আমাদের নারীরা কেন ‘রোকেয়া’ হয়ে উঠছেন না
রোকেয়ার আসল নামটি বেশ বড়। এর মধ্যে কেউ কেউ তার নামের সঙ্গে 'বেগম' থাকবে কী না, তাই নিয়ে ঢের আলাপী। ওসব প্রসঙ্গে যাব না। ওদিকে যাওয়া মানে প্রকারান্তরে 'রোকেয়া' নামটাকে অবমাননা করা। প্রশ্ন হল শুরুতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা কেন?
কারণ একটাই, ওই ধরনের তর্কবাজদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়া যে, এই লেখা উনাদের জন্য নয়। 'রোকেয়া'কে বুঝতে 'রোকেয়া' নামটাই সারবান। রোকেয়া এখন কেবলই কোন শব্দবন্ধ কিংবা কোনো মানুষের নাম নয়। রোকেয়া অর্থ প্রতিবাদ, সমানাধিকার, ন্যায্যতা, বাঁচার মতো বাঁচতে শেখা। রোকেয়া অর্থ চেতনা, মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মানের আধার বিশেষ। রোকেয়ার নারীবাদ কেবল নারীর অধিকার কিংবা নারীর মানুষ হয়ে ওঠার-পুরুষের সমান সুযোগ প্রাপ্তির সাধনা নয়, সত্যিকারার্থে রোকেয়ার অর্থ মানুষের-মানুষ হয়ে ওঠার 'সাধনা', যার মধ্যে নিহিত আছে উপরের সকল অর্থের একীভূত শব্দরূপ।
রোকেয়া জীবনভর সাধনা করে গেছেন, যার কেন্দ্রে ছিল নারী। রোকেয়া বিশ্বাস করতেন মানুষের মুক্তি ঘটবে না, যতক্ষণ না নারীর শিক্ষা-স্বাধীনতা নিশ্চিত হচ্ছে। নারীর মুক্তি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তিনি মূলত মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, নিয়েছেনও। যে সাধনা সভ্যতার শুরু থেকে করে এসেছে কতিপয় উজানে মানুষ; এক-একজন এক-এক ক্ষেত্রে, স্বাতন্ত্রিক পথে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও সাধনা জারি রাখার ব্রত দিয়ে। পরাধীন ভারত বর্ষে রাজা রামমোহন রায় যেমন সাধনা করে গেছেন ভারতের মুক্তির লক্ষ্যে। লালন যেমন সাধনা করে গেছেন জাতপাতের ভেদাভেদ আর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। মহাত্মা গান্ধী যেমন সাধনা করে গেছেন রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায়, যেখানে অহিংসা ও ন্যায্যতা হবে রাজ্য পরিচালনার মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন সাধনা করে গেছেন বাংলার তথা ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষ্যে-বিশ্বমাঝে ভারতকে প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষায়। একারণেই 'বিশ্বভারতী'র প্রতিপাদ্য বিশ্ব মাঝে ভারত, ভারত মাঝে বিশ্ব' অর্থাৎ বিশ্বের সঙ্গে ভারতের একটা আধ্যাত্মিক যোগসূত্র সাধন।
এসব কীর্তিমানদের মতো রোকেয়াও সাধনা করেছেন নারীর মুক্তির জন্য, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার বাসনা পূরণার্থে। বৃহত্তর এই সাধনা বাস্তবায়নে তিনি জীবনভর লড়াই করে গেছেন। জাগতিক চাওয়া-পাওয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, পরের হিতে নিজের সকল চাওয়া-পাওয়াকে বিসর্জন দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছে : 'পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন মন সকলি দাও;/তার মত সুখ কোথাও কি আছে?/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও,'। সত্যই রোকেয়া আপনার কথা ভুলে গেছিলেন। এ কারণেই তিনি বাংলার নারী মুক্তির অগ্রণী দূত হিসেবে বন্দিত। শুধু বাংলার কেন, অবিভক্ত ভারতের পুরুষের সাম্রাজ্যে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম কাণ্ডারী তিনি।
