পর্যালোচনা

‘বাংলার পার্টিশন কথা’ কেন এতো অবহেলিত

কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে এমন প্রসঙ্গ হাজির হয়েছে, সেসব আরও একটু বিস্তৃত হওয়ার প্রত্যাশা রাখে।

'বাংলার পার্টিশন কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ', কলকাতার নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের প্রকল্পে আগ্রহোদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক এক বই। সর্বজনে 'দেশভাগ' নামে পরিচিত এক শব্দবন্ধের বাইরে গিয়ে নতুন এক চিন্তা হাজির করা হয়েছে এখানে। 'বাংলার পার্টিশন'কেন 'দেশভাগ' নামে পরিচিত পেল, তার কারণ কী, যৌক্তিকতা কী তার কোন উত্তর নেই কোথাও

প্রশ্ন ছাড়াই 'দেশভাগ' বয়ান সময় পরিক্রমায় রূপ নিয়েছে 'মহাবয়ানে'। কারোরই হয়তো জানা নেই, বঙ্গবিভাজনকে 'দেশভাগ' বলার নেপথ্য কারণ। বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যাও দৃশ্যমান নয়। অথচ সর্বত্র ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ থেকে শুরু করে সৃজন ও মননশীল লেখালেখিতে সেটাই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে  আলোচ্য বই ব্যতিক্রম ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।

বাংলার পার্টিশনকে কেন সবাই 'দেশভাগ' বলেন? ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয়। ছিল একটা দেশ-একই ভূগোল, হয়ে গেল দুটি দেশ-দুটি মানচিত্র। এই ভাগাভাগিকে,  দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা যায় 'দেশভাগ', যা সঙ্গত ও যৌক্তিকও। ভাগাভাগির এই বাস্তবতায় বেদনা ও হাহাকার নেই। নেই বাংলার পার্টিশনের নামে সংঘটিত গণহত্যার মর্মন্তুদ অধ্যায়। যেমনটা রয়েছে বঙ্গ বা বাংলার বিভাজনে।

বঙ্গ'র রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস, যা নির্মিতি দিয়েছে সমন্বয়বাদী এক সংস্কৃতির। যাতে যোগ রয়েছে আত্তীকরণ ও সাঙ্গীকরণের দুর্লভ গুণ। যাপিত জীবন এবং চৌদিকের প্রাণ ও প্রকৃতির সমন্বয়ে উদ্ভূত এই সংস্কৃতি কয়েক হাজার বছরের প্রবহমানতায় ঋদ্ধ। আপন ও অপরের যূথবদ্ধ পরিশীলন তাকে করেছে সমগ্র জাতির বেঁচে থাকার জন্য প্রাণ বায়ু বিশেষ।

একথা তো সর্বৈবভাবে সত্যি যে, কোন জাতির কাছে তার সংস্কৃতি নিঃশ্বাস সমতুল, 'অক্সিজেন' বিশেষ। বাঙালি জাতির জন্য বিষয়টা অধিকতর সত্য ও অর্থবহ, কারণ তার সংস্কৃতির মূলে রয়েছে 'সমন্বয়ধর্মী' ও 'বহুত্ববাদী' চেতনার আধার ও আধেয়। যে শক্তির প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বাঙালির যাপিত জীবনে, প্রতিদিনের রোজনামচায়, লোকধর্মে, স্থাননামে, ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, শিল্পকলায়, প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনাসহ এতদ্বিষয়ক বিবিধ বিষয়ে।

হাজার বছর ধরে বাঙালির এই একত্রিত বসবাসে কোন সমস্যা-বিশেষ করে বিভাজনের মতো আত্মঘাতী সংকট উদ্ভূত না হলেও, ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষাশেষি এসে এই সমস্যা ও সংকট ঘনীভূত হয়। যদিও এই বাস্তবতা যতটা ছিল সমাজের উপরতলার মানুষের ক্ষেত্রে, নীচের তলায় ঠিক তেমন ও ততটা নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সৃষ্ট এই সমস্যার শেকড় সমাজের কোন স্তরেই ছিল না, প্রধানত ও কেবলমাত্র ছিল রাজনীতির নীতি-নির্ধারকদের মাঝে এবং শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীতার চারদেয়ালে। ব্রিটিশের বিদায়ে ১৯৪৭-এ বঙ্গ স্বাধীনতা পেল ঠিকই, কিন্তু সেই স্বাধীনতার সঙ্গে এল বিষাদও। কারণ স্বাধীনতা ও বিভাজন হাত ধরাধরি করে এল। দেশকে খণ্ডিত করার পোশাকি নাম দেওয়া হল 'দেশভাগ'।

প্রথম খণ্ডের প্রলম্বিত উদ্যোগে দ্বিতীয় খণ্ডে সাজানো হয়েছে তিরিশটি জীবনভাষ্য, কথোপকথন এবং দুই বাংলা মিলিয়ে আটজন লেখক ও বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপ। সংযুক্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গের আরও পাঁচটি সমীক্ষামূলক নিবন্ধ; যেগুলি ক্ষেত্রসমীক্ষার অনুসন্ধানী খোঁজ থেকে উঠে আসা কথামালায় ভরপুর'

