মুর্তজা বশীর ৯৩ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন

মুর্তজা বশীর
মুর্তজা বশীর। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

মুর্তজা বশীর ৯৩ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন। তার বেশি কিংবা কম কেন নয়, সে এক মস্তোবড় প্রশ্ন বটে। যার উত্তর ও যৌক্তিকতা জানতেন কেবল তিনিই।

এই অভিলাষ ছিল না একজন শিল্পীর আলটপকা কোনো খেয়াল কিংবা শিল্পের আলো-আঁধারি। এ চাওয়া ছিল শুদ্ধতা ও দার্শনিকতায় নিমগ্ন এক শিল্পীর হৃদয় থেকে উৎসারিত সাধনার অর্ঘ্যবিশেষ।

দেশভাগ পরবর্তী আমাদের যে শিল্প-আন্দোলন ও সৃজনে মুর্তজা বশীর ছিলেন তার অগ্রভাগে। বর্তমান যে বাংলাদেশ ভূখণ্ড, দেশ স্বাধীনের আগে ছিল পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব বাংলা—নানা নামে পরিচিত। এখানে নবজাগরণের সূত্রপাত হয় বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। বায়ান্নোর একুশে সেই জাগরণ পালন করে যৌবনের ধর্ম। বাঙালির এই যৌবনের ধর্ম বিকাশের সোনা ঝরা দিনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। অমর একুশের শহীদ বরকত গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন, রক্তাক্ত বরকতকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে তার লিনোকার্ট। সেই সংকলনের সঙ্গে যারা ছিলেন যুক্ত তারা সকলেই একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

হাসান হাফিজুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামানদের সঙ্গে বন্ধুত্বের গভীরতা সময় পরিক্রমায় বেড়েছে বৈ কমেনি। এ ছাড়াও পথ চলতে, লেখাপড়ার সুবাদে, কর্মক্ষেত্রের কারণেও বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। তবে তিনি তাদেরকে বন্ধু তালিকায় রাখতে নিমরাজি নয়, রীতিমতো গররাজি।

শামসুর রাহমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, যা মলিন হয়নি এক মুহূর্তের জন্য। ট্রাজেডি হলো, প্রিয় এই বন্ধু মারা যান মুর্তজা বশীরের জন্মদিনে ২০০৬ সালে। তারপর যতদিন জীবিত ছিলেন আর কোনো দিন পালন করেননি নিজের জন্মদিন। কেবল নিভৃতে স্মরণ করেছেন প্রিয় বন্ধুকে, স্মৃতির ডালিতে, প্রিয় কবিতার পংক্তিতে। সন্তানেরা জোরাজুরি করলে সেই জন্মদিন গড়িয়েছে পরের দিন। কিন্তু ১৭ আগস্টে হয়নি কখনও। এই হচ্ছে মুর্তজা বশীরের বন্ধুকৃত্য।

মুর্তজা বশীর বাঁচতে চেয়েছিলেন ৯৩ বছর। এ কথা আরও অনেককেই হয়তো বলেছেন তিনি। আমাকেও বলতেন প্রায়শ। বলেই চাপা একটা হাসি দিতেন, চোখে-মুখে বিরাজ করতো অন্যরকম এক দ্যুতি। যেন দাবা খেলায় রাজাকে দিয়েছেন চেক, পথ নেই বের হওয়ার। আমি বলতাম, ৯৩ কেন, ৯৪, ৯৫ কিংবা ১০০ নয় কেন? উনি হেসে ঠোঁটটা আরও একটু রক্তিম করে ফেলতেন, পাখির দিকে তাকাতেন, সিগারেটে একটা দম দিতেন।

মনে পড়ে প্রত্ন ইতিহাস সংগ্রাহক ও লেখক আ কা মু যাকারিয়ার যখন ৯৫ বছর বয়স, আলাপে-গল্পে বলেছিলেন একবার, 'ও কাজল, আমি মনে হয় আমার বাবা-চাচাদের মতো বাঁচব না, ফুপুদের আয়ু পাব।' আপনার ফুপুরা কতো বছর বেঁচেছিলেন? ১০০ বছরের মতো। আর বাবা-চাচারা? ১১৫ বছরের মতো। যাকারিয়া সাহেব সরল বিশ্বাসে যা মনে করেছিলেন তাই-ই বলেছিলেন। কিন্তু মুর্তজা বশীর ৯৩ বছর বাঁচতে চাওয়ার পর হাসছেন কেন? আমি পেঁচিয়ে ধরি, 'স্যার, বলেন কেন নির্দিষ্ট একটা সময় ধরেই বাঁচতে চান, কেন?' মুখ খোলেন তিনি। বলেন, শোনো কাজল, তার আগে তোমাকে আমার একটা গল্প বলি।

