ভয়াবহ নদী দখল: শাহ সিমেন্টের কবলে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার মোহনা

বালুর বিশাল স্তূপ, মাটি ফেলতে ব্যস্ত এক্সকাভেটর, বারবার যাওয়া-আসা করছে ট্রাকগুলো। পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে বিশাল কংক্রিট দেয়াল ও বাউন্ডারি। ক্লিংকারের ধুলোয় ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার বাতাস ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ। সেই ধুলো গিয়ে পড়ছে নদীর পানিতে। এতে দূষিত হচ্ছে পানি ও বাতাস।
মুন্সিগঞ্জে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার মোহনায় বিশাল এই স্থাপনা যেন বাংলাদেশের লাগামহীন নদী দখলের এক ভয়াবহ নিদর্শন।
এখানকার অধিকাংশ জায়গা ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার অংশ। কিন্তু শাহ সিমেন্ট দুটি নদীরই কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে। যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ ও পরিবেশব্যবস্থায়। অন্তত চারটি সরকারি প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
নথি অনুযায়ী, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে শাহ সিমেন্টকে 'দখলদার' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কিন্তু, নদীগুলো রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
আবুল খায়ের গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শাহ সিমেন্ট এক লিখিত বিবৃতিতে নদীর জমি দখলের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু, তারা দুটি নদীর মাঝের এই জমির মালিকানা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে রাজি হয়নি।

অবৈধ দখল
নথিপত্র এবং বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, শাহ সিমেন্ট ২০০২ সালে কারখানাটি নির্মাণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই কারখানা বিস্তৃত হয় দুই নদীর ভেতরে।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, শাহ সিমেন্ট বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ সিমেন্ট কারখানা, যার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা এক কোটি টন।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে একাধিকবার পরিদর্শনের সময় দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায়, বিশাল স্থাপনা, ভারী যন্ত্রপাতি এবং একটি গুদাম দাঁড়িয়ে আছে দুই নদীর মোহনাস্থলে।
মুন্সিগঞ্জ সদর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসও নিশ্চিত করেছে, শাহ সিমেন্ট মিরেরসরাই মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ১৮৪ এবং পূর্ব মুক্তারপুর মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ৩০১ থেকে ৩০৮ পর্যন্ত একটি বড় নদী এলাকা দখল করে রেখেছে।
গতকাল শনিবার রাতে মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজাউল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে সার্ভে শেষ করেছি এবং তদন্ত শেষ হলে [শাহ সিমেন্টকে] নোটিশ দেওয়া হবে।'
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা মুন্সিগঞ্জ ভূমি অফিসের রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) রেকর্ড অনুযায়ী, দাগ নম্বর ১৮৪ এবং ৩০১ থেকে ৩০৭ নম্বর দাগ নদী ও নদীর তীর হিসেবে চিহ্নিত এবং 'বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন' হিসেবে তালিকাভুক্ত।
আরএস দাগ নম্বর ৩০৮-এর জমির রেকর্ড সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
দুই দশক আগে এই সিমেন্ট কারখানাটি স্থাপনের আগে ধলেশ্বরী ছিল একটি জীবন্ত নদী। স্থানীয়রা সেখানে মাছ ধরত, গোসল করত এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিল।

মুন্সিগঞ্জের নদীপাড়ের গ্রাম মোল্লারচরের বাসিন্দারা জানান, প্রথমে কারখানাটি ছোট্ট একটি জায়গায় গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বালু ফেলে ধীরে ধীরে তারা জায়গা বাড়াতে থাকে। রাতের আঁধারেও সেই কাজ চলত।
২০২৫ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে দেওয়া এক চিঠিতে জানায়, শাহ সিমেন্টের বালু ফেলার কার্যক্রম শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীপথে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করছে, নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত করছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, শাহ সিমেন্টসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোহনায় বালু ও মাটি ফেলে জায়গা উঁচু করছে, যার ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারি নির্দেশনা সত্ত্বেও শাহ সিমেন্ট এখনো অবৈধভাবে ফেলা বালু ও মাটি অপসারণ করেনি। এই কর্মকাণ্ড বন্দর আইন ১৯০৮, বন্দর বিধিমালা ১৯৬৬ এবং উচ্চ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সাম্প্রতিক এক সফরে এলাকাটি পরিদর্শন করে অবৈধ দখল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