বাংলার এ বিভক্তি জন্ম দিল মর্মন্তুদ এক ট্রাজেডির, সংঘটিত করল অবর্ণনীয় এক গণহত্যার। যার ধারাবাহিকতা সাময়িক বিরতিতে চলতে থাকল ১৯৭১ অবধি।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ পূর্ববর্তী পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের নিকট অতীতে বাংলাকে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন ব্রিটিশ প্রতিভূ লর্ড কার্জন। শেষাবধি সফল হননি। বঙ্গের মানুষেরা- বিশেষত উপরতলায় যাদের বসবাস উনারা এটা চাননি। এ কারণে ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ হলেও তা রদ হয়ে যায় ১৯১১-তে। অথচ সেই বঙ্গকেই বিভক্ত করা হল ১৯৪৭-এ। যাকে 'দেশভাগ' বলে প্রকারান্তরে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার কূটকৌশলকেই জারি রাখা হয়েছে।

‘বাংলার-পার্টিশন কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ’ বইয়ের জন্য উত্তর চব্বিশ পরগনার পাঁচপোতা গ্রামে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন পেশায় ছুতার মিস্ত্রি। সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন উত্তম কুমার বিশ্বাস। ছবি: সম্পাদক থেকে পাওয়া।

সম্পাদক মননকুমার মণ্ডল অবশ্য এই ফাঁদে পা দেননি। তিনি 'দেশভাগ' নয়, বাঙালির জীবনে সংঘটিত অবিস্মরণীয় এই অধ্যায়কে দেখেছেন 'বাংলার পার্টিশন' হিসেবে। এবং এটাই বোধ করি, যথার্থ ও যৌক্তিক। কারণ, 'বাংলার পার্টিশন' বা 'বাংলা ভাগ' বলা হলেই কেবল তাতে বাংলা, বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাভাগসহ ইত্যাকার বিষয়গুলোর ভয়াবহ ও সর্বনাশা রূপটা ধরা পড়ে।

বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, 'পার্টিশন-আখ্যান একমুখী নয়, বহুমাত্রিক, এমনকী বহু বিভঙ্গে বিশ্লিষ্ট। কেবলমাত্র লিখনের পরিসরে বাংলার পার্টিশন আখ্যানকে দেখা সমীচীন নয়, কারণ লোক পরিসরে জেগে থাকা গল্পগাথা, জীবনের অভিজ্ঞতাও এর উপাংশ। লোকপরিসর ব্যতিরেকে বাংলার পার্টিশন-আখ্যান লিখন ও পাঠ অসম্ভব। ফলত বাংলার পার্টিশন বিষয়ে জনপরিসরে পরিগৃহীত আখ্যান-চুর্ণকের গুরুত্ব অপরিসীম।

পার্টিশনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি, অর্থনীতির যুক্তি যেমন ইতিহাসলেখক নির্মাণ করেছে তেমনই মানবিক প্রকাশের তন্ত্রটি কাজ করেছে আখ্যানের হয়ে ওঠায়। প্রথম খণ্ডের প্রলম্বিত উদ্যোগে দ্বিতীয় খণ্ডে সাজানো হয়েছে তিরিশটি জীবনভাষ্য, কথোপকথন এবং দুই বাংলা মিলিয়ে আটজন লেখক ও বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপ। সংযুক্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গের আরও পাঁচটি সমীক্ষামূলক নিবন্ধ; যেগুলি ক্ষেত্রসমীক্ষার অনুসন্ধানী খোঁজ থেকে উঠে আসা কথামালায় ভরপুর।

এতে পরিষ্কার হয় বই ও প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। জীবনভাষ্য, কথোপকথন ও আলাপ উন্মীলন করেছে এই আখ্যানের বিবিধ দিক। ক্ষেত্র সমীক্ষার যথাযথ প্রয়োগে গ্রেপ্তার হয়েছে বহুকৌণিক অভিজ্ঞতার জীবনভাষ্য। এ ধরণের গবেষণা কর্মে এর চেয়ে মানসম্পন্ন ও অন্যবিধ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া আছে কী, সম্ভবত নেই। তারপরও মনে হয়,এখানে বুঝি 'বাংলাভাগ' এর যে হাহাকার, অব্যক্ত যে যন্ত্রণা, হতমানের যে নৈঃশব্দতা তা জারি নেই। বোধ করি, তার সবটা বলা হয়নি এখানে। তৃতীয় খণ্ডের অনুসন্ধানে এসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন ও জরুরি, যদি সম্ভব হয়।

কালের ধ্বনির আয়োজনে ‘বাংলার-পার্টিশন কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ’ সম্পাদক মননকুমার মণ্ডল অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন ঢাকায় দ্য ডেইলি স্টার সেমিনার হলে, ৯ মে ২০২৪। ছবি স্টার

'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!' জীবনানন্দের এই পঙক্তি মানুষের স্বভাবজ ধর্ম। সে বেদনাকে পুষে রাখে, প্রযত্নে ও চোখের জলে। আড়াল করার মধ্যে দিয়ে প্রতিদিনের বাস্তবকে যুঝতে চাই। বাংলার পার্টিশন হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাবিধুর সামষ্টিক এক ট্রাজেডি। যার পরতে পরতে রয়েছে ব্যক্তির হাপরভরা দীর্ঘশ্বাস। সঙ্গত কারণেই তার উচ্চারণমাত্রই অনিবার্যভাবে হৃদয় খুঁড়ে দেখা, নিজেকে ফালি ফালি করার নিমিত্তে অসির নিচে রাখা। এ কারণে 'বাংলার পার্টিশন-কথা' সংগ্রহ দুরূহ এক অনুসন্ধান, তা যে প্রক্রিয়াতেই হোক না কেন।

নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মননবাবুর প্রযত্নে সেই কঠিন কাজটিই করে চলেছেন। কারণ, উনারা এই ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। উত্তর প্রজন্মের কাছে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধকে আমলে নিয়েছেন। যার অর্থবহ প্রকাশ ঘটেছে বইয়ের নামকরণেও, 'বাংলার পার্টিশন-কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ'। নামে কি 'মন্তাজ' এর উপস্থিতি রয়েছে? যাতে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ বারতার সঙ্গে চিন্তার শক্তি ও নান্দনিকতার সৌন্দর্য।

বাংলার পার্টিশন-কথাকে জীবনভাষ্য, আলাপ  কথোপকথন ও অনুসন্ধানে মহফেজখানায় জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। কেন, উত্তর প্রজন্মের জন্য। এঁরা যখন এসব নিয়ে জানতে চাইবে, গবেষণায় আগ্রহী হবে, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নির্মাণের লক্ষ্যে, অতীতকে আত্মস্থ করে নিতে চাইবে, ইতিহাসের ভেতর-বাহির বুঝতে অনুসন্ধিৎসু হবে; তখন যেন এরকম একটা মহাফেজখানা পাওয়া যায় যেখানে রয়েছে এসবের প্রামাণ্য নথি, অডিও-ভিডিওসহ নানামুখী সুলুকসন্ধানের প্রয়োজনীয় পাথেয়।

বাংলার পার্টিশন কোন একরৈখিক ব্যাপার নয়, বহুমাত্রিক ও বিবিধ কার্যকারণের চূড়ান্ত পরিণতি; যা প্রত্যক্ষতার চিত্ররূপে হাজির রাখতে চান মহাফেজখানায়, যাতে উত্তর প্রজন্মের খোঁজ সহজ ও সার্থক হয়।

বাংলার পার্টিশনে সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা, অথচ তার কোন মহাফেজখানা হবে না, তাই কি হয়? হয়তো, সেটাইতো হচ্ছিল আট দশক ধরে, দুই বাংলাতেই। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, একাডেমিয়া, রাষ্ট্র যখন এ ব্যাপারে কুণ্ঠিত হয়েছে বছরের পর বছর,তখন এরকম একটা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দুটো বিষয় পরিষ্কার।

এক. ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা ও বাংলার পার্টিশনের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও ধর্মনীতির পূর্বাপর বাস্তবতাকে খুঁজে ফেরা ও সম্যকভাবে অবলোকন।

দুই. বাংলার পার্টিশন কোন একরৈখিক ব্যাপার নয়, বহুমাত্রিক ও বিবিধ কার্যকারণের চূড়ান্ত পরিণতি; যা প্রত্যক্ষতার চিত্ররূপে হাজির রাখতে চান মহাফেজখানায়, যাতে উত্তর প্রজন্মের খোঁজ সহজ ও সার্থক হয়।

প্রায় পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার বইটির সূচী দেখে নিলেই এর বিষয়, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভীপ্সা সম্পর্কে মোটামুটি পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়।

দেশভাগের ঘোষণার পর পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ছেড়ে আসা শরণার্থী বোঝাই ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত

বইটির নিবিড় পাঠে যা জানা ও বোঝা যায়, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মিল ও অমিল দুটোই রয়েছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই অর্থে যে, বর্তমান লেখক বঙ্গ বা বাংলা ভাগের শিকার হওয়া পরিবারের উত্তরাধিকার। অর্থাৎ তিনি রিফুজির সন্তান। এই 'রিফুজি'  শব্দটাকে এদেশের কেউ কেউ গালি হিসেবে ব্যবহার করেন। গ্রাম বাংলায় আত্মীয়তা তৈরির ক্ষেত্রে আজও 'রিফুজি' পরিচয় কখনো কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উদাহরণও একেবারে অপ্রতুল নয়।

চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রেও 'রিফুজি' তকমা অনুকূল নয়, অসূয়া ও বৈরিতায় ভরা। তা হলে কি, এদেশে 'রিফুজি' ও তাদের উত্তরাধিকাররা বড় পদে যাচ্ছেন না, চাকরি করছেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত নেই, জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন না? হ্যাঁ সবই করছেন। পাশাপাশি ওই চিত্রটাও জারি আছে, সেটাকে সঙ্গে নিয়েই বাইতে হচ্ছে জীবন তরী।

