা যায় অনিল বিশ্বাসকে। এই বাজারে তার আটটি চালের আড়ত ছিল। আড়তে সবমিলিয়ে অন্তত ২ হাজার ৭০০ বস্তা চাল ছিল; যার অধিকাংশই এখন পুড়ে ছাই হয়েছে।

উপজেলার হোরগাঁ এলাকার বাসিন্দা অনিল বলেন, 'ইন্সুরেন্সের লোকজন আইসা দেইখা গেছে। হেরা সান্ত্বনা দিতেছে, ক্ষতিপূরণ দিবো। কিন্তু কয় টাকা আর দিবো? আমার তো সব পুইড়া গেছে।'

আড়তে টিনের বাক্সে থাকা কয়েক লাখ নগদ টাকাও পুড়ে গেছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

মধ্যরাতের এই আগুন নিয়ন্ত্রণে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার চারটি ফায়ার স্টেশনের ১০টি ইউনিট কাজ করেছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক সালেহ উদ্দিন।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, ভোররাত ৩টা ৩৫ মিনিটে খবর পেয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে দুটি স্টেশন থেকে দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপনে কাজ শুরু করে। পৌনে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

'এ বাজারটি কাঁচাবাজার বলে পরিচিত হলেও পেট্রোলিয়াম, লুব্রিকেন্ট ও হার্ডওয়ারের দোকান ছিল এখানে। এসব দোকানে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শতাধিক দোকান এই আগুনে পুড়ে গেছে', বলেন ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তা।

তবে আগুনের কারণ ও সূত্রপাত সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

গাউছিয়া কাঁচাবাজারে আগুনের পুড়ে গেছে সব দোকানের মালামাল। ছবি: স্টার

এই বাজারের পাশেই দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের মার্কেট 'গাউছিয়া কাপড় মার্কেট'। কাঁচাবাজারের এই আগুন কাপড়ের মার্কেটে ছড়িয়ে পড়লে আরও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতো বলে জানান স্থানীয়রা।

আজ সকালে বাজারটিতে গেলে তখনও কিছু দোকান থেকে ধোয়া উঠতে দেখা যায়। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া চাল, সবজি, আটা, সেমাইসহ নানা মালামাল।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান ও আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে দোকানগুলোতে অনেক মালামাল তুলেছিলেন তারা। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

তাদের অভিযোগ, গাউছিয়া এলাকার কাছে কোনো ফায়ার স্টেশন নেই। তাই ফায়ার সার্ভিস দেরিতে আসায় আগুনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা গাউছিয়া এলাকায় ফায়ার স্টেশন স্থাপনের দাবি জানান।

মালিক সমিতির সভাপতি শঙ্কর ঘোষ বলেন, 'ঝড়-বৃষ্টির সময় সর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। রাতে বাজারে নৈশপ্রহরী ছাড়া কেউ থাকেন না। নৈশপ্রহরীরা যতক্ষণে আগুনের ব্যাপারে টের পান, ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া ফায়ার সার্ভিসও এসেছে খবর দেওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। ততক্ষণে পুরো বাজারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।'

কাঁচাবাজারটিতে সবগুলো দোকানই ছিল টিনসেডের। এই বাজারে নিজেদের কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না বলে জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি বলেন, 'পাশের গাউছিয়া কাপড় মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। কাঁচাবাজার থেকে যেন আগুন কাপড়ের মার্কেটে ছড়িয়ে না পড়ে মার্কেট মালিক সমিতি সেই চেষ্টা করেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Injured uprising protesters block Mirpur Road

The injured protesters from last year's mass uprising blocked Mirpur Road in Dhaka this morning demanding proper medical treatment, rehabilitation, and compensation.

17m ago