যোগাযোগ করা হলে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব নেওয়া মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, 'শাহ সিমেন্টের বিরুদ্ধে নদীর কিছু জায়গা অবৈধভাবে দখলের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে বিস্তৃত তদন্ত চলছে। সাইট পরিদর্শন ও রেকর্ড যাচাই শেষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সবচেয়ে বড় দখলদার
এটিই প্রথম নয়, সরকারিভাবে নদী দখল নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়া এবং চিঠি চালাচালির ঘটনা এর আগেও ঘটেছে।
দুই বছর আগে—২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি—মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটি তালিকা প্রস্তুত করে এবং শাহ সিমেন্টকে নদী দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করে।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরের সই করা ওই তালিকা অনুযায়ী, ১৫টি প্রতিষ্ঠান ধলেশ্বরী নদীর ৩৪ দশমিক ৯৬ একর জায়গা দখল করেছে। এর মধ্যে শাহ সিমেন্ট একাই দখল করেছে ২৪ একর। অর্থাৎ, এখানে তারাই সবচেয়ে বড় দখলদার।
এর আগে ২০১৯ সালের ৬ মে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটি তালিকা তৈরি করে এবং ৫০টি নদী দখলকারীর মধ্যে শাহ সিমেন্টকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেখানে বলা হয়, কোম্পানিটি মিরেরসরাই মৌজায় আরএস দাগ নম্বর ১৮৪-এর নদীর জমি দখল করেছে।
তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, এই তালিকাটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে—নোটিশ প্রদান ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে।
চিঠিটি দেশের সব নদীর আইনি অভিভাবক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে শাহ সিমেন্টকে এই দুই নদীর দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০১৮ সালের প্রতিবেদনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানায়, শাহ সিমেন্ট 'ধীরে ধীরে নদীর জমি দখল করে ভরাট করছে এবং নদীর চরের জায়গায় সাইনবোর্ড টানিয়েছে।'
পরের বছর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাহ সিমেন্ট কোম্পানি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার মিরেরসরাই মৌজায় আরএস খতিয়ান নম্বর এক ও আরএস দাগ নম্বর ১৮৪-এ নদীর প্রায় ২৪ একর জায়গা বালু ফেলে ভরাট করে দখল করেছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে বালু ফেলার মাধ্যমে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোম্পানিটি বিশাল কারখানা নির্মাণ করেছে, যার ফলে একদিকে ধলেশ্বরী এবং অন্যদিকে শীতলক্ষ্যা নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে—যা দুটি নদীকেই গিলে ফেলার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কারখানাটি ধলেশ্বরী নদীতে তরল ও কঠিন বর্জ্য ফেলে।
এতে বলা হয়, এই কারণে নদীর পানি, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় চার মিটার ব্যাসের একটি বড় পাইপ দিয়ে শাহ সিমেন্ট কারখানা থেকে সরাসরি দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ছে; ফ্লাই অ্যাশের দূষণে মাছ, ডলফিন ও পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গেছে।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, 'আমি ২০১৯ সালে এলাকাটি পরিদর্শন করে কারখানাটিকে নদী দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম। এতদিন ধরে কীভাবে তারা ওই জমি দখল করে থাকে? কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছে দুটি নদী ভরাট করে। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে সিএস ও আরএস রেকর্ড যাচাই করে অবৈধ দখলের একটি প্রতিবেদনও দিয়েছিলাম।'
কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং ২০২৩ সালের মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তালিকাটি কেবল আরএস দাগ নম্বর ১৮৪-ভিত্তিক—যেখানে শাহ সিমেন্ট ২৪ একর নদীর জমি দখল করে আছে। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৫ সালের শুরুতে করা জরিপে অতিরিক্ত আরএস দাগ নম্বর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব থেকে দেখা যায়, বর্তমানে কোম্পানিটি ২৪ একরের বেশি নদীর জমি দখল করে আছে।
যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'হাইকোর্ট নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন। এর মানে স্থানীয় প্রশাসনের এখতিয়ার রয়েছে অবিলম্বে দখলদারদের উচ্ছেদ করার।'
তিনি বলেন, 'আমি বুঝতে পারছি না কেন তারা এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি—বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর।'
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এই স্বল্প মেয়াদের মধ্যে ১৩টি নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এই নদীগুলো যদি ওই তালিকায় থাকে, তাহলে আমাদের মেয়াদের মধ্যেই এর ফলাফল দেখা যেতে পারে।'
বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপপরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, 'নদীর যেসব অংশ দখল হয়ে গেছে, তা শিগগির পুনরুদ্ধার করা হবে। ওই এলাকার ডিজিটাল জরিপ শেষ। শিগগির সীমানা নির্ধারণকারী খুঁটি বসানো হবে।'

'নদীর গতিপথ পরিবর্তন'
শাহ সিমেন্টের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ শুরু করে ২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানোর মাধ্যমে। কোম্পানিটি সেসব প্রশ্নের লিখিত জবাব দেওয়ার পরিবর্তে সরাসরি বৈঠকের অনুরোধ জানায়। এরপর ৫ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের গুলশান অফিসে দুই দফা বৈঠক হয় এবং দ্য ডেইরি স্টারের অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কোম্পানিটির অনুরোধে ভূমি-সংক্রান্ত কিছু নথি ও সরকারি প্রতিবেদনের নির্বাচিত অংশও তাদের দেওয়া হয়।
একাধিক অনুরোধের পর কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত ২৬ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারের প্রশ্নগুলোর লিখিত জবাব দেয়।
তাদের জবাব ও দাবির ভিত্তিতে আরও নথি সংগ্রহ করে নতুন কিছু তথ্য পায় দ্য ডেইলি স্টার। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে মার্চ মাসজুড়ে কোম্পানিটির সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করা হয় এবং তাদের ব্যাখ্যা ও মতামত চাওয়া হয়। তবে কোম্পানিটি আর কোনো জবাব দেয়নি।
২৬ ফেব্রুয়ারির লিখিত জবাবে কোম্পানিটির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও লিগ্যাল প্রধান শেখ শাবাব আহমেদ বলেন, 'দেশের সব আইনের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রেখে আমরা কাজ করি।'
তিনি বলেন, 'নদী দখলের বেশিরভাগ অভিযোগ সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতে করা হয়েছে। স্বাধীনতার আগে ও পরে আরও বেশ কয়েকটি জরিপ—যেমন: আরএস, এসএ ও বিএস—সম্পন্ন হয়েছে। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তনের কারণে সিএস রেকর্ডের পর এর প্রবাহ নতুন জায়গায় গেছে। এই পরিবর্তনের প্রতিফলন সাম্প্রতিক ভূমি জরিপে দেখা যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয় এখনো আদালতে বিচারাধীন। কাজেই যেকোনো প্রতিষ্ঠান যদি সবদিক বিবেচনা না করে, সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ না করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে—তা হবে অযৌক্তিক।'
দ্য ডেইলি স্টার সংশ্লিষ্ট ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) ও রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) রেকর্ড সংগ্রহ করেছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট জায়গাকে নদীর জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিএস ও আরএসের মধ্যবর্তী সময়কালে তৈরি হওয়া এসএ রেকর্ডও সংগ্রহ করা হয়েছে। এসএ রেকর্ডেও অধিকাংশ জমিকে নদী হিসেবে শ্রেণিবিন্যস্ত করা হয়েছে। শুধু একটি ছোট অংশকে ঘরবাড়ির সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে ভূমি মন্ত্রণালয় এসএ রেকর্ডকে 'অপ্রামাণ্য' বলে বিবেচনা করে, কারণ এসব রেকর্ড মাঠপর্যায়ের জরিপের পরিবর্তে জমির মালিকদের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল।
তা ছাড়া, ২০০৯ সালের একটি ঐতিহাসিক রায়ে হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেন, নদীর জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে সিএস ও আরএস রেকর্ডের ভিত্তিতে।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ওই রায়ে আদালত স্বীকার করেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নদী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে।

'বাংলাদেশের নদীগুলোর এই প্রবাহপথ পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। কাজেই অত্র রীট মোকদ্দমাটিতে উত্থাপিত সমস্যা সমাধানে সর্ব প্রথম আমাদের নদীগুলির সীমানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। নদীর সীমানা নির্ধারণ করিতে কোন পদ্ধাতি আইন সম্মত হইবে সে সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত লইতে হইবে উল্লেখ্য যে, বিভাগ পূর্ব সমগ্র বৃহত্তর বিংশ শতাদ্বীর প্রথম ভাগে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত জরীপের ভিত্তিতে ম্যাপ ও খতিয়ান প্রস্তুত হয়। এই কারণে সিএস ম্যাপকেই আমরা নদীর সীমানা নির্ধারণের প্রাথমিক হিসাবে ধরিয়া লইতে পারি। অতএব, নদী বলিতে সিএস ম্যাপে যে স্থানে নদী প্রদর্শন করা হইয়াছে সেই স্থানটিকেই নদী বলিয়া আপাত স্বীকৃতি প্রদান করিতে হইবে', রায়ে বলা হয়।
হাইকোর্ট আরও উল্লেখ করেন, সিএস মানচিত্রে যেভাবে নদীর অবস্থান দেখানো হয়েছে তা থেকে নদীর প্রবাহ পথ পরিবর্তিত হলে সে পরিবর্তনের ফলে নদীর একপাশে যদি কোনো চর জাগে, তাহলেও সেই চর সরকারি মালিকানাধীন হিসেবেই বিবেচিত হবে।
রায়ে বলা হয়, 'উপরে বর্ণিত আইনি অবস্থান অনুসারে, নদীর সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত পরবর্তী জরিপকাজ বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত আরএস রেকর্ড ও মানচিত্র অনুযায়ী সম্পন্ন করতে হবে। এই জরিপকাজ দুইভাবে সম্পন্ন করতে হবে—প্রথমত, সিএস মানচিত্র অনুযায়ী এবং দ্বিতীয়ত, আরএস মানচিত্র অনুযায়ী।'
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'এসএ ও বিএস জরিপের ভিত্তিতে নদীর জমি চিহ্নিত করা আইনগতভাবে বৈধ নয়। আদালত ইতোমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন যে নদীর জমি চিহ্নিত করতে হবে সিএস ও আরএস রেকর্ডের ভিত্তিতে।'
একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও শাহ সিমেন্ট জানায়নি যে তারা সেখানে কতটুকু জমির মালিক অথবা সরকারের অনুমোদন নিয়ে কতটুকু নদীর জমি ইজারা নিয়েছে।
তারা কেবল জানিয়েছে, 'শাহ সিমেন্ট দেশে বিআইডব্লিউটিএর অন্যতম সর্বোচ্চ ভাড়াদাতা এবং আমরা নিকটবর্তী নদীর তীরবর্তী এলাকা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ব্যবহার করি।'
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, শাহ সিমেন্ট ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর থেকে নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএ পোর্ট অফিসের লাইসেন্সে নদীর তীরবর্তী জমি ব্যবহার করছে, যা কারখানা স্থাপনের দুই বছর পর শুরু হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির কাছে ১১ দশমিক ২৮ একর নদীর তীরবর্তী জমির ইজারা রয়েছে, যার মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে।
ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, কোম্পানিটি নদী বা নদী-তীরবর্তী জায়গা ভরাট করতে পারবে না, অতিরিক্ত নদীর জমি ব্যবহার করতে পারবে না, নদীতীর পরিবর্তন করতে পারবে না, নাব্যতা ব্যাহত করতে পারবে না, ইচ্ছামতো জাহাজ ভেড়াতে পারবে না এবং নদীতে বর্জ্য ফেলতে পারবে না।
নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএ পোর্ট অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ১৩ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাহ সিমেন্ট চুক্তির শর্ত মানছে না। তারা ধীরে ধীরে নদী ও নদীতীর ভরাট করছে—যার ফলে ওই এলাকায় নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। আমরা মাঝে মাঝে সাইট পরিদর্শন করি, মৌখিকভাবে তাদের শর্ত মানতে বলি এবং মাঝে মাঝে উচ্ছেদ অভিযান চালাই।'
এ বিষয়ে জানতে গত মার্চে যোগাযোগ করা হয় নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। শাহ সিমেন্ট 'নদী দখলকারী নয়'—কোম্পানিটির এমন দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'আমি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদী পরিদর্শন করেছি এবং সেখানে দেখেছি যে শাহ সিমেন্ট নদী দখল করেছে। তখনই আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম।'
গতকাল আবারও যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি যেন জরিপ করে এটা নির্ধারণ করে যে শাহ সিমেন্ট ও অন্যান্য কারখানাগুলো কত জমি দখল করেছে। আমি এখন নিশ্চিত না যে এখন পর্যন্ত কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আমি অবশ্যই বিষয়টি তদারকি করব।'
Comments