আনিসুজ্জামানের মতো পণ্ডিতজনকেও শুনতে হয়েছে আজকের বাংলাদেশ তথা সেই সময়ের পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার বচন। এবং একথা কোন যদুমধু বলেননি, বলেছিলেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের মতো ধীমান লোক গবেষক। চলা-ফেরা, আচার-আচরণ সবকিছুতে 'রিফুজি' ও তাদের উত্তরাধিকারদেরকে পৃথক বর্গ হিসেবে দেখার প্রবণতা জারি বিষবৃক্ষের মতোই জেঁকে আছে।

আলোচ্য বইয়ে বাংলাভাগের শিকার হওয়া সেসব মানুষের সেসব রুঢ় ও করুণ বাস্তবতাকে প্রত্যাশিত মাত্রায় ধারণ করার চেষ্টা রয়েছে।

'বাংলার পার্টিশন-কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ' বইয়ের দ্বিতীয় প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে, 'পার্টিশন' প্রজন্ম-হন্তারক; ১৯০৫, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর উপর্যুপরি ভাঙনের পথে বাংলার পার্টিশন পরিবর্ধিত হতে হতে এক ক্রমপ্রসারমাণ প্রতর্কের চালচিত্র গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে উত্তর প্রজন্মের খোঁজ কী সেই দীর্ঘ আলোচনায় ক্লিশে হয়ে যাওয়া ইতিহাসে পৌঁছানোর? না কি নিজের আখ্যানের এমন বয়ানের খোঁজ- যা ছড়িয়ে আছে তার চারপাশে, সমাজের মন-মানসিকতায়, রাষ্ট্রতন্ত্রের স্তরে স্তরান্তরে। সেই পরিচিতির আবর্তে সতত জায়মান অন্তর্ভুক্তি ও প্রত্যাখ্যান- উত্তর প্রজন্মের খোঁজের শুরু সেখান থেকে।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রায় বিশ কোটি মানুষের জীবনের সহাবস্থান এই খোঁজের ভিত্তি; আর মন ও বাস্তবের সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষের গল্পকথা তার আত্মা। বাংলার পার্টিশন আখ্যান কি কেবলই এক-একটি ছিন্নতার আখ্যান? না কি এই ভাঙনের কথামালা বহুভাষিক রাষ্ট্রের এক বিশিষ্ট পরিচিতির মহৎ কোনো আখ্যানের অংশ- যা বয়ে চলে নিরন্তর, জাত-ধর্ম-ভাষার বহুকৌণিক সম্ভাবনাময় বিস্তারে।'

উপর্যুক্ত পাঠে এই প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত যে, ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৭১-সময়পর্ব ও সংঘটিত ঘটনাসমূহকে কি এই প্রকল্প এক নিরিখে দেখছে, অনুসন্ধান কি তাই বলে? এভাবে দেখা ও বলা কি যৌক্তিক ও যথার্থ হবে? এরকম চিন্তাপূর্বক ওরকম সিদ্ধান্তে যাওয়ার সুযোগ কি আদৌ রয়েছে?

১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের নামে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করা হয়। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন বাঙালি হিন্দু, বিশেষ করে যারা উপরিবর্গের প্রতিনিধি স্থানীয়। বঙ্গভঙ্গের বিভাজনে কিন্তু দেশগত আলাদা বা দেশান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি বা সংকট কোনটাই ছিল না। গ্রাম বাংলায় এরকম একটা কথা আছে, আগুনে ঘর পুড়লেও ভিটেটুকু থাকে, সেখানে আবার নতুন করে মাথা গোজরানোর চেষ্টা চলে। নদীতে ভাঙলে ভিটেটুকুও থাকে না, পথে বসতে হয়। কিন্তু তারপরও স্বজনেরা থাকে, চেনা-জানা মানুষেরা, পরিবেশ ও প্রকৃতিও আপনারই থাকে। কিন্তু দেশান্তরি হতে হলে কিছুই থাকে না, থাকে শুধু অব্যক্ত ব্যথা ও যন্ত্রণা।

বঙ্গভঙ্গে এসব ছিল না। কারণ এই বিভাজন দেশান্তরি হওয়ার ছিল না। থেকেই রাজ্য বা প্রদেশগত পৃথক হওয়ার। যেমনটা হন আপন ভাইয়েরা, সংসার বড় হলে ভাইয়ে-ভাইয়ে তখন রচনা করে আলাদা ভিটে। তাতে সঙ্গ ও সঙ্গী হারা হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বঙ্গভঙ্গ ছিল অনেকটা এই আদলের, তারপরও সেই বিভাজন রদ হল। কিন্তু ১৯৪৭ এর বিভাজন তো দেশান্তরি, উম্মুল, হওয়ার বিভাজন, সঙ্গ ও সঙ্গী, প্রকৃতি ও পরিবেশ, এমনকি চেনা আকাশটুকু হারানোর বিভাজনও, তাও কেন তা রদ করার চেষ্টা হল না? রাজনীতি-অর্থনীতি আর ক্ষমতালিপ্সা কি বাংলাভাগ ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং গণহত্যার জন্য দায়ী নয়?

এই বিভাজনের পরিণাম ও পরিণতি কী হতে পারে তাও জানা ছিল নিশ্চয়? তা হলে এত কিছু জেনেও বাঙালির মানচিত্রকে কেন খণ্ডিত করা হল? কার সেই দায়। বঙ্গের ভঙ্গে ও রদে কি অর্থনৈতিক স্বার্থই দুপক্ষের জন্য মুখ্য কারণ হয়ে উঠেছিল? বঙ্গভঙ্গজনিত কারণে যে সোচ্চার স্বর উত্থিত হল, কয়েক বছরের ব্যবধানে বিহার ও উড়িষ্যাকে যখন বঙ্গ থেকে আলাদা করা হল, তখন কেন সেই স্বর সেভাবে উচ্চারিত হল না?

'বঙ্গভঙ্গ' ও 'দেশভাগ' ১৯০৫ ও ১৯৪৭ কে একই নিক্তিতে দেখার সুযোগ কতটা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আবার ১৯০৫ ও ১৯৪৭ কে তর্কযোগে একই সমান্তরালে দেখার পরিসর কিঞ্চিত মিললেও ১৯৭১ কে সেভাবে বিচারের অবকাশ নেই। ১৯০৫ ও ১৯৪৭ এর ভাঙ্গনের মানচিত্র অভিন্ন নয়। ১৯৭১ আবার এই দুইয়ের থেকে স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভু। ১৯৭১-কে ভাঙ্গন হিসেব দেখা যেতে পারে না যুক্তিযুক্তও নয়। এ দেশে '৭১-কে গণ্ডগোলের বছর বলে দাগিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা রয়েছে। এর পেছনে মুখ্য কারণ রাজনীতির সূক্ষ্ণ হিসেব-নিকেশ। যে পক্ষের বিবিধ ষড়যন্ত্রের একটা হল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরকে গণ্ডগোলের বছর বলে দাগিয়ে দেয়া, জনপরিসরে চাউর করা এবং সেটাকেই নানা বাহানায় সামনে নিয়ে আসা। ১৯৭১ গণ্ডগোলের বছর নয়। ১৯৭১ বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বছর। যা বাঙালিকে নিজস্ব রাষ্ট্র দিয়েছে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বইয়ের একই ফ্ল্যাপের শেষ অর্ধাংশে বলা হয়েছে, 'সমষ্টির সামূহিক চৈতন্যে ধ্বংস ও নির্মাণের আখ্যান বহুস্তরিক। আত্মধ্বংস ও আত্ম-নির্মাণের সামাজিক কাহিনী বহুকাল ধরে বলা হয়ে চলে, বিরামহীন, যতিহীন, তার বিস্তার। হলোকস্ট, পার্টিশন যে-কোনো কাথামালারই এক ধরণের লৌকিক স্বর থাকে নির্দিষ্ট কৌম সমাজে তার ছায়াপাত আখ্যানের এক মহতী নির্মাণে নিয়োজিত থাকে। ব্যষ্টির বুনে চলা সেই কথামালার সম্মিলনে গড়ে ওঠা মহা-আখ্যান। গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা সেই মহা-আখ্যানের অংশ। পার্টিশনের যে আখ্যান এখনও লেখা শেষ হয় নি। বাংলার পার্টিশন চূর্ণককে এমনই এক মহৎ আখ্যানের অংশ হিসেবে পাঠের অভিপ্রায় উত্তর প্রজন্মের দায়। 'বাংলার পার্টিশন কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ' এমন অভিপ্রায় থেকে উঠে আসা তিন খণ্ডে পরিকল্পিত গ্রন্থ।'

উপর্যুক্ত অংশ পাঠে আমরা আশান্বিত হই। বাংলার পার্টিশনের আট দশকের সময়সীমায় যা হওয়া বাঞ্ছনীয় ও প্রত্যাশিত ছিল, দেরিতে হলেও তা হচ্ছে এবং চলমান রয়েছে আরও মহৎ কিছু করার প্রচেষ্টা, এ বড় আনন্দযোগ। এবার সরাসরি বইয়ের কিছু বিষয় খোলতাই হওয়ার অভিপ্রায়ে কতিপয় জিজ্ঞাসা।

সামাজিকভাবে হয়তো অসূয়ার শিকার হয়েছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো অনুরূপ সমস্যা তৈরি হয়নি। যেটা এখানে দেখা যায়, বিহার থেকে আগতদের ক্ষেত্রে। এদের ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে তাদের কিছু সংঘবদ্ধ ভুল। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক হাজার বছরের। পূর্ববঙ্গ সেই সম্পর্কের প্রতি বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যে সহানুভূতি ও সহযোগ প্রদর্শন করেছে, পশ্চিমবঙ্গ কেন তেমনটা করতে পারল না?

