পর্যালোচনা

সৈয়দ জামিল আহমেদের গ্রন্থে ইসলামের দৃষ্টিতে থিয়েটার

উপমহাদেশে প্রচলিত ইসলামের মধ্যে বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলো- নিরাকার ও অদেখা সত্ত্বাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং কোনো প্রতীক সামনে না রেখে প্রার্থনা করা। এই অঞ্চলের প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ধর্ম পালনের সময় মনোযোগ ধরে রাখতে ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত স্বরূপ সামনে রাখেন। এই বিষয়টি ইসলাম ধর্মের দার্শনিক ভাবনাকে অনেক বেশি স্বতন্ত্র করে তুলেছে। নাট্য পরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ 'ইন প্রেইজ অফ নিরাঞ্জন: ইসলাম, থিয়েটার ইন বাংলাদেশ' বইতে এমন চিন্তাই হাজির করেছেন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের লেখা বইটি প্রকাশ পায় আরও দুই যুগ আগে। এতে তিনি ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে থিয়েটারের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। ইংরেজি বইটি প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। 

বইয়ের প্রথম দুই অধ্যায়ে তিনি ইসলামি দুনিয়ায় থিয়েটারের প্রচলন ও চর্চা নিয়ে ঐতিহাসিক জায়গা থেকে আলোচনা করেছেন। মাঝের দুই অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থিয়েটারে ইসলাম ঘরানার উপস্থাপনের পাশাপাশি বিষাদ সিন্ধুর নাট্যরূপ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। শেষে আরব্য রজনীকে কেন্দ্রে রেখে সংস্কৃতিভেদে ধর্ম ও সাহিত্যের পরিবর্তন নিয়ে আলাপ তুলেছেন। প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সংযুক্ত করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ছবি।


ইসলামের প্রাথমিক যুগে পারফর্মিং আর্টের যে প্রচলন ছিল তা তুলে ধরতে কিছু হাদিস উল্লেখ করেছেন জামিল আহমেদ। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে যে কোন সমস্যা সমাধানে জ্ঞানীদের ঐক্যমত (কিয়াস) হয়ে সমাধান করাকে, তিনি ইসলাম ধর্ম চর্চায় ব্যক্তির জায়গা থেকে সমষ্টিগত ধারণায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। তাতে দেখাচ্ছেন, নিরাকার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস এবং একইসাথে সমষ্টিগতভাবে জটিল দর্শনকে ধারণ করার বিষয়টি ইসলাম ধর্মচর্চাকে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। তবে দেশ, সংস্কৃতি ও ভাষাভেদে শিল্পচর্চায় অনেক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। পুরো বিষয়টাকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় থিয়েটার দিয়ে।

সৈয়দ জামিল আহমেদ তার বইতে থিয়েটারের প্রারম্ভিক আলাপে দৃশ্যমান ছবি নিয়ে কথা বলেছেন। ধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ছবি আঁকা ও ছবি তোলা নিষেধ বলে প্রচার করা হলেও একাধিক হাদিস উল্লেখ করেছেন, যেখানে চিত্র অঙ্কন (ফিগার ড্রয়িং) ও পারফর্মিং আর্টের উল্লেখ পাওয়া যায়। সে হিসেবে আজকে আমরা যে থিয়েটার দেখতে পাই, তা দিনে দিনে অনেক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

এক ধরনের চিন্তার ওপর বসে থাকা যাবে না। নানা ধরনের চিন্তা, দর্শন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আসবে, আর এটিই মূলত একটি বৈচিত্র্যময় শিল্পের জায়গা তৈরি করবে। আর এ কথা ঠিক যে, শিল্পের জায়গাই হলো নানা ধরণের মতামতকে গ্রহণ করে সেগুলোর ভাষা তৈরি করা।

