ভারতের রেডলাইট এলাকায় পাচার ও ফেরার গল্প

‘এতেও তারা থেমে থাকেনি। না খাইয়ে রেখেই আমার ওপর অত্যাচার করত।’
ভারতের রেডলাইট এলাকায় পাচার ও ফেরার গল্প

বিদেশে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি বছর হাজারো মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় ভারতের মুম্বাই ও পুনের মতো শহরে। দ্য ডেইলি স্টারের তদন্তে উভয় সীমান্তের দালাল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতাসহ অন্ধকার এই জগতের নানা বিষয় উঠে এসেছে। চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব এটি।

পুনের একটি জমজমাট এলাকায় অবস্থিত বুধওয়ার পেঠ। ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রেডলাইট এলাকা এটি। ১৮ শতকে গড়ে ওঠা এই বুধওয়ার পেঠ এলাকায় প্রায় ১১০টি যৌনপল্লি রয়েছে।

চা-বিস্কুট বিক্রির দোকান থেকে ভেসে আসা বাংলা গান মিশে যাচ্ছে গাড়ির হর্ন আর আড্ডার কোলাহলে। দোকানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সরু গলিতে সারিবদ্ধ পুরোনো কাঠের দরজা। এসব দরজার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তাদের বয়স হয়েছে ঢের।

এসব দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে শত শত নারী; কারো বয়স হয়েছে বেশ, আবার কেউবা তরুণী। উজ্জ্বল রংয়ের শাড়ি ও স্কার্ট পরে তারা আড্ডা দিচ্ছে, হাসছে।

ব্যস্ত গলি থেকে এই দরজার চৌকাঠগুলোকে তাদের নিয়ে যায় যেন অন্ধকারে, শূন্যতার দিকে। এই চৌকাঠগুলোর মধ্যে একটি ধরে এগিয়ে গেলে সামনে দীর্ঘ করিডোর। যাওয়ার পথে একমাত্র আলোর উৎস হচ্ছে দেবদেবীর ছবির সামনে জ্বালানো প্রদীপ। সর্বোচ্চ দুজন দাড়াতে পারবে এমন আকারের করিডোর ধরে এগোলে আরেকটি ছোট করিডোরে গিয়ে ওঠে, যেখানে উভয় পাশে তিনটি করে দরজা।

ডানদিকের দরজাগুলোর ওপাশে একটি করে লোহার খাটে খালি গদি আর একটি বালিশ। সবগুলো ঘরের চেহারা প্রায় একই। রুমের তিন দিকের দেয়াল ঘেঁসে রয়েছে খাটটি। আর একদিকে সামান্য জায়গা রয়েছে, যেন রুমের দরজাটি খোলা যায় এবং বন্ধ করা যায়। ব্যস, এতটুকুই জায়গা সেখানে।

বাম দিকে প্রতিটি দরজার ঠিক উল্টোপাশে একটি করে ছোট আকারের টয়লেট। এখানে আলোর একমাত্র উৎস হলো করিডোরের হলুদ আলোর বাল্বটি।

যৌনকর্মী হিসেবে পাচার হওয়া নারীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই ধরনের রুমগুলোতে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ যৌনকর্মী থাকেন এবং তাদের মধ্যে ২০ শতাংশেরও বেশি—প্রায় ২০০ থেকে ২৫০—নারী বাংলাদেশি।

ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিদেশে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি বছর হাজারো মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় শুধুমাত্র মুম্বাই ও পুনের মতো শহরে।

অনেক বাংলাদেশি যৌনকর্মী এখন এসব যৌনপল্লির ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেন। তারাও একসময় ছিলেন এই দুষ্টচক্রের ভুক্তভোগী। তারা বাংলাদেশি নারীদের নিয়োগ করেন, যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে নতুন নতুন মেয়েকে এসব যৌনপল্লিতে নিয়ে আসার জন্য পাচারকারী হয়ে ওঠেন।

এমনই এক বাংলাদেশি নারী পাখি (ছদ্মনাম) নিজেই একটি যৌনপল্লি চালান।

একটি ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে তিনি পাঁচটি মেয়েকে দিয়ে তার যৌনপল্লি চালান। এখান থেকে তার দৈনিক আয় হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। গত মার্চে এই যৌনপল্লিটি বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করে দেখা যায়, যখনই কোনো গ্রাহক একটি মেয়েকে নিয়ে রুমে যান, তখন বাকি মেয়েরা তাদের জায়গা করে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করেন।

১৫ বছর আগে স্বামীর হাত ধরে যশোরের বাড়ি ছেড়েছিলেন ২০ বছর বয়সী পাখি। বাড়ি ছেড়ে বুধওয়ার পেঠের পথে তিনি নিজের পছন্দে আসেননি।

পাখির চোখে তখন ছিল একটি সুখী সংসারের আশা। কিন্তু স্বামীর জুয়া খেলার নেশায় তার পরিবার পড়ে যায় আর্থিক অনটনে। একসময় তার স্বামী পরামর্শ দেন সীমান্ত পেরিয়ে মুম্বাই চলে যাওয়ার। তিনি কথা দেন মুম্বাইয়ে তারা অনেক ভালো থাকতে পারবেন। নির্বিকারভাবে রাজি হয়ে যান পাখি।

২০০৮ সালে ভারতের পথে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাখি বলেন, 'আমরা দালালদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে সীমান্ত পার হই।'

কিন্তু তার স্বামী ও সেই দালালদের পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। তারা পাখিকে পুনের একটি যৌনপল্লিতে মাত্র দুই লাখ রূপির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

শুরুর দিকের দিনগুলো চরম হতাশা ও কষ্টে কাটে পাখির। তার মনে হয়েছিল সেখান থেকে পালানো অসম্ভব। পাখিকে কোনো টাকাও দেওয়া হতো না। তার আয় বলতে ছিল গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু টিপস।

সেসব দিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে পাখি বলেন, 'আমাকে দিনে কেবল তিনবেলা খাবার দিতো, আর প্রসাধনী দিতো সাজার জন্য।' খাবার বলতেও ছিল কেবল মসুরের ডাল, ভাত আর মাঝে মাঝে শাকসবজি।

পাখি জানান, যখনই বাংলাদেশ থেকে কোনো মেয়েকে যৌনপল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাদেরকে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা বাংলাদেশি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা না পড়েন এবং বাংলাদেশি পরিচয় গোপন রেখে ভারতীয় পরিবেশে নির্বিঘ্নে মিশে যেতে পারেন।

পাখি বলেন, 'আমি এখন হিন্দি, মারাঠি, কন্নড়, গুজরাটি ও বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি।'

বিক্রি করে দেওয়ার প্রায় দুই বছর পরে 'ঋণ শোধ' করতে সক্ষম হন পাখি। এরপর থেকে তিনি যৌন কাজের বিনিময়ে টাকা পেতে শুরু করেন। তখন রুম ব্যবহার ও নিরাপত্তার জন্য যৌনপল্লির ম্যানেজারকে আয়ের একটি অংশ দিতে হতো পাখিকে। এতগুলো দিন যৌনকর্মী হিসেবে আটকে থাকার পর তার ভেতরে যে দ্বিধা তৈরি হয়, তা নিয়ে আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি পাখি। পাশাপাশি তার কাছে কোনো অর্থ কিংবা বৈধ কাগজপত্রও ছিল না। তাই তিনি থেকে যান সেখানেই এবং নিজের একটি যৌনপল্লি তৈরি করেন।

তিনি তার মতো আরও চারটি মেয়েকে নিয়ে নিজের যৌনপল্লি শুরু করেন। ওই মেয়েরাও পাচার হয়ে এসেছিলেন এবং যারা তাদের কিনে নিয়েছিল তাদের কাছ থেকে 'ঋণ শোধ' করে মুক্ত হয়েছিলেন। পাখি বলেন, 'আমরা এখন ভারতীয় পরিচয় পাওয়ার জন্য টাকা জমাচ্ছি।'

কয়েক বছরে পাখি দেশে তার বাবা-মাকে পাঠিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা।

সীমান্তে ভুক্তভোগীদের যাত্রা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মাত্র ৬০ শতাংশে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া।

এর মধ্যে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তটি সহজে যাতায়াতের জন্য কুখ্যাত।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহেশপুর ব্যাটালিয়নের পরিসংখ্যানেও এই পয়েন্টের দুর্বলতা উঠে এসেছে। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে'র মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় এই সীমান্ত থেকে অন্তত ৭৫ জনকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ছিলেন ২২ নারী ও ছয় শিশু।

২০২২ সালে বিজিবির এই ইউনিট বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের চেষ্টারত এক হাজার ১৮৬ জনকে আটক করে। তারা গত বছর ৫৩ জন দালাল বা পাচারকারীকে এবং চলতি বছরের সাড়ে চার মাসে আরও তিনজনকে আটক করেছে।

তবে ধরা পড়া এই সংখ্যাটি কেবলই একটি ভগ্নাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাচারকারীরা ধরা পড়ে না। এভাবে চলাচল এতই সহজ যে, গত ১৫ মে নড়াইলের ভুক্তভোগী জলি খাতুন যখন সীমান্ত পার হয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন তার সঙ্গে দেখা হয় আমাদের সংবাদদাতার।

জলি মুম্বাইয়ের একটি যৌনপল্লি থেকে পালিয়ে ফিরে আসছিলেন। সেখানে তিনি তিন মাস বন্দি ছিলেন।

তাকে একইভাবে এই সীমান্ত দিয়েই পাচার করা হয়েছিল। বেড়াহীন এই সীমান্ত দিয়ে হেঁটেই তিনি চলে গিয়েছিলেন পাচারকারীদের সঙ্গে। একাধিক ভুক্তভোগী ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, এটা আসলেই এত সহজ যে তাদেরকে হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের পাচার করা হয়।

জলিকে যিনি পাচার করেন তার সঙ্গে জলির পরিচয় হয়েছিল নড়াইলের একটি ক্লিনিকে ওয়ার্ড সহকারী হিসেবে কাজ করার সময়। ক্লিনিক থেকে জলি প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পেতেন। পাচারকারী নারী জলিকে প্রস্তাব দেন, ভারতে গেলে তাকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে।

জলি রাজি হয়। নড়াইলের মুচিপোল থেকে যশোর পর্যন্ত একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়, তারপর বাসে ঝিনাইদহের বেলেমাঠ বাজারে যান তারা।

সেখানে তারা দুপুরের খাবার খান আরও দুজন পুরুষের সঙ্গে। সেটি ছিল আসলে একজন ক্যারিয়ারের বাড়ি ছিল। পাচার করার জন্য মানুষ এনে এসব বাড়িতে জড়ো হয় এবং যতক্ষণ না তারা সীমান্ত পার হওয়ার জন্য সবুজ সংকেত পান, ততক্ষণ সেখানেই রাখেন।

দুপুরের খাবারের পর তাদের সঙ্গে আট থেকে দশজন মেয়ে এবং তিন থেকে চারজন পুরুষ এসে যোগ দেন। দিনের আলোতে তারা হেঁটে সীমান্তের ওপারে চলে যান এবং নির্জন এলাকা পেরিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর জলিরা পৌঁছে যান একটি রেলস্টেশনে।

রেলস্টেশনে সবাইকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনে জলি বুঝতে পারেন যে তিনি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়েছেন।

যখন সব বুঝতে পারেন, ভয় পেয়ে যান জলি। জলি প্রশ্ন করলে পাচারকারী নারী তাকে হুমকি দিতে থাকেন। তিনি বলেছিলেন, 'চুপ কর, নইলে তোকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিবো।'

পরের তিনদিনে ট্রেনে কলকাতা থেকে মুম্বাই ও তারপরে আওরঙ্গাবাদ নেওয়া হয় জলিকে। সেখানে জলিকে রাখা হয় একটি বাড়িকে, যেখানে আরও ৬০ থেকে ৬৫ জন বাংলাদেশি মেয়ে ছিলেন।

সেখানে তাদের জীবন ছিল এক ভারতীয় নারীর নিয়ন্ত্রণে।

এক পর্যায়ে তিন দিন পর ভারতীয় ওই নারী জানান, জলিকে সাড়ে চার লাখ রূপিতে বিক্রি করা হয়েছে।

প্রত্যেক মেয়েকে আলাদা রুম দেওয়া হয়েছিল। জলির রুমে একটি বিছানা, ড্রেসিং টেবিল ও রুমের সঙ্গে একটি ছোট টয়লেট ছিল। তাদেরকে তিনবেলা মসুর ডাল ও ভাত দেওয়া হতো।

জলি তার ঘাড়ের আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমার উরুতে, ঘাড়ে ও পিঠে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়।'

তিনি বলেন, 'এতেও তারা থেমে থাকেনি। না খাইয়ে রেখেই আমার ওপর অত্যাচার করত। তাই তাদের প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হই।'

অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সময়ে এক বাংলাদেশি মেয়ের কাছ থেকে মানসিক সান্ত্বনা পেয়েছিলেন জলি। তাকে তিনি বোন বলে ডাকতেন।

সেই বোনের মাধ্যমেই জলি তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পালানোর পরিকল্পনা করেন। জলির মা তাদের জমি বিক্রি করে এক লাখ ৯৫ হাজার টাকা ওই ভারতীয় নারীর কাছে পাঠান, যিনি জলিকে বন্দি করে রেখেছিলেন।

জলিকে রুম দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় তলায়। সেখান থেকে বারান্দার রেলিংয়ে ওড়না বেঁধে নিচে নেমে আসেন তিনি। তার বোন তাকে একটি মোবাইল ফোন এবং দেড় হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বেরিয়ে আসার পর জলি প্রথমে একটি অটোরিকশা নিয়ে আওরঙ্গাবাদ রেলস্টেশনে যান এবং সেখান থেকে মুম্বাইয়ের লোকমান্য তিলক টার্মিনাস স্টেশনে যান। সেখান থেকে ওঠেন কলকাতার ট্রেনে।

জলির সেই 'বোন' আগে থেকেই একজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিল। জলি তার সঙ্গে দেখা করেন এবং তিনি জলিকে সীমান্ত পার হয়ে দেশে ফিরতে সাহায্য করে।

ভারতীয় সীমান্ত পার হওয়ার পর দুই বাংলাদেশি দালাল তাকে নিয়ে রাখে নিজেদের বাড়িতে। সকালে জলি বাড়ি থেকে বের হলে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তের বিজিবি হস্তক্ষেপ করে তাকে উদ্ধার করে।

Comments

The Daily Star  | English

Iranian President Raisi feared dead as helicopter wreckage found

Iran's state television said Monday there was "no sign" of life among passengers of the helicopter which was carrying President Ebrahim Raisi and other officials

44m ago