‘শ্রীলঙ্কা থেকে পাকিস্তান খুব বেশি দূরে নয়’

পাকিস্তান
ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

শ্রীলঙ্কার করুণ পরিণতির পর অনেক দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে পাকিস্তানকে নিয়ে কথা বেশি।

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, পাকিস্তানও হয়তো শ্রীলঙ্কার পথে যাচ্ছে বা পাকিস্তানের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।

দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে যখন শ্রীলঙ্কা সময়মতো ঋণ পরিশোধের জন্য লড়াই করছিল, তখন দেশটির বন্দর হাম্বানটোটা চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।

অনেক বিশ্লেষক হাম্বানটোটার পরিণতির নিয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করেছেন। তাদের ধারণা হয়তো পাকিস্তানও এমন সমস্যায় পড়তে পারে।

২০১৫ সাল থেকে চীনা কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অধীনে।

শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার মতো পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদরে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে চীন। এটি পাকিস্তানে সিপিইসির উপকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।

কেউ কেউ আশঙ্কা করেছেন, যদি গোয়াদরে চীনা প্রভাব আরও বাড়ে তাহলে সেখানেও শ্রীলঙ্কান বন্দরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান আলোচনায় এসেছে। পাকিস্তানেরও একই পরিণতি হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এই প্রশ্নের বড় কারণ পাকিস্তানেরও অর্থনীতি নড়বড়ে। যা এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশটির যুবকদের বড় অংশ বেকারত্বে ভুগছেন। মূল্যস্ফীতির হারও আকাশচুম্বী।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি লড়াই করছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দর ২৪০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। খোলা বাজারে এক ডলার ২৫০ রুপিতেও বিক্রি হয়েছে। দেশটির ইতিহাসে রুপির রেকর্ড দরপতন।

রুপির অবমূল্যায়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস করছে, যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে, পাকিস্তানের জন্য এই সংকটে আশার খবর হলো: গত এক সপ্তাহ ধরে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির উন্নতি হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় ডলারের বিপরীতে রুপির দর ছিল ২২৪।

বিশ্লেষকরা চীনের ঋণ নিয়ে পাকিস্তানের যে আশঙ্কার কথা বলছেন তা হয়তো একটু বেশিই বলা হচ্ছে। চীনা ঋণের চেয়ে পাকিস্তানের সংকটময় অর্থনীতির জন্য নিজেদের অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বেশি দায়ী।

এ ছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কও সে দেশের জন্য নেতিবাচক দিক।

এখানে একটি বিষয় বলা দরকার। তা হলো—সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের পতন। তিনি ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং তার ক্ষমতায় আসার পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাত ছিল বলে মনে করা হয়।

গত এপ্রিলে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে আকস্মিক তার মেয়াদ শেষ হয়। তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনেও নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে মনে করা হয়। ইমরান নিজেই বিভিন্ন সময়ে এই অভিযোগ করেছেন।

সবমিলিয়ে সৌদি আরব ও তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই ২ দেশ এবং এর আগে প্রয়োজনের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে তারা। পাকিস্তানের 'সবসময়ের বন্ধু' চীন সিপিইসি প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। ইমরান খানের শাসনামলে এসব প্রকল্পের গতি কমে যায়। ফলে, পাকিস্তানের সংকটময় অর্থনীতি আরও সংকটে ডুবতে শুরু করে।

সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি। আফগানিস্তানে তালেবানদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ ছিল।

জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইমরান খানকে ফোন দেননি। এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। ইমরান আরও এক ধাপ এগিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া সফর করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। মস্কো যেদিন ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরু করে সেদিন ইমরান খান রাশিয়া সফরে ছিলেন।

পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করা খুবই কঠিন। তাদের রাজনীতি কখন কোন দিকে মোড় নেবে তা ধারণা করাও দুষ্কর। যে কারণেই হোক আর যেভাবেই হোক পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে যখন ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন তিনি তার পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেন।

গণমাধ্যম ও জনসমাবেশে ইমরান দাবি করেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তার কৌশল ছিল মার্কিনবিরোধী প্রচারণা। নির্বাচনে জিততে ও পাকিস্তানের মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগাতে তার এই কৌশল কাজে দিয়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের উপ-নির্বাচনে তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন।

পাকিস্তানের শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্থা রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা এবং প্রভাব প্রসারিত করেছে। এটা পাকিস্তানের জন্য খুবই সাধারণ বিষয় যে, দেশটির ক্ষমতায় যেতে হলে সামরিক বাহিনীর অঘোষিত সমর্থন দরকার হয়।

নিরাপত্তা সংস্থার এই হস্তক্ষেপ দেশটিতে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করেছে এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে নতুন সরকার অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা করছে। যেন ২ বিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়া যায়।

যদি বিদ্যমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে যায়, তবে আইএমএফের কাছ থেকে এই প্যাকেজটি পাওয়া বেশ কঠিন হবে। যদিও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ভয়াবহ হয়ে ওঠলে আইএমএফের কাছে যাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে পাকিস্তানের। তাই বলা যায়, এটি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশার দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট যখন প্রকট আকার ধারণ করছে, তখন শ্রীলঙ্কার সমান্তরাল বিষয়গুলো উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। শ্রীলংকার মতো পাকিস্তানও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমবর্ধমান ঘাটতির মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্য ও জ্বালানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয়তা পণ্য আমদানি করার ক্ষমতা সীমিত করছে।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি তলানিতে গিয়ে ঠেকে তাহলে পাকিস্তানেও গণবিক্ষোভ শুরু হয়ে যেতে পারে।

পাকিস্তানি কলামিস্ট জাহিদ হুসেন সতর্ক করে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি এড়াতে পাকিস্তানকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনে এক কলামে তিনি লিখেছেন—কী কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতন ঘটেছে, তা স্পষ্ট। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে পঙ্গু হয়ে পড়া দেশটি জ্বালানির মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি করতে সক্ষম হয়নি। তাদের এই সংকট বহু বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল। কারণ, দেশটি ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ জর্জরিত ছিল।

তার মতে, পাকিস্তানসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ আছে যারা একই রকম দুর্দশার মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা হয়তো এখনো শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে নেই, কিন্তু সেই পরিস্থিতি থেকে খুব বেশি দূরেও নেই। তার মতে, সেখানেও শ্রীলঙ্কার মতো অনেক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। তিনি মনে করেন, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তান খুব বেশি দূরে নয়।

দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাচ্ছে। পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা যদি এই সতর্কীকরণ লক্ষণগুলো উপেক্ষা করতে থাকেন, যেমনটা তারা অতীতে সব সময় করে এসেছে। তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে, যেমনটা শ্রীলঙ্কায় হয়েছে এবং হচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago