নড়াইলের ‘বোম্বেপাড়া’: নারী পাচারের হটস্পট

বিদেশে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি বছর হাজারো মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় ভারতের মুম্বাই ও পুনের মতো শহরে। দ্য ডেইলি স্টারের তদন্তে উভয় সীমান্তের দালাল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতাসহ অন্ধকার এই জগতের নানা বিষয় উঠে এসেছে। চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব এটি।

ঝিনাইদহের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দুই ঘণ্টা দূরের জেলা নড়াইল ভারতের মুম্বাইয়ে নারী পাচারের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে।

নারী পাচারের জন্য জেলার জামরিলডাঙ্গা, বাদামটোলা, খারারিয়া, ভোগড়া ও তুলারামপুর অন্যতম এলাকা হয়ে উঠেছে।

পরিস্থিতি এতটা উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যে নড়াইলের একটি এলাকা এখন 'বোম্বেপাড়া' নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

সরেজমিনে তদন্তের সময় স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলের অনেক মেয়ে ও নারী ভারতের বোম্বেতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়েছে।

নড়াইলের জামরিলডাঙ্গার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, 'দু-এক বছর পর পর তাদের বাড়ি ফিরে আসা খুব সাধারণ ঘটনা।'

তিনি বলেন, 'মুম্বাই থেকে দেশে ফিরে আবার যাওয়ার সময় তারা প্রায়ই আরও দু-একজন মেয়েকে চাকরি দিতে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়। এই কারণে গ্রামবাসী এই এলাকাকে বোম্বেপাড়া হিসেবে ডাকে।'

দ্য ডেইলি স্টার সেখানে মোহনা (ছদ্মনাম) নামে এক নারীর খোঁজ পায়, যিনি তার দুই সন্তানকে স্বামীর কাছে রেখে মুম্বাইয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মোহনা গত মে মাসে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'খারারিয়া গ্রামের দুই নারীর কাছ থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছি। তারা ভালো বেতন পাচ্ছে এবং আমাকেও ভালো রোজগারের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছেন।'

পুনের বাংলাদেশি যৌনকর্মী পাখি বলেন, বাংলাদেশি যৌনপল্লি পরিচালনা করে এমন একজন অন্তত প্রায় ২৫টি যৌনপল্লি পরিচালনা করেন। সেখানে শতাধিক বাংলাদেশি মেয়ে ও নারী রয়েছেন, যাদের অনেকে নড়াইলের শিংশোলপুর এলাকার।

ভারতে লেনদেন

২০০৬ সাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযান পরিচালনা, অনুসন্ধান এবং উদ্ধার অভিযানে সহায়তাকারী মুম্বাইয়ের একটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে আমরা দেখতাম যে পাচারকারী বা তাদের সঙ্গীরা ভুক্তভোগীকে নিজ গ্রাম থেকে গন্তব্য পর্যন্ত নিয়ে যেত।'

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই ব্যক্তি বলেন, 'এখন তারা মেয়েদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসেন, রাতের যে সময়ে কম পাহারা থাকে তখন সতর্কতার সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং তারপর হয় তাদের গন্তব্যে নিয়ে যান, কিংবা চুক্তি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তের আশেপাশের কিছু গ্রামে আটকে রাখেন। এসব কাজের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক লোক রয়েছে। একাধিক ক্রেতা এবং একাধিক বিক্রেতা।'

তিনি জানান, এসব ক্ষেত্রে সব ধরনের লেনদেন হয় নগদ অর্থে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের বাংলাদেশ থেকে পাচার হতে দেখেছি এবং এর হার ৩০ শতাংশের কম না।'

রাইটস যশোরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এস এম আজহারুল ইসলাম বলেন, 'আজকাল পাচার করা মেয়েটিকে বৈধভাবে ভারতে রাখার জন্য একজন বাঙালি পুরুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'একবার বিয়ে হয়ে গেলে তারপর মেয়েটিকে যৌনপল্লি বা ফ্ল্যাটে তুলে দেওয়া হয় এবং সেখানে তাকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।'

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাচার হওয়া মেয়েদের উদ্ধার করছেন আজহার৷

আজহার বলেন, যিনি কোনো মেয়েকে ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি করান তিনি পান ১৫ হাজার টাকা।

সীমান্তে পাচার চক্রের সদস্যরা মেয়েটিকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, 'মেয়েটিকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা পান ১০ হাজার টাকা। তারপর যিনি সীমান্তে মেয়েটিকে নিয়ে রাখেন, তিনি পান ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।'

সীমান্তের যে বাড়িগুলোতে মেয়েটিকে আটকে রাখতে ব্যবহার হয়, তারা এর জন্য ৩ হাজার টাকা পায়। তিনি বলেন, 'সীমান্ত পার করতে সবুজ সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ওই বাড়িতে মেয়েটিকে রাখা হয়।'

এনজিও কর্মী আজহারুল বলেন, অনেক সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে দিয়েই মেয়েদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাহকরা প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পান।

তিনি বলেন, 'একইভাবে ভারতের বাহক ওই মেয়েকে রাখা ও মুম্বাইয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেলস্টেশনে নেওয়ার জন্য ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পান।'

আজহারুল আরও বলেন, 'ট্রেনে ওই মেয়েকে নিরাপদে মুম্বাইয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকজন বাহক পান ৭ হাজার টাকা।'

'অবশেষে যিনি মুম্বাইয়ে মেয়েটিকে হাতে পান তিনি যৌনপল্লিতে তাকে বিক্রি করেন ৩ লাখ টাকায়,' যোগ করেন আজহারুল।

মুম্বাই সূত্র জানায়, অনেকে এখন ভারতীয় হিসেবে পুনে ও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জেলায় বাস করছেন। ভারতীয় পাচারকারীদের সঙ্গে তারাও এই মানবপাচারে জড়িত।

ওই সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যৌনপল্লির জন্য দালাল প্রথমে একটি জায়গা বা বাড়ি ভাড়া নেয়। এরপর মেয়েদের রাজি করানোর জন্য যৌনপল্লির ম্যানেজার হিসেবে বাংলাদেশিদের নিয়োগ দেয়। আমরা তো এখন দেখি, মহারাষ্ট্রে যৌনপল্লিগুলো ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টেই চালানো হয়।'

দালালরা অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে, স্থানীয়ভাবে যা হপ্তা নামে পরিচিত।

সূত্র জানায়, 'গ্রাহকদের মেয়েদের ছবি দেখানো, ভাড়া আদায়, নিরাপত্তা দেওয়া, পুলিশ ম্যানেজ করা এবং গ্রাহকদের কাছে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা লোক আছে।'

'প্রতি মাসের মাশোহারা ৫০ হাজার রুপির কম না। এর একটা অংশ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটেও যায়,' সূত্র জানায়।

তিনি জানান, পুলিশ প্রায়শই অর্থের বিনিময়ে এসব যৌনপল্লি পরিচালনাকারীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।

তিনি বলেন, 'আমরা এমন ঘটনা অনেকবার দেখেছি, যেখানে ভুক্তভোগী যৌনপল্লি থেকে পালিয়ে এসে স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পুলিশ সাহায্য করার পরিবর্তে যৌনপল্লি পরিচালনাকারীদের কাছে খবর পাঠায় এবং তারপরে ওই ভুক্তভোগীকে আবার সেখানে পাঠিয়ে দেয়।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago