মোসাব আবু তোহা

ধ্বংসস্তূপ থেকে স্বপ্ন দেখানো কবি

মোসাব আবু তোহা একজন ফিলিস্তিনি কবি ও সাহিত্যিক। যিনি কবিতার মাধ্যমে গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং মানবতার আর্তনাদকে তুলে ধরেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন জানার ও বাঁচার। গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি যে শব্দ-জগত তৈরি করেছেন, তা শুধুমাত্র প্রতিরোধের ভাষা নয় বরং এক নতুন স্বপ্নের কথাও বলে।

আবু তোহা জন্মগ্রহণ করেন গাজা উপত্যকায়, যেখানে শৈশব থেকেই অবরোধ, সহিংসতা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন। যেখানে যুদ্ধ ও অবরোধ ছিল নিত্যসঙ্গী। তার কবিতার প্রতিটি শব্দে মিশে থাকে বাস্তবতা। গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ভূখণ্ডে বেড়ে ওঠায় তার জীবনে শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা এসেছে। এই বাস্তবতা তাকে ভেঙে দেয়নি; বরং সৃজনশীলতা আরও শাণিত হয়েছে।

তার শিক্ষা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক সীমারেখায় আবদ্ধ ছিল না; তিনি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি তরুণদের মধ্যে সাহিত্যপ্রেম ছড়ানোর কাজও করেছেন। ২০১৪ সালে ইসরায়েলি আক্রমণের সময় গাজায় থাকা প্রায় সমস্ত পাঠাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনায় মোসাব ব্যক্তিগত উদ্যোগে "গাজার ইংরেজি ভাষা লাইব্রেরি" প্রতিষ্ঠা করেন। এটি গাজায় প্রথম ইংরেজি ভাষার বইয়ের পাঠাগার, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় গড়ে ওঠে। এই লাইব্রেরি কেবল বইপাঠের স্থান নয়; এটি গাজার তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সৃষ্টিশীলতার এক কেন্দ্র। এইভাবে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন নিজেকে গাজার ক্ষতিগ্রস্ত লাইব্রেরি এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে বইয়ের মাঝে।

মোসাব আবু তোহা একসময় একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন: "কবিতা এমন একটি ভাষা, যা আমাদের ক্ষত এবং আমাদের যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরতে পারে, কিন্তু তা থেকেও একটি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।" তার কবিতাগুলো তাই নিছক ক্ষোভের প্রকাশ নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে কাজ করে।

তার কবিতায় যা বিশেষ তা হলো, তিনি শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের সংকটের কথা বলেন না, বরং মানুষের একত্রিত হওয়ার এবং একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্মাণের সম্ভাবনার কথাও বলেন। তিনি জানেন যে, যুদ্ধের পরে মানুষের জন্য এক নতুন জীবনের সূচনা হয়, এবং এই বিষয়ে তাঁর কবিতাগুলোতে নানা সূক্ষ্ম ভাবনা দেখা যায়।

মোসাব আবু তোহার কবিতা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয় বরং মানবতার প্রতি একটি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রজ্ঞার প্রকাশ। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে একটি বিশ্বস্ত এবং স্থিতিশীল সমাজের চিত্র আঁকেন, যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহায়ক হতে পারে।

কবিতায় যুদ্ধ ও জীবনের রূপায়ণ 

আবু তোহার কবিতা ফিলিস্তিনিদের জীবনের গভীর বাস্তবতা, যুদ্ধের নিঃস্বতা, এবং মানবতার প্রতি আকুতি নিয়ে কথা বলে। তার প্রথম কবিতার সংকলন Things You May Find Hidden in My Ear  ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের সংগ্রাম এবং মানবাধিকারের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে গভীরভাবে উপস্থাপন করে।  একটি বিখ্যাত কবিতায় তিনি লেখেন:

"আমি এমন এক স্থানে বাস করি যেখানে জল নেই/ কিন্তু রক্ত আছে/ যেখানে আকাশ ভরা ড্রোনে/ কিন্তু মাটিতে কোন রুটির নেই।"  

এই পংক্তিমালায় তার জীবনের দুঃখ এবং আশার প্রকাশ স্পষ্ট। তিনি যুদ্ধের মাঝে জীবন খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং ধ্বংসের মধ্যেও স্বপ্ন বুনতে থাকার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। 

মোসাবের কবিতাগুলোতে যুদ্ধের তীব্রতা এবং শান্তির আকাঙ্ক্ষা অনন্যভাবে প্রকাশিত। যেমন- "আমার প্রতিবেশী একটি তাঁবুতে জন্মেছে/ আমার বন্ধু একটি তাঁবুতে জন্মেছে/ আমি নিজেও একটি তাঁবুতে জন্মেছি/ তাহলে, আমার সন্তানদের জন্ম কোথায় হবে?"  

মোসাবের কবিতাগুলোতে যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট। ধ্বংসাবশেষ, শরণার্থী শিবির, এবং ক্রমাগত অবরোধ তার লেখার প্রধান বিষয়। তার কবিতায় দেখা যায়, যুদ্ধ কীভাবে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে এবং মানবতার মৌলিক অধিকারগুলোকে কেড়ে নেয়।

এই লাইনগুলো শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, বিশ্বের সমস্ত শরণার্থীদের অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। তার কবিতাগুলোতে একটি অবরুদ্ধ জীবনের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও, তা কখনো সহিংসতায় পরিণত হয়নি; বরং তা মানবতার জন্য এক গভীর আকুতি। মোসাবের লেখা প্রতিরোধের ভাষা ধারণ করে।

ধ্বংসস্তূপের নিচে, আমরা খুঁজি/ একটি গাছের স্মৃতি।

এখানে "গাছের স্মৃতি" শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, বরং জীবনের প্রতি এক প্রতিশ্রুতির প্রতীক। আবু তোহার কবিতা একদিকে যেমন প্রেম এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে, তেমনি অন্যদিকে সমাজ, যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অসঙ্গতির মতো জটিল বিষয়গুলো নিয়ে লেখে। তাঁর কবিতাগুলোকে যদি দুইটি প্রধান থিমে বিভক্ত করা যায়, তবে তা হবে "সংগ্রাম" এবং "আশা"। তাঁর কবিতার ভাষা সরল কিন্তু গভীর, এবং সেখানে অস্থিরতা ও শান্তির চিরন্তন দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার মধ্যে তিনি লিখেছেন:

আমরা যারা রাস্তায় হাঁটছি/ তারা কখনোই শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাব না/ আমাদের পদধ্বনি এখনও প্রজন্মের পর প্রজন্ম/ আমাদের যুদ্ধের কাহিনী বলে যাবে।

মোসাবের কবিতাগুলোতে যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট। ধ্বংসাবশেষ, শরণার্থী শিবির, এবং ক্রমাগত অবরোধ তার লেখার প্রধান বিষয়। তার কবিতায় দেখা যায়, যুদ্ধ কীভাবে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে এবং মানবতার মৌলিক অধিকারগুলোকে কেড়ে নেয়।  তিনি লিখেছেন: 

গাজায়, আমরা রুটির স্বপ্ন দেখি/  স্বাদের জন্য নয়/  কিন্তু আমাদের ক্ষুধার্ত হাতে এর গুরুত্বের জন্য।

মোসাবের কবিতাগুলো ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও জীবনের গল্প বলে। একদিকে ধ্বংসের চিত্র থাকলেও অন্যদিকে তিনি জীবনের প্রতি মানুষের দৃঢ় প্রত্যাশা এবং প্রতিরোধের মানসিকতাকে তুলে ধরেন। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন: 

ধ্বংসস্তূপের নিচে আমি একটি নোটবুক খুঁজে পেলাম/ এটি এক বালকেরৱ, যে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখত।/ধ্বংসস্তূপ তার স্বপ্নকে চাপা দিতে পারেনি।

এই লাইনগুলো প্রমাণ করে, মানবতার স্বপ্ন কখনো ধ্বংস হয় না। ধ্বংসস্তূপের নিচেও স্বপ্ন বেঁচে থাকে, এবং সেই স্বপ্নই প্রতিরোধের শক্তি।  মোসাবের কবিতায় যুদ্ধ শুধু ধ্বংসের ভাষা নয়, বরং মানবতার পুনর্জন্মের প্রতীক। তিনি কবিতার মাধ্যমে শান্তি এবং সহানুভূতির আহ্বান জানান। তিনি বলেন: 

আমি স্বপ্ন দেখি একটি আকাশের, যেখানে ড্রোন নেই/ একটি আকাশ, যেখানে শিশুরা মেঘ আঁকে/ বোমার ভয় থেকে পালায় না।"

মোসাবের লেখায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি স্পষ্ট। তার কবিতা শুধু যুদ্ধের বেদনার গল্প নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের অবিচল মনোভাব এবং জীবনের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা বলে। 

"ছাইয়ের মধ্যেও/ একটি ফুল ফুটতে পারে/ সবচেয়ে অন্ধকার রাতেও/ একটি মোমবাতি জ্বলে উঠতে পারে।"

লাইনগুলো প্রমাণ করে যে, প্রতিটি বিপর্যয়ই নতুন আশার জন্ম দেয়। মোসাবের সাহিত্য প্রতিরোধের এক নিঃশব্দ অথচ প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর। তার লেখায় প্রতিটি শব্দ শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের অবস্থার চিত্রায়ণ নয়, বরং এটি বিশ্ববাসীর কাছে একটি আবেদন—বিবেককে জাগ্রত করার। তিনি বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে কবিতার মাধ্যমে মানবতার পুনর্নির্মাণ সম্ভব। 

তোহার জীবন এবং সাহিত্য আমাদের শেখায় কীভাবে সংগ্রামের মধ্যেও সৃষ্টিশীলতার আলো জ্বালানো সম্ভব। তার কবিতাগুলো ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নেওয়া স্বপ্নের গল্প, যা কেবল ফিলিস্তিন নয়, সমস্ত শোষিত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। তার সাহিত্যিক যাত্রা একটি প্রমাণ যে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতাই হতে পারে শান্তি এবং মানবতার সর্বোত্তম হাতিয়ার।

মোসাব আবু তোহা বর্তমানে নিউ ইয়র্কের সিরাকিউজে বাস করছেন, যেখানে তিনি গাজায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে মনোনিবেশ করেছেন, বিশেষত তার সর্বশেষ কবিতা সংগ্রহ "ফরেস্ট অফ নয়েজ"-এর মাধ্যমে। একইসঙ্গে, তিনি সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রায়শই দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে লেখেন এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

Comments

The Daily Star  | English
Polytechnic students protest Bangladesh 2025

Polytechnic students issue 48-hr ultimatum over six-point demand

Threaten a long march to Dhaka if govt doesn't respond to demands

2h ago