ঝালকাঠিতে লঞ্চ ট্রাজেডির এক বছর

লঞ্চের আগুন, যাত্রীদের আর্তনাদ এখনো পীড়া দেয় প্রত্যক্ষদর্শীদের

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পুড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চের সেই লেলিহান শিখা আর লঞ্চে আটকা পড়া যাত্রীদের আর্তচিৎকারের কথা মনে পড়ে এখনো শিউরে ওঠেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে।
অভিযান ১০
পুড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চ। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পুড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চের সেই লেলিহান শিখা আর লঞ্চে আটকা পড়া যাত্রীদের আর্তচিৎকারের কথা মনে পড়ে এখনো শিউরে ওঠেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে।

সেই সব দুঃস্মৃতি আজো পীড়িত করে সুগন্ধা পাড়ের সেই দিয়াকুল গ্রামের মানুষদের।

গত বছর ২৪ ডিসেম্বর ভোরে দুর্বিষহ এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল সদর উপজেলায় সুগন্ধার ২ পাড়ের বাসিন্দাদের সামনেই পুড়ে মারা গিয়েছিল প্রায় অর্ধশত যাত্রী।

ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে অভিযান-১০ লঞ্চটি বরগুনার উদ্দেশে ৬ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসে। ইঞ্জিনের ত্রুটি নিয়ে যাত্রা করা লঞ্চটি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীতে আসার পর এর ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়।

এরপর চালক কোথাও লঞ্চটিকে নোঙ্গর না করে তা চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার সুগন্ধা নদীতে পৌঁছার পর ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। প্রায় ২ ঘণ্টা লঞ্চটি নদীতে ভাসার পর উপজেলার দিয়াকুল গ্রামে থেমে যায়।

ফায়ার সার্ভিসসহ কয়েকটি উদ্ধারকারী দলের পাশাপাশি স্থানীয়রা যাত্রীদের লঞ্চ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ততক্ষণে প্রায় অর্ধ শতাধিক যাত্রী পুড়ে যায়। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে যারা প্রাণে বাঁচেন তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

নদীতে ঘন কুয়াশা, উদ্ধার কর্মীদের স্বল্পতা ও লঞ্চটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকায় তা নিয়ন্ত্রণে নিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দিয়াকুল গ্রামের রিনা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওইদিন ভোররাত ৩টার দিকে নদীর মধ্যে চিৎকার শুনে জেগে উঠি। বাড়ির অন্যদের নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি লঞ্চটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাড়ির সবাই ছুটে যাই। লঞ্চটি মাঝ নদীতে থাকায় কিছুই করতে পারেনি।'

'লঞ্চটি পাশে আসার পর নদীতে ঝাঁপ দেওয়া যাত্রীদের উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। তাদেরকে শুকনো কাপড় ও খাবার দিয়ে যে যার মতো সহযোগিতা করি,' যোগ করেন তিনি।

এখনো নদীর পাড়ে গেলে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি চোখে ভাসে বলে জানান রিনা বেগম।

লঞ্চে আগুন লাগার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে ছুটে যান বলে জানায় ওই গ্রামের স্কুলছাত্র জনি হাওলাদার। ডেইলি স্টারকে বলে, 'নদীতে ভাসতে থাকা দগ্ধ এক ব্যক্তিকে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করি। এরপর আরও বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করি।'

এখনো নদীতে লঞ্চ যাওয়ার শব্দ শুনলেই ওই দিনের ঘটনা মনে পড়ে যায় বলে জানায় সেই স্কুল শিক্ষার্থী।

'৭৫ বছর বয়সে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার অভিজ্ঞতা ছিল না' উল্লেখ করে একই গ্রামের সোবাহান হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমন নির্মম মৃত্যু যেন কারো ভাগ্যে না জোটে। ওই ঘটনায় গ্রামের প্রায় সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এখনো ওই দিনের ঘটনা মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়।'

সহকর্মীর কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে ওইদিন ভোররাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান বলে জানান ঝালকাঠিতে কাজ করা একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক আল আমিন তালুকদার।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই আগুনের ভয়াবহতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। ওই পরিস্থিতির মধ্যে সারাদিন কীভাবে কাজ করেছি তা ভাবলেই গা এখনো শিউরে ওঠে।'

দুর্ঘটনার সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন সুগন্ধায় যাত্রী পারাপারের ট্রলারের চালকরা। তারাই মূলত অধিকাংশ যাত্রীকে নদী থেকে উদ্ধার করে তীরে এনেছিলেন। পরে তাদের সেখান থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

ট্রলারের চালকদের একজন সোহেল আকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুব ভোরে খেয়াঘাটে আসি। এরপরই দুর্ঘটনার খবর শুনতে পেয়ে দ্রুত ট্রলার নিয়ে লঞ্চটির কাছে যাই।'

'এরপর কুয়াশার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করে তীরে আনি। এ ঘটনা মনে পড়লে এখনো শরীর শিউরে উঠে।'

ট্রলার চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'এক বছর পার হলেও এখনো ওইদিনের ঘটনাগুলো ভুলতে পারিনি। দুর্ঘটনার দিন অনেক দগ্ধ মানুষকে উদ্ধার করেছি।'

দুর্ঘটনার সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ঝালকাঠি পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন কবির সাগর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর পাড়েই বাড়ি হওয়ায় প্রথমেই দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ট্রলারে চড়ে লঞ্চের দিকে যাই। নদীতে ঝাঁপ দেওয়া যাত্রীদের উদ্ধার করে কূলে আনি। ফায়ার সার্ভিসকেও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সহযোগিতা করি।'

'চোখের সামনেই এক শিশু রেলিং ধরে ঝুলে থাকা অবস্থায় পুড়ে মারা গেছে'—এই স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারবেন না উল্লেখ করে সাগর বলেন, 'শিশুটিকে বাঁচাতে না পারার দুঃখ এখনো পীড়া দেয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন লঞ্চটিতে পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন তখনই মানুষের পোড়া দেহ নদীতে পড়ছিল।'

'আমার ধারণা সরকারি হিসাবে যত মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। তাদের দেহাবশেষ নদীতে পানিতে মিশে গিয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

উদ্ধার কাজে অংশে নেওয়া ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাকরি জীবনে কখনোই এমন দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা হননি। কখনো প্রত্যাশাও করিনি। ঘন কুয়াশা আর নৌ ফায়ার স্টেশন না থাকায় উদ্ধার কাজে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।'

দুর্ঘটনার পর লঞ্চের মালিকসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে ঝালকাঠি থানায় দায়ের করা মামলা ঢাকার নৌ আদালতে বিচারাধীন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিহত সবার ডিএনএ রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। সেগুলো পাওয়ার পরে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।'

ঝালকাঠিতে নৌ ফায়ার স্টেশন স্থাপনের ব্যাপারে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের সুপারিশসহ আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করি, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ঝালকাঠিতে নৌ ফায়ার স্টেশন করা হবে।'

বর্তমানে বরিশাল বিভাগে ২টি নৌ ফায়ার স্টেশন আছে বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Police didn't follow int'l standards while using lethal weapons: IGP

Police failed to adhere to the standards in home, which they have maintained during their UN missions, Mainul Islam said

6h ago