যদিও থিয়েটারের সঙ্গে ইসলামের এই আলাপে সৈয়দ জামিল আহমেদের ব্যাখ্যার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা দেখতে পাই। প্রথমত, হাদিসে চিত্র অঙ্কন ও পারফর্মিং আর্টের বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা দেয় এরকম উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি এসব কিছুকে নেতিবাচকভাবে দেখে এরকমও হাদিস রয়েছে। এই অবস্থায় হাদিসগুলোর প্রেক্ষাপট, সনদ ও মর্মার্থ বিবেচনা করে যেভাবে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা হয়, তার কোনটিই তুলে ধরেননি। এরকম মুখোমুখি হাদিসের ক্ষেত্রে একমুখী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার বিষয়টি হালকা হয়ে যায়।

এছাড়াও বইতে ইসলামিক বিশ্বে থিয়েটারের আধিক্য না থাকার পেছনে আরবদের নাট্যকলা সম্পর্কে ধারণা না থাকার বিষয়কে দায়ী করেছেন সৈয়দ জামিল। এক্ষেত্রে তিনি ধার করেছেন প্রফেসর জ্যাকোব লান্ডাউয়ের মতামতকে। প্রফেসর জ্যাকোব লান্ডাউ আরবে নারীদের পারফর্মিং আর্টে যুক্ত না হওয়ার বিষয়টিও থিয়েটার অগ্রসর না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, লেখক সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রফেসর জ্যাকোবের এই যুক্তিকে তর্কের প্রশ্ন হিসেবে ধরলেও, নিজেই প্রথম অধ্যায়ে রেফারেন্সসহ আরবে পারফর্মিং আর্টে নারীদের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। বোধ করি দুটো বিষয় সাংঘর্ষিক। 


শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা যতটা না বেশি, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। এর সাথে বোধ করি লেখকও একমত হবেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর মহাপরিচালক পদে যোগদান করার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এক ধরনের চিন্তার ওপর বসে থাকা যাবে না। নানা ধরনের চিন্তা, দর্শন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আসবে, আর এটিই মূলত একটি বৈচিত্র্যময় শিল্পের জায়গা তৈরি করবে। আর এ কথা ঠিক যে, শিল্পের জায়গাই হলো নানা ধরণের মতামতকে গ্রহণ করে সেগুলোর ভাষা তৈরি করা।

২০১৯ সালের মার্চে শহীদুল জহিরের উপন্যাস অবলম্বনে সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' নাটকটি প্রদর্শন হয়। সেসময় রামেন্দু মজমুদার, আতাউর রহমানসহ আরও অনেকে নাটকটির সমালোচনা করেন। এমনকি উপন্যাসের হুবহু সংলাপ তুলে ধরার পরেও সৈয়দ জামিলের নাটকটির বিরুদ্ধে 'ইতিহাস বিকৃত' করার অভিযোগ করেন তারা। সেসময় রামেন্দু-আতাউরের এই ধরণের বক্তব্য যতটা না শিল্পমানের দৃষ্টি ছিল; তারচেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। সেসময়ও গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সৈয়দ জামিল বলেছিলেন, 'যদি পাবলিক স্পেসে বিভিন্ন ধরণের মতামত ও কথা যদি না আসে, সবাই যদি একই রকম চিন্তার চর্চা চালিয়ে যায়, তাহলে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো  সুবিবেচনার পথ দেখাবে না'।

সৈয়দ জামিল আহমদের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় এই ধরণের রাজনীতি সচেতন ভূমিকার অনেকটুকু উঠে এসেছে, তার 'ইন প্রেইজ অফ নিরাঞ্জন: ইসলাম, থিয়েটার ইন বাংলাদেশ' বইয়ে। বিশেষ করে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লিখেছেন, অ্যাকাডেমিক গবেষণার কাজে তিনি গ্রাম বাংলার থিয়েটার দেখতে গিয়ে বেশ চমকে যান। কারণ সেখানে ধর্মীয় সংবেদনশীল অনেক বিষয় এত সরলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে, দর্শকদের কাছে তা একদমই স্বাভাবিক ও জীবনের অংশ বলেই মনে হয়। অপরদিকে রাজধানীর মতো শহরের বুকে থিয়েটার প্রদর্শনীতে চাইলেই এত সরলভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। কারণ সৈয়দ জামিলের অভিযোগ, নাটকের শুরুর সংলাপে নেহায়েত সালাম দেয়ার কারণে তাকে 'জামাত' বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, শহুরে অভিজাত শ্রেণীদের কাছে থিয়েটার গ্রহণ করার যে মনস্তাত্ত্বিক ন্যারাটিভ, গ্রাম বাংলার ক্ষেত্রে তা একদমই আলাদা। 