কেবল বাঙালি মুসলমান সমাজের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নয়, বাঙালি হিন্দু সমাজের নারী মুক্তির ক্ষেত্রেও বাংলা ও বাঙালির মধ্যে তিনি প্রথম পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এখানেই রোকেয়ার সাধনার সফলতা। তিনি কোন একক সম্প্রদায়ের নয়, সকল সম্প্রদায়ের, সকল নারীর মুক্তি চেয়েছেন। এই মুক্তি সমানাধিকারের লক্ষ্যে, পুরুষ কিংবা বিশেষ কোন বর্গকে অবনমন বা পদাবনত করার মধ্যে দিয়ে নয়। রোকেয়ার সেই প্রত্যয় ও প্রত্যাশা প্রকারান্তরে হয়ে উঠেছে, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার লড়াই ও সংগ্রাম।
রোকেয়ার জন্ম খ্রিস্টাব্দ ১৮৮০'র নয় ডিসেম্বর। ততদিনে বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ সাবালকত্ব পেয়েছে। বাংলার এই জাগরণের অভিঘাত পরের শতাব্দীর ঊষালগ্নে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবে জাগ্রত হয় ও ভিন্নমাত্রা পায়। যা পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়। এই যে, বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ থেকে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদ, তার সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার কারণে কিছু সমস্যারও জন্ম দেয়। ফলে, একক জাতীয়তাবাদের বদলে দুই ধারণার দ্বৈত জাতীয়তাবাদ সামনে এসে দাঁড়ায় : এক. বাঙালি হিন্দুর জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ, দুই. বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো ভারতীয় জাতীয়তাবাদও এভাবে বিভাজিত থাকে। ফলে, নামে একক জাতীয়তাবাদ হলেও তার বাস্তবতা ভেতরে ভেতরে খণ্ডিতরূপেই জাগ্রত হয়।
এখানে জোরদার একটা প্রশ্ন রয়েছে। দাম্পত্য জীবনে যুক্ত হওয়ার পর রোকেয়ার জীবনের পুরোটা সময় প্রথমে বিহারের ভাগলপুর এবং পরবর্তীতে কলকাতাতেই কাটে। ইহজাগতিকতায় দাঁড়িও পড়ে ওখানে। তা হলে ওই প্রসঙ্গের অবতারণা কেনো? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য একটু গৌরচন্দ্রিকা আবশ্যক।
বেঙ্গলী রেনেসাঁয় যেমন পূর্ববঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তেমনি মুসলমান সমাজকেও নয়। এই সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক কাউকেই বাংলার নবজাগরণে বিবেচনা করা হয়নি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে। অথচ বঙ্গে তখন হিন্দু জনসম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলমান জনসংখ্যার তুলনায় এর ব্যবধান খুব বেশি ছিল না।
বাংলার নবজাগরণের আরও একটি সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা হল, এই নবজাগরণে নারীর অংশগ্রহণ যেমন নিশ্চিত হয়নি, তেমনি যেসব নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন-উনাদেরকে সেভাবে মূল্যায়িত করা হয়নি। নারী ও পুরুষ উভয়ে মিলেই এই জগত সংসার হলেও এখানে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা রোকেয়া'র আগে কারও তরফে উচ্চকিত হয়নি। সতীদাহ প্রথা বন্ধ ও বিলুপ্তি, বিধবা বিবাহ প্রচলনের মতো মাইলফলক দৃষ্টান্তসমূহ বাংলার নবজাগরণের কালে বাস্তবায়ন হলেও নারীকে পুরুষের মতো একসঙ্গে সবকিছুর অগ্রভাগে শামিল করার আকাঙ্ক্ষা এই নবজাগরণে উচ্চকিত নয়-উচ্চারিতও নয়।
রোকেয়ার জন্ম পূর্ববঙ্গে, মুসলমান সমাজে এবং নারীরূপে; এই কারণে জীবনের বেশীরভাগ সময় কলকাতায় অতিবাহিত করলেও তিনি বেঙ্গলী রেনেসাঁর অভিভাবকতুল্য চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের তরফে সেটা দেওয়াও হয়নি। কারণ, আবুল মনসুর আহমদের ভাষায়, কলকাতার কাছে পূর্ববঙ্গ ছিল 'হিন্টারল্যান্ড' হিসেবে বিবেচ্য।