মুর্তজা বশীর অসুস্থ ভীষণ। রাজধানীর একটা হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। সেই যাত্রায় আর ঘরে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একটা সময়ে ডাক্তাররা বলে দিলেন, উনার অবস্থা খুবই খারাপ, ক্রমশ ক্রিটিক্যাল অবস্থার দিকে যাচ্ছে। মুর্তজা বশীরের কোনো নড়াচড়া নেই, সেই শক্তিও হারিয়েছেন। কিন্তু সবই শুনতে পাচ্ছেন তিনি। ডাক্তার ছেলে-মেয়েদের ডেকে বলে দিলেন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। জানালেন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেব, 'মুর্তজা বশীর আর নেই।' আপনাদেরকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানালাম। ছেলে-মেয়েরা বেডের পাশে শুয়ে আলাপ করছে। বিষয়, লাশ কী করা হবে? কোথায় কবর দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুর্তজা বশীর বললেন, 'কাজল আমি কিন্তু সব শুনতেছি। আর ভাবছি, আমি তো ৯৩ বছর বাঁচতে চাই। আমার তো এখনও অনেক কাজ বাকি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল ভিজে যাচ্ছে আমার। কেউ টেরও পায়নি। আমি চোখ বন্ধ করে শুধু বললাম, 'হে আল্লাহ্, তুমি কি চাওনা আমি আমার অসমাপ্ত কাজগুলো করি, তুমি কি চাও না আমি আরও কয়েকটা দিন বাঁচি, তুমি কি চাও না আমার কাজগুলো শেষ করে যাই?' এই বলে আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম।

ঠিক তক্ষুনি ঘোষণা দেওয়ার জন্য ডাক্তার এলেন এবং সব দেখেশুনে বললেন, 'মিরাকল, উনি ব্যাক করেছেন। আপনার উনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন।'

মুর্তজা বশীর বাসায় ফিরলেন এবং ডুব দিলেন নিজের কাজে। ততদিনে স্ত্রী পাড়ি দিয়েছেন চির প্রয়াণের পথ। তবুও প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিনি স্ত্রীকে স্মরণ করতেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনি যে এভাবে উনাকে স্মরণ করেন, অন্যেরা জানে? উনি বলেছিলেন, 'আমি তো কাউকে জানানোর জন্য, দেখানোর জন্য কিছু করি না।' যতদিন সুস্থ ছিলেন, প্রত্যেক শুক্রবারে স্ত্রীর কবরের কাছে যেতেন। মনে পড়ে, স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে ফোনে কথা হলেই বাসাই আসার জন্য বলতেন, সঙ্গে এও বলতেন যে, এই এই সময়ে এসো না। কারণ তখন উনি স্ত্রীকে ওষুধ খাওয়ান, সেবা যত্ন করেন, সময় ও সঙ্গ দেন।

মুর্তজা বশীর অমর হতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছে ও সাধনা ছিল কাজ দিয়ে অমর হয়ে ওঠা। এই নিয়ে তার কৌতূহল ছিল শিশুর মতো। এ প্রসঙ্গ এলেই মুখজুড়ে যে হাসির আভা খেলা করতো তা বুঝি কেবল নিষ্পাপ শিশুর মুখাবয়বেই মানায়। নিজের আঁকা ছবি নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল তার।

মুর্তজা বশীরের ছিল সাহিত্যিক মন, গবেষণা নিষ্ঠ প্রাণ-যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গেও। হুমায়ুন কবীরের 'নদী ও নারী' উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন সাদেক খান। তিনি ছিলেন এর চিত্রনাট্য রচয়িতা ও প্রধান সহকারী পরিচালক। তিনি উপন্যাস লিখেছেন, কবিতা চর্চা করেছেন, মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে হাবশী সুলতানদের কাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন। একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন যথার্থই সেসবের প্রতিভূ। শিল্পের নানা মাধ্যমের প্রতি আগ্রহ-ঝোঁক ও সংশ্লিষ্টতা তার শিল্পচর্চাকে করেছিল উচ্চকিত ও স্বাতন্ত্রমণ্ডিত। এই স্বাতন্ত্র্যই তাঁকে বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও শিল্প সৃজনের ভুবনে অমর করে তুলেছে।