এক. পৃষ্ঠা ১৮-তে বলা হচ্ছে, 'উদ্বাস্তু আখ্যান সম্ভাবনাময়'। সম্ভাবনাময় কেন? উদ্বাস্তু আখ্যান নিজেদেরকে জানা বোঝার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। জাতিকে সংহত করার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রকে নির্মাণের প্রশ্নে, সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উদ্বাস্তু আখ্যান পাঠ জরুরি। উদ্বাস্তু আখ্যানে রয়েছে ব্যক্তির ব্যথা ও যন্ত্রণার ধারাপাত, যা হাজির করে সামষ্টিক লজ্জা ও ব্যর্থতার পরিচয়। এতে রয়েছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতকে নির্মাণের শিক্ষা ও সুযোগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছেন, 'হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে/কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।' তাই বলে কি উদ্বাস্তু আখ্যানকে সম্ভাবনাময় বলা যায়? তা হলে তো 'ইডিপাস ট্র্যাজেডি'কেও সম্ভাবনাময় বলতে হয়। যদিও একটা বাস্তবোচিত, অন্যটা কল্পনাশ্রিত।

দুই. '১৯৫২ সালে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হলে।'-লেখা হয়েছে পৃষ্ঠা ১৯-এ। আবার পৃষ্ঠা ৪২-এ লেখা হয়েছে, '১৯৫৬ সালে পাসপোর্ট প্রথা চালু হলে।' একই বইয়ে দুই রকমের তথ্য ব্যবহারের কারণ স্পষ্ট নয়।

তিন. পৃষ্ঠা ৪৫-এ হিরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, 'একটি অতিরিক্ত কারণ হল পশ্চিমবঙ্গবাসীদের পাকিস্তান হতে আগত উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের হাঙ্গামার সময় তা বিলক্ষণ বর্তমান ছিল, কিন্তু পুনর্বাসনের কাজে যেমন জমি ও চাকরিতে ভাগ দেবার প্রয়োজন হল, তেমন নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে দেখে তাদের সহানুভূতি কমে আসতে লাগল।' পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে সকল মুসলমানেরা এসেছেন-এমনকি হিন্দুরা, তাদের কাউকে এ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।

সামাজিকভাবে হয়তো অসূয়ার শিকার হয়েছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো অনুরূপ সমস্যা তৈরি হয়নি। যেটা এখানে দেখা যায়, বিহার থেকে আগতদের ক্ষেত্রে। এদের ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে তাদের কিছু সংঘবদ্ধ ভুল। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক হাজার বছরের। পূর্ববঙ্গ সেই সম্পর্কের প্রতি বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যে সহানুভূতি ও সহযোগ প্রদর্শন করেছে, পশ্চিমবঙ্গ কেন তেমনটা করতে পারল না?

চার. বইয়ে বেশকিছু স্থান নাম রয়েছে যেগুলো যথাযথ নয়। যেমন: প্রকৃত নাম সোনাইকুন্ডি, লেখা হয়েছে সোনাকুঠি। একইভাবে, আদাবাড়িয়া হয়েছে আদাবারি; চাটমোহর হয়েছে চাকমোহর; হোগলবাড়িয়া হয়েছে হুগোলবাড়ি; উদাহরণ অনেক। অজ্ঞাত কারণে প্রায় স্থাননাম ভুল ও বিকৃতভাবে এসেছে। আবার ব্যক্তি নামের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে এই সমস্যা। যেমন: সর্বজনে আফসার আমেদ নামে পরিচিত হলেও লেখা হয়েছে আফসার আহমেদ।

পাঁচ. কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে এমন প্রসঙ্গ হাজির হয়েছে, সেসব আরও একটু বিস্তৃত হওয়ার প্রত্যাশা রাখে। যেমন:

ক. পৃষ্ঠা ২৬৯ এ অনিন্দিতা দাশগুপ্তের প্রশ্নের জবাবে অরুণ সেন বলছেন. 'আমি মনে করি পুরোপুরি বাঙালির দেশ হওয়া কখনওই সম্ভব নয়। আসলে একটা ভৌগলিক ব্যবধান তো আছেই, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কাজেই বহু ক্ষেত্রে মিলনের মানসিকতা যেমন আছে তেমনই বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় ভেতরে ভেতরে একটা অন্যরকম ভেদ-এর স্বর'। এতোটা সরলরৈখিকভাবে এরকম বিষয়ের উপসংহার টানা যায় কি?। দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার নজির কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের। তাদেরও ওসব প্রসঙ্গ ছিল, তারপরেও তো হয়েছে। আসল কথা হল,সংখ্যাগরিষ্ঠের মাঝে আগে ওরকম আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়াটা জরুরি। এবং তার পেছনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাটা কী সেসবকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বাঙালি সংস্কৃতিতে যদি একীভূত হওয়ার দর্শন ও শিক্ষা থাকে তাহলে সেটা কিন্তু হবেই, তাকে রোধ করা যাবে না। প্রশ্ন হল, এই সংস্কৃতিকে আদৌ প্রযত্ন দেয়া হচ্ছে, নাকি তাকে লুপ্ত করার প্রতিযোগিতা চলছে?

খ. পৃষ্ঠা ২৩৬-এ মেহবুব-উজ-জামান বলছেন, 'এমনও হতে পারে যে, একটাই স্টেট হয়ে যেতে পারে-ভারতবর্ষ।' দেশভাগ ও বাংলাভাগের অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে যখন এই প্রসঙ্গ হাজির হয়, তখন তা নিয়ে আরও বিস্তৃত আলাপ হওয়ার দাবি রাখে। যখন তিনটা দেশের জনমানসেই প্রতিবেশী দেশগুলো  সম্পর্কে ভিন্নতর বয়ান চালু রয়েছে, যা স্বস্তিকর নয়। আবার বড়'র ভূমিকা পালনে বড়দেশ কী করছে সেই জিজ্ঞাসাও জরুরি। শুধু ভিসার ক্ষেত্রেই যে জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, তাতে সেই প্রত্যাশা দিবাস্বপ্ন নয় কি?

