বইমেলা বিশেষ ৩

‘মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি দায়ী’

আলফ্রেড খোকনের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি। ছবি ফেসবুক থেকে 

চলছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশ হবে কবি আলফ্রেড খোকনের কবিতার বই। গণ অভ্যুত্থান ও নিজের লেখালেখি-বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

বইমেলা এলেই কবি লেখকদের এক ধরনের প্রকানা উৎসব চলে। সারাবছর নয় কেন?

আলফ্রেড খোকন : কারণ, সারা দুনিয়াতে মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে, একমাসজুড়ে একটি রাষ্ট্রের সর্বস্তরের জনগণের এত বড় সম্মিলন পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। আবার বইয়ের বাজার বিচেনায় এই মেলাটা তো দীর্ঘসময় ধরে হয়, ফলে অধিক বইয়ের প্রকাশ ঘটে। 

আরেকটি কারন উৎসবের লেখক। একমাসে প্রায় ৪০০০ এর অধিক বয়ের প্রকাশ পৃথিবীর কোনো দেশে পায় কিনা আমার জানা নেই।

উৎসবের সবাই লেখক নন। এদের অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ড্রপআউট শিক্ষার্থীর মত। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে মাঝপথে ঝরে যায়। এদের অনেকে প্রথম লেখা কিছু হল বা না হল, বই হয়ে যায়। প্রথমে উত্তেজনা নিয়ে নিজপকেটের পয়সা খরচ করে বই বের করে। অটোগ্রাফ দিয়ে বই উপহার দেয়। ছবি তোলে ইত্যাদি। তবে এ আকাঙ্খাটা মন্দও নয়। তাদের কারণে উৎসবের একটা জানালা কিন্তু খোলে। আর যারা ক্রমশ লিখে লিখে পাঠকের কাছে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে লেখক হন, তাদের বই কিন্তু বছর বছর, গন্ডায় গন্ডায় প্রকাশ পায় না। এই মেহনতী লেখকদের সারাবছরই দেখা যায়। তারা কখনোই কেবলমাত্র উৎসবের মুখ হতে চান না। অনেক লেখকের তো মেলায় বই আসে না। 

বলা যায়, মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি দায়ী। যে কোনো দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই সে দেশের অন্যান্য সংস্কৃতি নির্মাণ করে। আমাদের বইপ্রকাশের সংস্কৃতিটা এখন মেলামুখী হওয়ার কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন মৌসুমী ফলের মত। ভোট এলেই  ধুমধাম শুরু হয়, তখন গণতন্ত্র থেকে শুরু করে সবকিছু মুখের কাছে সহজলভ্য হয়ে যায়।  নেতারা জনগণের বাড়ির উঠোনে হাজির হন। ভোট চলে গেলে সব প্রতিশ্রুতি হাওয়া হয়ে যায়। আমাদের সবকিছু এখন সিজন্যাল হয়ে গেছে। রাজনীতির এই মৌসুমী সংস্কৃতির প্রভাব সর্বত্র।  

প্রাণহীন ঢাকায় থেকেও আপনার কবিতা প্রাণে ভরপুর। এই শক্তি কিভাবে একজন কবির হয়?

কবির কাজ যেখানে প্রাণ নেই, সেখানে প্রাণের সঞ্চার করা। যে ঢাকাকে আপনি প্রাণহীন বলছেন, সেই ঢাকায় খুঁজে দেখুন প্রাণ পাবেন।  প্রাণ না থাকলে এ শহর মৃতপুরী হয়ে উঠত। প্রাণ তো বিরিয়ানির প্লেটে থাকে না, প্রাণ থাকে শাক-ভাতের থালায়। যে জন্মান্ধ ভিক্ষা করে খায়, তার থালায় যখন দু'চারানা আধুলি-সিকি পড়ে, তাতে জীবনের যে ধ্বনি রচিত হয়, তা অনেক প্রাণময় (যদিও আমি ভিক্ষাবৃত্তির সমাজ চাই না)। আবার প্রতিদিন যে লক্ষটাকার কারবার করে, দেখবেন তার জীবনে ভোগ আছে, প্রাণ নেই। টাকা গোনার সময়টুকু ছাড়া সে কেমন স্থবির। 

আমার কবিতায় যদি কোনো প্রাণশক্তির দেখা পেয়ে থাকেন তা আসলে বাংলার গ্রাম থেকে আসে। এই শহরে থেকেও আমি দৃশ্যত গ্রামে বাস করি, বাস্তবে এবং স্বপ্নে গ্রামে চলে যাই। গাড়ি চালাতে যেমন ফুয়েল লাগে, আমার চলতে গ্রাম লাগে। সপ্তাহান্তে যে কোনো গ্রাম গিয়ে চলার শক্তি নিয়ে ফিরে আসি।

 গণঅভ্যুত্থান সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজে কতটা কীভাবে প্রভাব রাখে?

গণঅভ্যুত্থান চিরকাল একটি সমাজে, সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আবার গণ অভ্যুত্থানের জমিনও তৈরি করে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ।  ৬৯ এবং ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা যেমন ছিল, তেমনি ২৪ এর গণ অভ্যুত্থানেও ছিল। এটা প্রাকৃতিক। কেউ নেপথ্যে, কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ মৌন সমর্থনে থাকে, থাকছে। 

২৪ এর গণ অভ্যুত্থানেও আমরা চোখের সামনে যে মুখগুলিকে সংগ্রামশীল দেখেছি, তার পেছনেও রয়েছে বহু মানুষের ভূমিকা। ধরুণ কবি রকিব লিখনের 'যদি তুমি ভয় পাও/তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/ তুমিই বাংলাদেশ'। এই পঙক্তি কিন্তু গণ অভ্যুত্থানের আগেই রচিত, যা বিস্ফোরিত হয়েছে এই অভ্যুত্থানে। এরকম অনেক কবিতা এই আন্দোলনে প্রেরণার অংশ হয়ে আছে। শুন্য ব্যান্ডের 'শোন মহাজন' গানটি জেন জেট জেনারেশনকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে, যদিও গানটি আগেই লেখা। আবার র‌্যাপার হান্নান এর 'আওয়াজ উডা' এবং সেজান-এর 'কথা ক'- এই র‌্যাপ গান জুলাই বিদ্রোহের অন্যতম অংশ হয়ে উঠল। এর জন্য তো শিল্পী জেল খেটেছেন। প্রচন্ড গরমে আন্দোলনরত ছাত্রজনতা যখন তৃষ্ণায় কাতর তখন মুগ্ধ'র পানি বিতরণ এক অসাধারণ সামাজিক ভূমিকা। মুগ্ধ জীবন বিসর্জন দিতেও কার্পণ্য করেনি। এইভাবে গণ অভ্যুত্থান মানুষের বিবেক জাগ্রত করে। সাহসী করে, প্রতিবাদী হতে শেখায়।

কে যে কবি কে যে রাজনৈতিককর্মী ফেসবুকে আলাদা করা কঠিন। আপনার এ-সব চোখে পড়ে?

প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর আছে। প্রশ্নটা রসোত্তীর্ণ। তারপরও বলি, আমি ফেসবুকে আছি অনেকটা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত। সেই ঝলকানিতে নিজের অন্ধকার দেখার চেষ্টা করি। অনেক কিছুই চোখে পড়ে। কেউ নগ্ন হয়ে বের হলে যেমন চোখে পড়ে, আবার কেউ সুন্দর জামাকাপড় পরে বের হলেও চোখে পড়ে।

আপনার একটা কবিতার লাইন- জেগে থাকি আলোহীন। এখন সময় কেমন? 

'জেগে থাকি আলোহীন' মানে অন্ধকারে জেগে থাকা। পজেটিভলি নেগেটিভ। অন্ধকার সহজে কাটে না। সবসময়ই সকলের জীবনেই এমন সময় আসে যায়।  

বাংলাদেশের কবিতার স্বতন্ত্রস্বরটা কোথায়?

যে কোনো একটি নির্দিষ্ট এবং স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের স্বর ও সুর অন্য যে কারও থেকে এমনিতেই স্বতন্ত্র। ভারতের বাংলা কবিতা আর বাংলাদেশের বাংলা কবিতার স্বর ও সুর আলাদা নয়? অবশ্যই আলাদা। কারণ জমিনই তো আলাদা। আমার ভাষার স্বর, সুর ও জমিন ওদের ভাষার সঙ্গে মিলবে না। তবে কিছু মিল সব দেশের সঙ্গে সবদেশেরই থাকে। 

Comments

The Daily Star  | English
remittance earning of Bangladesh

Remittance rises 30% in July

Migrants sent home $2.47 billion in the first month of the current fiscal year

5h ago