শিল্প সৃজনের অমর কারিগর মুর্তজা বশীর কেবল আঁকাআঁকি দিয়ে নয়, তার বৌদ্ধিক অবস্থান দিয়েও নিজেকে কিংবদন্তীর জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিংবদন্তী হওয়ার পরও তিনি ৯৩ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি তার, নাকি নিজেই পূরণ করতে চাননি। জীবন সায়াহ্নে এসে সরে গিয়েছিলেন নিজের ওই অবস্থান থেকে। যে বছর মারা গেলেন তিনি, তখন কেবল দেশেই নয় বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ এর দৌর্দণ্ড প্রতাপ। তার আগের বছর দেখা ও শেষ আলাপ হয় তার সঙ্গে। অসুস্থ, অক্সিজেন নিতে হয় যন্ত্রের সাহায্যে, তারপরও কথার তুবড়ি ছুটছিল। চেহারা ও বেশভুষায় এনেছেন ব্যাপক পরিবর্তন। তারও আগে থেকেই মন দিয়েছেন ধর্মেকর্মে—এখন বেড়েছে কিছুটা।

অনেক কথা, অনেক গল্প। কিছু কিছু ঘুরে ফিরে আসতো, কিছু একেবারেই আনকোরা। আর যেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে সেগুলোর বেশিরভাগ শুনেই মনে হয়েছে উনি সেই কথা-গল্প-আখ্যান এতদিনে শেষ করলেন। তার মানে কি কথারা, গল্পেরা, আখ্যানেরা মানুষের সঙ্গে বড়ো হয়, পরিণতির দিকে এগোয়, দার্শনিকতাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিন্যাস করে তার মাত্রা। যতো বড়ো দার্শনিক, যতো বড় বুদ্ধিজীবী তার পরিবর্তনের ক্ষমতা হয় সবার থেকে বেশি। কেবল গোঁয়ার-মুঢ়-মূক এক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে, পাথরের মতো নিস্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে।

স্যার, আপনি কি এখনও বাঁচতে চান ৯৩ বছর, কিংবা তারও অধিক। মনে হলো, আগের সেই হাসি হয়েছে কিছুটা ম্লান। যদিও তিনি পড়ে আছেন রঙের উজ্জ্বলতায় ভরা রঙিন এক জামা, টুপিটাও বেশ কালারফুল। তিনি বললেন, কাজল ৯২, ৯৩ এরপর আর বাঁচা উচিৎ নয়, কারণ তখন আর শরীরে কুলোয় না। নিজে নিজে চলার সক্ষমতা হারিয়ে যায়। অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ায় কি ভালো নয়? আমি বললাম, স্যার নীরদচন্দ্র চৌধুরী তো সম্পূর্ণ সুস্থভাবে ১০২ বছর বেঁচে ছিলেন। পাড়লাম তপন রায়চৌধুরী, খুশবন্ত সিং প্রমুখের কথা। উনি কেবল চুপ করে শুনলেন। বললেন মানুষের শরীরে যতদিন কুলোয় ঠিক ততদিনই বাঁচা উচিৎ, তার থেকে বেশি একদিনও নয়, এক মুহূর্তের জন্যও নয়।

ঠিক তক্ষুনি মনে পড়ে গেল, মুর্তজা বশীর ৯৩ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমরা চুপচাপ বসে থাকি। বই দেখি। মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। তিনি আজান শুনেন, জবাব দেন।

নিজেদের মধ্যে আলাপে মগ্ন হই। স্যার, আপনি কেন ৯৩ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন? 'তুমি শুনবেই সেই কথা? পাবলো পিকাসো ৯২ বছর বেঁচেছিলেন। আমিতো শিল্প সৃজন দিয়ে তাকে ছাড়াতে পারব না, তাই বাঁচতে চেয়েছিলাম ৯৩ বছর। যাতে জীবনের আয়ুষ্কাল দিয়ে হলেও পাবলো পিকাসোকে অতিক্রম করতে পারি। এ কারণেই ৯৩ বছর বাঁচার অভিলাষ আমার।'

মুর্তজা বশীর, জীবন সায়াহ্নে আপনি কি বেছে নিয়েছিলেন ইচ্ছামৃত্যুর পথ? এই প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই জানা হবে না আমার, আমাদের। আপনি কি জানেন, আমরা আপনাকে পাবলো পিকাসো জ্ঞান করি, মান্যতা দেই গভীর-গভীরতর এক শ্রদ্ধায়। জীবনের আয়ুষ্কাল দিয়ে নয়, শিল্পের সৃজন দিয়েই আপনি হয়েছেন অমর, বাংলার পাবলো পিকাসো।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

kazal123rashid@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Cargo ship with Pakistani goods reaches Ctg anchorage

On its second trip, it brings refined sugar, dolomites, fabrics, electronics, etc from Pakistan and UAE

38m ago