সৈয়দ জামিল আহমেদ শিল্পের জটিলতা দূর করার জন্য বেছে নিয়েছেন মিথকে। তার দাবি আরবের থিয়েটার চর্চা আরও অনেক বেশি অগ্রসর হতো, যদি তারা শুরু থেকেই ইসলামের চমৎকার মিথগুলোকে থিয়েটারে নিয়ে আসত। কারণ উপমহাদেশে ভারত যেমন হিন্দু মিথলজি তাদের থিয়েটারে প্রবলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে, তার তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জায়গায় মুসলিমরা ইসলামি মিথলজিগুলোকে খুব কমই নিয়ে আসতে পেরেছে। এছাড়াও একসময় থিয়েটারকে কবিতার একটি দৃশ্যমান রূপ হিসেবে চিন্তা করার কারণেও ইসলামি ঘরানার থিয়েটারে বিচিত্রতা আসতে অনেকটা দেরি হয়েছে। 

তবে সৈয়দ জামিল খুব সংক্ষেপে ইসলাম ধর্মের মূল বিমূর্ত ধারণার বিষয়টি স্পর্শ করে গেলেও, এটি যে ইসলামি দুনিয়ায় থিয়েটার চর্চায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ না দেখে আল্লাহর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করার যেই বিমূর্ত ধারণা তা ইসলামের শিল্প-সাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রাচীন গ্রিক শিল্পকলায় নিখুঁতভাবে অস্তিত্ব আঁকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও ইসলামি শিল্পকলায় আর্টের প্রচলন ঘটেছে বিমূর্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে।

এখনও উপমহাদেশে যেসব ইসলামি চিত্রকলা দেখতে পাওয়া যায়, তার পুরোটাই বিমূর্ত ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের উৎসবগুলোতে যেই ধরণের রঙিন অঙ্কন (আলপনা) করা হয়, তা অনেকটাই বিমূর্ত। ইসলামি চিত্রকলার বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মূল যেই ভিত্তির উপর ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে (নিরাকার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস), সেই বিষয়টিই শিল্পকলায় বিমূর্ত ধারণা জন্ম দিতে সাহায্য করেছে। সৈয়দ জামিলের বইতে উল্লেখিত ধারণার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।   


আলোচ্য বইটির বাইরেও সৈয়দ জামিল আহমেদের অন্যান্য লেখায় আমাদের অঞ্চলে ইসলাম চর্চায় সাংস্কৃতিক জটিলতা ও ক্ষেত্রভেদে সেসব বিষয়ে প্রস্তাবনা দিতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে ওয়াজ মাহফিলের মতো আঞ্চলিক যোগাযোগের মতো একটি মঞ্চে, পশ্চিমা নীতির সমালোচনা যেভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে সার্বজনীন করতে পেরেছে। তেমনি একই মঞ্চে নারীর প্রতি অহেতুক বিরূপ মনোভাব ও বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনাকে তিনি একটির সঙ্গে অপরটির সাংঘর্ষিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। 

সৈয়দ জামিল আহমেদের চিন্তায় ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের শিল্পকলা বিশেষত থিয়েটার ভাবনায় কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা থাকলেও, আদতে উপমহাদেশে থিয়েটারে ইসলামি ঘরানার উপস্থিতি ও 'কালচারাল হেজিমনি' সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার চিন্তা করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় উপস্থাপন ও রাজনৈতিক চিন্তার যে বিতর্ক, সে ক্ষেত্রে শিল্পকলায় তার চিন্তা কতটা ভূমিকা রাখবে সেটিই বড় প্রশ্ন।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago