অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকার

প্রেম ও বিদ্রোহ দুটোই সমান আমার : মুর্তজা বশীর

চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। ছবি: স্টার

প্রেমিক ও বিপ্লবীকে কখনও আটক, বৃত্তবন্দি কিংবা পন্থাচ্যুত করা যায় না। কারণ, তারা দুটোতেই নিবেদিত থাকেন, আত্মোৎসর্গিকৃত হন। মুর্তজা বশীরের শিল্প সৃজন-গবেষণা আর ব্যক্তিচেতনা, যাপিত জীবন প্রেম ও বিদ্রোহ ঠিক তাই, যা হয়ে উঠেছে শিল্পের দীপিত এক স্মারক।

দ্রঢ়িষ্ঠ এক মানুষ তিনি। প্রেম ও বিদ্রোহে সমান উচ্চকিত। দেখানেপনা কিংবা তাফালিংয়ে ছিলেন না কখনও। তিনি যেন নার্সিসাস-র এপিঠ-ওপিঠ। তিনি মুর্তজা বশীর। বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনে অবিসংবাদিত, অনিবার্য এক নাম। যা ইচ্ছে তাই করেন, করে চলেছেন। ঘর-বাইর, সমাজ-প্রতিষ্ঠান, বন্ধু-বান্ধব, আত্মজ-অনাত্মজ কে কী ভাবল, কে কী ভাবেন সবই থোড়াই কেয়ার করেন অমিত তেজে, শিল্পের সুষুমায়। ধারণ করেন সময়ের চেয়েও দীর্ঘ ও শক্তিমান এক ঋজুতা, কিন্তু কীভাবে?

আমার মতো করেই আমি বাঁচতে চেয়েছি। আজোবধি আমার পছন্দের বাইরে আমি কিছুই করিনি। এ আমার অর্জন। একজীবনে আমি আর কারও মতো নয়, আমার মতো হতে চেয়েছি। এ কারণে আমার প্রেম, আমার বিদ্রোহ-একান্তই আমার। মম এক হাতের বাঁকা বাঁশের আর হাতে রণতুর্য। আমার জন্মও তো আর সবার মতো না, কিংবা কারও মতোই নয়। সুতরাং, অন্যের মতো না হওয়াটাই তো আমার নিয়তি, ভাগ্যবাদ।

`ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমনা এলাকায়, বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলের উত্তর দিকের যে বাড়িটির সম্মুখে জোড়া কবর আলুশাহ্ ও মালুশাহ্ বলে দুইভাইয়ের, যে বাড়িটির সেই সময় পরিচয় ছিল ডক্টর হাসানের (পরবর্তী সময়ে উপাচার্য হন) কুঠি, সেই বাড়িতে ১ ভাদ্র ১৩৩৯, ১৭ আগস্ট, ১৪ রবিউস্ সানি, বুধবার, বেলা ১২-২৫ মিনিটে কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয়ায় যে শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখেছিল এবং যার জন্মের দু'দিন আগে মাতৃগর্ভ থেকে হাত বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ডাক্তার বোস প্রসূতির জীবন রক্ষার্থে মেরে ফেলার উপদেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু স্নেহময়ী মা মরগুবা খাতুন দু'রাত দু'দিন না শুয়ে, বসে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যন্ত্রণায় মুখ বুঁজে সহ্য করে জন্ম দিয়েছিলেন এবং যার নাম আকিকার সময় বড় ভগ্নিপতি ডক্টর সিরাজুল হক নামকরণ করেছিলেন আবুল খায়র মুর্তজা বশীরুল্লাহ, যা সংক্ষেপে লেখা হতো এ. কে. এম. বশীরুল্লাহ।' (মূর্ত ও বিমূর্ত : মুর্তজা বশীর)।

স্বরচিত, স্বকল্পিত এ ভুবন, নাকি আঘাতে আঘাতে চিনেছি আমারে? আনওয়ান্টেড, নিঃসঙ্গ এক শিল্পীর-ব্যক্তির এ লড়াই তো আলটপকা কিংবা বেনোজলে ভেসে আসা বোধ ও বোধির হঠাৎ স্ফুলিঙ্গ নয়। মহোত্তম এক শিল্পীর প্রতীতি আর ধ্রুপদী এক শিল্প ভাবনার প্রত্যয় আছে এই চ্যালেঞ্জ ও পরিক্রমণে। যাকে তিনি নিয়ে গেছেন প্রেম ও বিদ্রোহের সমান্তরালে। এক জীবনের প্রার্থনার জপমন্ত্রে।

আমার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন বগুড়া স্যার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ। আমরা ওখানে থাকি। আমি পরিবারের ছোট সন্তান, বয়স দশ কিংবা বারো। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াই, বেয়াড়া। একদিন একজন লোক আমায় ডেকে বললেন, তোমার সব কিছু সবাই সহ্য করে, তোমার বাবার কারণে। কারণ তুমি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছেলে। তোমার বাবা যখন থাকবে না, তখন কি করবে তুমি? কথাটা আমার ভেতর বাণ হয়ে বিঁধলো। আমার মনে হলো, আমার পায়ের তলা থেকে সারা পৃথিবীর মাটি সরে গেছে। তারপর আমি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে থেকে পালানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। এ কারণে আমি বাড়ি থেকেও পালিয়েছি। আজও শহীদুল্লাহ্ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

আমি কখনও বাবুর (আমরা পারিবারিকভাবে বাবাকে বাবু বলতাম) পরিচয়ে বড় হতে চাইনি। তার নাম ভাঙিয়ে কোনো সুবিধাও নেইনি। এমনকি জেলে যাওয়ার সময়ও বলিনি আমার পরিচয়। বললে হয়তো জেলে যাওয়া স্থগিত হয়ে যেত তৎক্ষণাৎ। আমি মনে করি, মুর্তজা বশীর-ই আমার একমাত্র আইডেন্টিটি। বশীরুল্লাহ থেকে বশীর হয়েছি, শহীদুল্লাহ থেকে স্বতন্ত্র হওয়ার জন্য। আমার অন্য ভাইদের নামের সঙ্গে কিন্তু শহীদুল্লাহর 'উল্লাহ' রয়ে গেছে। আমি মুর্তজা নামটা প্রথম দিকে মূর্তজা-ঊকার দিয়ে লিখতাম। বাবু একদিন বললেন, মূর্খ বানান দীর্ঘ-ঊ কার দিয়ে লেখে। তুমি তো মূর্খ না। তুমি লিখো উ-কার দিয়ে। বাবুর এ কথাটা আমি রেখেছি। মুর্তজা এখনও উ-কার দিয়ে লিখি।

বাবু নিয়মিত সালাত আদায় করতেন। একদিন আমায় বললেন, সালাত আদায় করো না কেন, মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাও? আমি বললাম আপনারা তো পাঁচবার মুখোমুখি হন, আমি যদি সারাক্ষণ মুখোমুখি হই? বাবু আর কিছু বললেন না।

একটা ঘটনা আজও মনে পড়ে। আমি প্রথম চাকরি পাই, একশ' টাকা বেতনে। মা'র হাতে ৩০ টাকা দিই। মা বললেন, কিরে হাত খরচের জন্য দিলি? আমি বললাম, না তুমি দুই বেলা খাওয়াও, তার জন্য।

আপনার ৮৫-তে পা দেয়াকে (ইন্টারভিউটা তার ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে নেওয়া হয়েছিল) আমরা কি জীবন সায়াহ্ন বলতে পারি? আপনি তো নিজেকে ২৭ বলতেই পছন্দ করেন। আপনার প্রেম ও বিদ্রোহের স্বাতন্ত্র্য কি আপনার সহজাত, আরোপিত, কষ্টার্জিত নাকি স্বনির্মিত এক দেয়াল, যার নাম আমরা দিয়েছি প্রেম কিংবা বিদ্রোহ।

প্রেমের বিয়েও প্রতিনিয়ত ফেইলোর হচ্ছে। যে মেয়েটার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে গিয়েছিল প্রেমিক পুরুষ, এখন সে হাসলে দাঁতের মাংস দেখা যায় বলে, তার দিকে ফিরেও চায় না। আর মৃত্যু কত কষ্টের তা শুধু উপলব্ধি করা যায়, বলা যায় না। মৃত্যু মানে সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া, তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া। ভাবতে পারো?

আমার কাছে ২৭ এর অন্যরকম এক মাজেজা আছে। একটা ফিকির তো থাকেই। ফিকির না থাকলে ফকির (শিল্পী) হই কি করে? ম্যাচিউরড ম্যান যাকে বলে সেটি কিন্তু ২৭ এই হয়। ২৭ আমার মনের বয়স সেখানে কখনও আর কেউ আসিনি। ৫০, ৬০, ৭০, ৮০ কেউ না। ওদের সবার ক্ষেত্রে এমবার্গো দিয়ে রেখেছি। তবে, আমি ৯৩'র জন্য দ্বার খোলা রেখেছি। কারণ মহান শিল্পী পাবলো পিকাসো বেঁচেছিলেন ৯২ বছর। শিল্প দিয়ে তাকে অতিক্রমণের সাধ্যি তো নেই। তাই সাধ আমার অন্তত বয়স দিয়ে যেন তাকে ছাড়িয়ে যায়। আমি ৯৩ বছর বাঁচতে চাই। আমার কিছু ড্রিম ওয়ার্ক আছে, আশা করি এগুলো এই সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারব।

মৃত্যুকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, আই বিলিভ অন অলমাইটি আল্লাহ। ২০১৩ সালের নভেম্বরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে আমার চিকৎসা চলছে। অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল। আইসিইউ কিংবা সিসিইউতে নেওয়া হবে লাইফ সাপোর্টে রাখার জন্য। আমি ডাক্তারদের দৌড়াদৌড়ি, টেনশন, হতাশা সবই বুঝতে পারছি। মেয়েরা ফোনে লাশ কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে, কোথায় রাখা হবে আমার স্বজনদের সঙ্গে তাই নিয়ে আলাপ করছে। আমি শুনছি। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে। আমি আল্লাহকে বললাম, আমি মৃত্যুকে অতিক্রম করে বাঁচতে চাই। স্পপ্নের কাজগুলো আমি শেষ করি, তা কি তুমি চাও না আল্লাহ। তারপর পরিস্থিতি পুরো রিভার্স হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, উনি সারভাইভ করেছেন, আশঙ্কামুক্ত, আপনারা নিশ্চিন্ত হন।

বিখ্যাত মানুষ, খ্যাতিমান শিল্পী এরকম অভিধা আমাকে দেওয়া হয়। আমার এ খ্যাতি ফানুসের মতো, এই আছে এই নেই। প্রকৃতার্থে খ্যাতিমান হলো শহীদুল্লাহ্ (পিতা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্)। যিনি মৃত্যুর পরও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। শহীদুল্লাহ্ সবসময় প্রার্থনা করতেন এই বলে যে, 'আল্লাহ তুমি আমাকে আয়ু দাও আমি যেন আরও বেশি পড়তে পারি।' আর আমি বলি, 'আল্লাহ তুমি কি চাও না আমি আমার স্বপ্নের কাজগুলো শেষ করি? আমি তো মৃত্যুর পরও বাঁচতে চাই। তাই অমরত্ব পাওয়ার মতো কাজ করে যেতে চাই।'

কোথাও যান না, কোনো অনুষ্ঠানেও না। যাই না, যেতে ইচ্ছে করে না। জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু এই তিন অনুষ্ঠানই আমি এড়িয়ে চলি। কারণ, জন্মের মধ্যে দিয়ে যে শিশুটি পৃথিবীতে এলো তার জন্য আমার মায়া হয়। পৃথিবীটা কতটা নিষ্ঠুর সে জানে না বলে। বিয়ে মানুষের জীবনে স্রেফ গ্যাম্বালিং, জুয়া খেলা। প্রেমের বিয়েও প্রতিনিয়ত ফেইলোর হচ্ছে। যে মেয়েটার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে গিয়েছিল প্রেমিক পুরুষ, এখন সে হাসলে দাঁতের মাংস দেখা যায় বলে, তার দিকে ফিরেও চায় না। আর মৃত্যু কত কষ্টের তা শুধু উপলব্ধি করা যায়, বলা যায় না। মৃত্যু মানে সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া, তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া। ভাবতে পারো?

কাব্যগ্রন্থ : 'ত্রসরেণু', 'তোমাকেই শুধু', 'এসো ফিরে অনুসূয়া'। উপন্যাস : 'আল্ট্রামেরীন'। ছোটগল্প : 'কাচের পাখির গান'। প্রবন্ধ-গবেষণা : 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ'। নির্বাচিত রচনা : 'মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত'। এসব গ্রন্থের স্রষ্টা মুর্তজা বশীর শুধু তার সৃজনসম্ভারে নয়, ব্যক্তিজীবনেও ব্যক্তিক্রম। ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই তার বয়ানে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, বন্ধুদের কারণে তার জীবনে রক্তক্ষরণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। নিযুত মানুষের এ শহরে তাই তার কোনো বন্ধু নেই। আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, সাঈদ আহমেদ, শামসুর রাহমান এরা আমার বন্ধু ছিল। আমার বন্ধুদের মধ্যে এখন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর এখনও বেঁচে আছেন। বন্ধুদের কারণেই তিনি ঢাকায় না  চাকরিসূত্রে থিতু হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন মৃত্যুর আগে হাসপাতালের বিছানায় তাকে বলেছিলেন, 'আমি তোমার ওপর অন্যায় করেছি, তবে তোমাকে দোয়া করে যাচ্ছি কেউ তোমাকে আটকায়ে রাখতে পারবে না।'

প্রেমিক ও বিপ্লবীকে কখনও আটক, বৃত্তবন্দি কিংবা পন্থাচ্যুত করা যায় না। কারণ, ওরা দুটোতেই নিবেদিত থাকেন, আত্মোৎসর্গিকৃত হন। মুর্তজা বশীরের শিল্প সৃজন-গবেষণা আর ব্যক্তিচেতনা, যাপিত জীবন প্রেম ও বিদ্রোহ ঠিক তাই, যা হয়ে উঠেছে শিল্পের দীপিত এক স্মারক।
 

Comments

The Daily Star  | English

Step up diplomacy as US tariff clock ticks away

Bangladesh must intensify trade diplomacy to protect garment exports from steep US tariffs as the clock runs down on a three-month reprieve, business leaders warned yesterday.

10h ago