যে পথে ভুটানের অর্থনীতি
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের পর অস্থির অর্থনীতির তালিকায় পাকিস্তানের নাম ঘুরপাক খেলেও এই তালিকায় আছে বিশ্বের আরও অনেক দেশ। এই বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও সুখী দেশ হিসেবে খ্যাত ভুটানের অর্থনীতির কী অবস্থা?
ভুটানের সংবাদমাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, এ দেশটিও অর্থনৈতিক সংকটে আছে। সরকার ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ভাবতেও শুরু করেছেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার ও কথাবার্তায় তা পরিষ্কার।
সম্প্রতি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং গণমাধ্যমকে জানান, অর্থনীতির উন্নতি না হলে, সরকার অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে পারে। অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন জিনিসের পরিবর্তে অত্যাবশ্যকীয় জিনিস বেছে নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
যদিও দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অত্যাবশ্যকীয় নয় পণ্যের তালিকা এখনো তৈরি করেনি।
২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ভুটানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে। দেশটির আমদানি বাড়লেও রেমিট্যান্স কমেছে। সেসময় রপ্তানি থেকে সামান্য আয় এলেও পর্যটন থেকে কোনো আয় ছিল না।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের মধ্যে আমদানি মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে।
ভুটান ৮০ শতাংশেরও বেশি পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে। যদিও ভুটান ও ভারতের মধ্যে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যার মাধ্যমে ভুটান স্ট্যান্ডবাই ক্রেডিট সুবিধার মাধ্যমে ভারতীয় রুপি ধার করতে পারে।
দেশটিকে রুপির মজুত পূরণ করতে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা মার্কিন ডলার বিক্রি করতে হয়।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২১ সালে ভুটান ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন গুলট্রাম (নিজস্ব মুদ্রা) মূল্যের জ্বালানি আমদানি করেছিল। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে দেশটি ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন গুলট্রাম মূল্যের জ্বালানি আমদানি করে।
২০২০ সালে চাল আমদানি ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন গুলট্রাম থেকে বেড়ে এ বছরের প্রথম ৬ মাসে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন গুলট্রাম হয়েছে।
২০২১ সালে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন গুলট্রামের যানবাহন, বিমান ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন সরঞ্জাম আমদানি করেছে পাহাড় ঘেরা দেশটি। সে বছরের অক্টোবর থেকে গত মে মাসের মধ্যে ৫ হাজারের বেশি যানবাহন আমদানি করেছে।
ভুটানের অর্থমন্ত্রী নামগয় শেরিং গণমাধ্যমকে বলেছেন, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে আমদানির মূল্য ২০২১ সালের মোট আমদানির চেয়ে বেশি ছিল।
'কোভিড-১৯ প্রোটোকল স্বাভাবিক হওয়ায় আমদানি বেড়েছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা যদি ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির দিকে যেতে থাকি, তাহলে এটা নিশ্চিত- চলতি হিসাবে ডেফিসিটের মুখোমুখি হব। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষ হয়ে আসবে।'
সর্বশেষ পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও অর্থমন্ত্রী জানান, ১৪ মাসের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি মেটাতে দেশটির কাছে যথেষ্ট পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে।
ভুটানের সংবিধানে বলা হয়েছে, ১২ মাসের আমদানি মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রাখতে হবে।
ভুটানের অর্থমন্ত্রণালয় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রতিবেদনে ২০২২ সালের দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে এবং ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশটির স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উদ্বেগজনক।
মূল্যস্ফীতি
ভুটানের ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি ২০২০ সালের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। যা রয়েল মনিটরি অথরিটির (আরএমএ) উচ্চ সহনশীলতার মাত্রা ৫ শতাংশের বেশি ছিল। তবে, গত এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশে।
মূল্যস্ফীতি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বেকারত্বের উচ্চ হারের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে ঠেলে দেবে। তাদের পারিবারিক ঋণ বাড়বে।
২০২১ সালের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির পেছনে খাদ্যের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ দায়ী। অন্যান্য খাত দায়ী ৪০ শতাংশ।
বাজেট প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রণালয় বলেছে, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যয় ভুটানের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এটি বাণিজ্যিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। পণ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যয় উৎপাদন প্রতিযোগিতা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে।
এটি অর্থনীতিকেও পঙ্গু করে দিতে পারে কারণ এটি ভুটানের মুদ্রা গুলট্রামের ক্রয় ক্ষমতা কমাবে। ফলে, ভোক্তাদের জন্য পণ্যগুলো আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
রাজস্ব ঘাটতি
ভুটানের রাজস্ব ঘাটতি বছরের পর বছর ধরে বিস্তৃত হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৩৪ বিলিয়ন গুলট্রাম (জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ) রাজস্ব ঘাটতি ছিল। চলতি অর্থবছরে তা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে ১৭ দশমিক ৪৯৮ বিলিয়ন গুলট্রাম (জিডিপির ৯ দশমিক ৩ শতাংশ) হতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশটির অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কমতে থাকলে এই ঘাটতি সর্বকালের সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৮৮২ বিলিয়ন হতে পারে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এই ঘাটতির অর্থায়ন করা হবে শূন্য দশমিক ২৭ বিলিয়ন গুলট্রাম বাহ্যিক ছাড়ের ঋণ ও ২০ দশমিক ৩৫৬ বিলিয়ন গুলট্রাম অভ্যন্তরীণ ঋণের (ট্রেজারি বিল ও দীর্ঘমেয়াদী সরকারি বন্ড) মাধ্যমে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ঘাটতি ও মহামারির কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ ঘাটতি দেখা গেছে। ভুটান মহামারির সংকটকালে কর কমিয়ে দেয়। ফলে, ২০২০ সালে ৫ দশমিক ০১ বিলিয়ন গুলট্রাম হারায়।
বাজেট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য ঘাটতি
পণ্যের দাম ও আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশটির চলতি হিসাবের ঘাটতি (সিএডি) বেড়েছে। সিএডি ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি ১২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে চলতি অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সিএডির সবচেয়ে বড় উপাদান বাণিজ্য ঘাটতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ৭ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিদ্যুৎসহ রপ্তানি ও আমদানি উভয়ই যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ ও ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশটির রপ্তানি ছিল ৫৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন গুলট্রাম যা আমদানি মূল্যের অর্ধেকের কিছু বেশি। ২০২১ সালে আমদানির মূল্য ছিল ৯০ দশমিক ৩২৩ বিলিয়ন গুলট্রাম।
ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ২০২০ সালের ৫১ দশমিক ৩৭৯ বিলিয়ন গুলট্রাম থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ৭১ দশমিক ২৩৬ বিলিয়ন গুলট্রাম হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত
চলতি হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলে। গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ এই অর্থবছরে ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।
মোটের মধ্যে, রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা (সিসি) রিজার্ভ আনুমানিক ১ দশমিক ১৫৭ মার্কিন ডলার ও ভারতীয় রুপি ১৩ দশমিক শূন্য ৭৬ বিলিয়ন। যা ২২ মাসের অত্যাবশ্যকীয় আমদানির অর্থায়নের জন্য যথেষ্ট। (এই হিসাব চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত)
ভুটানের অর্থমন্ত্রণালয় বলছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য নতুন বিনিয়োগ না থাকায় এর নিম্নমুখী প্রবণতায় দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, উল্লেখযোগ্যভাবে আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্ধারিত বিনিময় হার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
দেশটির পর্যটন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় রিজার্ভের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগেও (এফডিআই) তেমন প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
বাহ্যিক ঋণ
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশটির ঋণের পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ২৪৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন (জিডিপির ১৩০ দশমিক ৯ শতাংশ)। ঋণের প্রায় ৮৯ দশমিক ৭ শতাংশই ছিল বৈদেশিক ঋণ। ঋণের বড় অংশ ছিল দেশের ৬ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে।
মোট বৈদেশিক ঋণের ৭৩ শতাংশ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের। অন্যান্য ঋণ ৫৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন গুলট্রাম, যা মোট বিদেশি ঋণের ২৭ শতাংশ।
সূত্র: কুয়েনসেল, দ্য স্টেটসম্যান
Comments