রাশীদুল হাসান (১ নভেম্বর, ১৯৩২ - ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১)

শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসান ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে কখনো ভারত যাননি, কারণ পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা। তিনি মনে করতেন আমার জন্মভূমিতে কেন পাসপোর্ট নিয়ে যেতে হবে, কেন আমাকে ভিসার মুখোমুখি হতে হবে আমারই নাড়ি পোতা দেশে যেতে? রাশীদুল হাসানদের এই দুঃখ ও বেদনা কতোটা মর্মস্পর্শী তা কখনওই কেউ উপলব্ধি করতে চাননি, সেদিনও না-আজও নয়। রাশীদুল হাসানের যন্ত্রণা থেকেও আমরা বুঝতে পারি, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ, আর পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ এক ও অভিন্ন নয়। একারণে বঙ্গ বা বাংলাভাগকে 'দেশভাগ' বলাও যুক্তিযুক্ত নয়।

গ. পৃষ্ঠা ৩১১-তে মননকুমার মণ্ডলের প্রশ্নের উত্তরে কথাকার নীহারুল ইসলাম বলছেন, 'মুর্শিদাবাদ জেলা ঘুরে আমি এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।…আমি কারও কাছেই শুনিনি যে, হ্যাঁ তাড়া খেয়ে এসেছি।…কেবল শুনেছি-ওই আসছে, অমুক গ্রামে সব পুড়িয়ে দিয়ে আসছে। অতএব আমাদেরকে চলে যেতে হবে।…তারা কেউই কিছু দেখেননি, জাস্ট একটা গুজবের ভিত্তিতে ভয়ে আতঙ্কে এখানে চলে এসেছেন।… আর তুলনামূলকভাবে এখানে থেকে মুসলমানরা কিন্তু খুব কম গেছে ওদেশে। গরিব মুসলমান যারা তারা তো যায়ইনি। কিছু ধনী মুসলমান গিয়েছিলেন অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার আশার।'

নীহারুল ইসলাম যে তথ্য এখানে দিয়েছেন তা আদতে কতোটা গভীরতলের সত্য, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। উনি জেনেছেন হিন্দুরা গুজবের ওপর ভর করে ওখানে গেছেন, ব্যাপারটা মোটেই সত্য নয়। আমাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার ফিলিনগর গ্রামের হিন্দুপাড়ায়। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রীযুক্তবাবু নারায়ণ চন্দ্র রায়। উনি সহ কয়েকজন দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কেবল আমার স্যারের কথা বলি। জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। অবসরের একেবারে শুরুতেই সপরিবারে দেশ ছাড়েন। এর পেছনে কোনপ্রকার গুজব ছিল না, ছিল নানাপ্রকারের তাড়া।

একজন শিক্ষক হওয়ার পরও যেভাবে অপমান, মানসিক অত্যাচার, নীরব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। রাষ্ট্র হয়তো উনাদের ওপর সরাসরি খড়গ তুলেননি, কিন্তু রক্ষা করার জন্য যা কিছুর নিশ্চয়তা দিতে হয়, তাও দেননি। এই সুযোগে সমাজ যতটা পেরেছে তার সবটাই প্রয়োগ করেছে। এমনকি পরিবারের নিরাপত্তাও ছিল কণ্টকিত। একারণে শেষ জীবনে জন্মভূমিকে আঁকড়ে থেকে নয়, দেশান্তরী হওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের ও পরিবারের মুক্তি খুঁজেছেন নারায়ণ বাবু। এখন উনি কি বলবেন কেন দেশ ছেড়ে গেলেন। দেশ-জন্মভূমি তো মায়ের মতো কোন সন্তানই কি বলেন মার মন্দকথা? এমনকি যারা আমেরিকা কানাডায় অভিবাসী হচ্ছেন তারাও কি বলবেন কেন তারা ওই জীবন বেছে নিলেন। কেবলই কি উন্নততর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়? নাকি এর নেপথ্য রয়েছে জন্মভূমি থেকে প্রাপ্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা কহতব্য নয়।

নীহারুল ইসলাম আরও বলেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে গরীব মুসলমান যাননি, ধনী মুসলমান গিয়েছেন অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার আশায়। একই কথা সেদিনের পূর্ববঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কেও বলা হয়েছিল। উনি ভারতে ফিরে গিয়ে প্রমাণ করেছিলেন উনার যোগ্যতা আছে সুতরাং উনি সবখানেই যোগ্য। যাওয়ার পেছনে অন্য কোন কারণ আছে। বেদনার বিষয় হল, নীহারুল ইসলামের মতো কথাকারও এসব বিষয়রে গভীরতা ও প্রকৃত অর্থ বুঝতে চাননি কিংবা বুঝে উঠতে পারেননি। নিজেদের ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমার বাবা-দাদারা ছিলেন বেশ সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবার। উনারা দেশান্তরী হয়েছিলেন শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে নিগ্রহের শিকার হয়ে।

একাধিকবার আমাদের পরিবারের ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল, শারীরিক নিগ্রহ ছাড়া সবই করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭এর ১৭ আগস্ট যখন উনাদের বাড়ি ঘর ভারতের অংশ হয়ে গেল, পরদিন উনাদেরকে বাধ্য করা হয় 'বন্দে মাতরম' উচ্চারিত মিছিলে যেতে, শ্লোগান দিতে। তার পরের অধ্যায়গুলো আরও বেদনার-যন্ত্রণাদগ্ধ এবং অকহতব্য। তারপর এক সকালে উনারা ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অজানায়, পরিবারের শিক্ষিতজন আমাদের বাবা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। খুঁজতে গিয়েছিলেন নতুন ঠিকানা, যেখানে সম্ভ্রম রক্ষা হবে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার মিলবে। তা হয়তো পেয়েছেন। কিন্তু সঙ্গে জুটেছে জন্মচিহ্নের মতো রিফুজির ছাপ।

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ - ১৪ মে ২০২০)

এই বইয়ের পৃষ্ঠা-১৬ তে লেখা হয়েছে, ''রিফ্যুজি নিচু মানুষ'', সংখ্যাগরিষ্ঠদের এরকমই বিশ্বাস, ব্যবহারে তার প্রকাশও ঘটে। অথচ প্রকৃতিও এটা মানতে নারাজ। 'রিফুজি লতা' নামে এক প্রকার গাছ রয়েছে। যার উপকারের অন্ত নেই। সম্ভবত 'তুলসী'র পর সবথেকে উপকারী হল এই লতা। এমনকি ডায়াবেটিস রোগেরও মহৌষধ হিসেবে স্বীকৃত। 'রিফুজি লতা'র মতো রিফুজিরাও পরম বন্ধু। কারণ সভ্যতার ইতিহাস রিফুজির ইতিহাস। এ কারণেই কবির উচ্চারণ, 'আদম ও হাওয়া, অ্যাডাম কিংবা ঈভ, দুর্গা-/মনু কিংবা শতরূপা যে নামেই ডাকো না কেন, জেনো এরা সব্বাই রিফিউজি'।

'বাংলার পার্টিশন-কথা : উত্তর প্রজন্মের খোঁজ' অভিধান গ্রন্থের মর্যাদা প্রাপ্তির দাবি রাখে। বঙ্গ বিভাজনকে এতোটা নির্মোহভাবে দেখার অবকাশ খুব কম বইয়ে রয়েছে। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই সম্পাদক বই জুড়ে বিশেষ যত্নের ছাপ রেখেছেন। আমরা যে প্রশ্ন ও তর্ক হাজির করেছি এই বইয়ের গুরুত্ব হল সেসব সামনে আনার সুযোগ করে দেওয়া। যা প্রকল্পকে করেছে উচ্চকিত ও অনন্য।

আমরা বলছি, বাংলার পার্টিশন-কথা এখনও অকহতব্য। এর জন্য আমরা শরণ নিয়েছি জীবনানন্দের। জন্মভূমি যদি মা-হন, তা হলে মাকে ছেড়ে আসার সব কথা কি বলা যায়? সবকথা বলার সময়-পরিসর ও পরিবেশ-পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি হয়েছে? বিশেষ করে যার সঙ্গে রয়েছে কলঙ্ক ও কালিমার যোগ। আলোচ্য বই তারপরও সেসবের অনেককিছু হাজির করেছে। দুই খণ্ডে যতটুকু হয়েছে তিন খণ্ডের বিস্তারে হয়তো অনেকাংশেই পূর্ণতা পাবে।

এই প্রকল্প নিজেদের অবস্থানকে সম্পূর্ণ উহ্য রেখে শুধু প্রযত্ন দিয়ে 'বাংলার পার্টিশন-কথা'র মতো বিশাল ক্যানভাসকে ধরতে চেয়েছে, যা তারিফযোগ্য। তারপরও নিজেদের কিছু প্রশ্ন, প্রস্তাবনা থাকলে তা-কি মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতো? যদি তা না হয়, তা হলে সেসব যুক্ত করা যেতেই পারে। দুই বাংলাতেই বাংলার পার্টিশন নিয়ে আলাপ তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল ও অচর্চিত। পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা হলেও বাংলাদেশে তাও গরহাজির।

সাহিত্যে যতটুকু জারি রয়েছে তা উপরতলার, রংমাখানো কিংবা প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরত্বের ভাষ্য। সেখানে এরকম প্রয়াস ও প্রচেষ্টা আশা জাগানিয়া। দেহে যেমন কোন ক্ষত হলে তার চিকিৎসা জরুরি, তা না হলে দেখা দিতে পারে ভয়ঙ্কর ব্যাধি ক্যান্সার। ঠিক তেমন ইতিহাসের বড় কোন ক্ষতকে আড়াল করে রাখলে তা জাতির ভাগ্যে ক্যান্সারের মতো ব্যাধির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে এসব নিয়ে আলোচনা ও তর্কের নিমিত্তে চর্চা জারি রাখাটা জরুরি। মননকুমার মণ্ডলের পরিচালনায় যা করছে নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে অন্যরাও আলো জ্বালুক বাংলার পার্টিশন কথায়।

Comments