রুঢ় ও সকরুণ বাস্তবতার পাশাপাশি, রোকেয়ার জন্ম যে ১৮৮০ সালে সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে জেগে উঠেছিল প্যান ইসলামি আন্দোলন। যার প্রবক্তা জামালুদ্দিন-আল-আফগানি, যিনি মুসলিম বিশ্ব সফরের অংশ হিসেবে সেসময় কলকাতাও ঘুরে যান। রোকেয়া মারা যান ১৯৩২-র ৯ডিসেম্বর। ৫২ বছরের এই সময়ে বিশ্বে-ভারতে ও অবিভক্ত বাংলায় ইতিহাস তোলপাড় করা সব ঘটনার জন্ম হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বঙ্গভঙ্গের মতো ঘটনা ঘটে। যাকে কেন্দ্র করে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তার রাজনীতি প্রবলভাবে জেগে ওঠে এবং বাঁক বদল করে। স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেতনা দৃঢ় হতে শুরু করে। নানা ঘটনা পরিক্রমায় ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং ভারতের কেন্দ্রীয় রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। এর কিছুদিন পর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সময়ে সংঘটিত এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অভাবিত ও অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় পুরো পৃথিবী।
যার অভিঘাত লাগে, ভারতে-অবিভক্ত বঙ্গে বিশেষ করে কলকাতা ও ঢাকার জীবনে, শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন। হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত এই আন্দোলনে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে ভারতে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায়। তবে এই ঐক্য বেশিদিন টেকসই হয়নি। ভারতীয় মুসলমানদের নেতৃত্বে সংঘটিত হওয়া খিলাফত আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল তুরস্কের খলিফার খেলাফত রক্ষা করা। জালিয়ানওয়ালাবাগে গণহত্যার প্রতিবাদে ও রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন। মুসলিম নেতৃত্ব ও কংগ্রেস নেতৃত্ব উভয়বিধ আন্দোলনকে গণজোয়ারে পরিণত করার লক্ষ্যে, পারস্পরিক সম্মতিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে হিন্দু ও মুসলিমের সম্মিলন ঘটায়।
বেগম রোকেয়ার শৈশব-কৈশোর-বিবাহ ও কর্মজীবনের সময়ে এ সকল ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে। বাঙালি মুসলমান ঘরের নারীমাত্রই তখন অন্তঃপুরে আবদ্ধ। বাইরে বেরোনোর কোন অধিকার নেই, প্রত্যাশাও করেন না। প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ বলতে কিছুই বোঝে না। কেননা এসব দেখা ও সান্নিধ্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে ধর্মের নামে, সমাজের নামে, পুরুষতন্ত্রের নামে নানামুখী নিষেধাজ্ঞা-ফতোয়া। দেখার অনুমতি মেলে কেবল মাঝরাত্রির আকাশ ও তার নক্ষত্রমণ্ডলী। তাও আবার অমাবস্যায় অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের রাতগুলোতে, পূর্ণিমা বা শুক্লপক্ষে নয়। যাকে নিয়ে এই লেখা-ও আলাপ তিনি সেই সমাজের-ওই সময়ের মানুষ। রোকেয়ার জন্ম যে রংপুরে। সেখানে ইসলামের আগমন ঘটেছে বেশ আগে, ইসলামের আবির্ভাবের প্রত্যুষকালেই, সৌদি আরবের কাছাকাছি সময়ে। সেদিনের রঙ্গপুরের অনতিদূরের সাগরের ছড়া গ্রামেই পাওয়া গেছে ৪৯ হিজরিতে স্থাপিত হওয়া মসজিদের হদিশ। ফলে, পূর্ব ভারতের সেদিনের রঙ্গপুর অঞ্চলে সময় পরিক্রমায় ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রতাপ যেমন বেড়েছে, তেমনই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্মের নামে ফতোয়ার দৌরাত্ম্য, অধর্মের আগাছা। যা থেকে রোকেয়াদের 'সাবের' বংশও মুক্ত নয়। পরিবারে নারী শিক্ষা নিষেধ, বাবাকে আড়াল করে বড় ভাইদের কাছে বর্ণমালা শিখেছেন শিশু রোকেয়া, পাঠ নিয়েছেন শিশুশিক্ষার। কৈশোর বয়সে শিক্ষাপ্রীতি পূর্ণতা পেয়েছে স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের গৃহে, প্রেমময় সান্নিধ্যে। বালিকা বয়সে দেখেছেন সন্তানের মৃত্যু। যৌবনের প্রারম্ভেই শিকার হয়েছেন অকাল বৈধব্যের।
এ সবই রোকেয়ার জীবনপঞ্জির বাস্তবতা। যা বলা বা পাঠ করা যায় খুব সহজে। ঠিক যেন শৈশবেই রপ্ত হওয়া মুখস্থ ধারাপাত। কিন্তু এর পাতায় পাতায় যে লড়াই-সংগ্রাম, বেদনা ও হাহাকার লুকায়িত আছে, তাকে ভাষা দিয়ে গ্রেপ্তার করা যায় না। যেমনভাবে ভাষার কোনো শব্দমালাতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয় রোকেয়ার সাধনাকে। আমরা কেবল 'সাধনা' শব্দটাকে ব্যবহার করতে পারি। যদিও আমরা জানি এই শব্দ দিয়ে উনার মহত্তর চিন্তা, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ভাবনার যে মহত্তম প্রয়াস ও প্রচেষ্টা তার কোনকিছুকেই ওই মাত্রায়, যথার্থ উচ্চতায়-উচ্চকিত করা সম্ভব নয়। বড়ো জোর রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী'র প্রশ্ন হাজির করে বলতে পারা যায়, 'দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?/ পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।' কবি বাংলার 'চাষী'র ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, আমরা বঙ্গ রমণী-রংপুরের সাবের বংশোদ্ভূত 'রোকেয়া'কে নিয়ে একই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারি, নিশ্চয়।
সাধনা বুঝি এরকমই হওয়া লাগে। প্রকৃত সাধনার ধর্ম-বোধ করি এমনই। বিশ্বের এই বাস্তবতায়, দেশের ওরূপ পরিস্থিতিতে, সমাজের ওই কূপমণ্ডূকটায়, ধর্মের নামে অধর্মের উল্লম্ফনে, ব্যক্তিক ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতা-প্রতিকূলতায় এবং দুঃখ-কষ্ট-বেদনার গভীরতম হাহাকারের মধ্যেও তিনি নারীর মুক্তি, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমানাধিকারের লক্ষ্যে বিদ্যায়তনিক লড়াই জারি রেখেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন, দ্বারে দ্বারে গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেছেন, শিক্ষকতা ও পরিচালনা সবই করেছেন। একাই উজানে হেঁটেছেন। প্রতিষ্ঠানের শক্তিতে শিক্ষার আলোয় নারীকে আলোকিত করার প্রত্যয় জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও বলবৎ রেখেছেন।
আমরা সাম্প্রতিক সময়ে 'অ্যাক্টিভিস্ট' শব্দটার সঙ্গে ঢের পরিচিত। ইংরেজি এই শব্দটার বাংলা অর্থ হল- সক্রিয়তাবাদী ব্যক্তি, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। এই সক্রিয়তা মূলত বোঝায় রাজনীতির ক্ষেত্রে। রাজনীতির বাইরেও যে অ্যাক্টিভিজম হতে পারে এবং সেটা জোরদাররূপে জারি রাখা যায়। আজ থেকে শতবর্ষ আগে তার নজির রেখে গেছেন রোকেয়া। কেবল লেখালেখি নয়, প্রতিষ্ঠান করার মধ্য দিয়েও সেই প্রচেষ্টা বলবৎ হয়েছে। বর্তমানের অ্যাক্টিভিজমের বড়ো একটা অংশ জুড়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই অ্যাক্টিভিজম যতটা না রিয়েলিস্টিক, তার চেয়ে অধিক নন রিয়েলিস্টিক। অ্যাবসার্ডও বলা যেতে পারে। কারণ এর অ্যাপ্রোচের মধ্যে এসব ধারণা গভীরভাবে লুকায়িত আছে। রোকেয়ার অ্যাপ্রোচ এসবের সঙ্গে ঠিক মেলে না, সুযোগও নেই। উনার অ্যাক্টিভিজম কাগজে-কলমে নয় কেবল হাতে-কলমেও। সেখানে মনোজগৎ ও বস্তুজগৎ দুই-ই একাকার হয়ে হাজের-নাজেল রয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাতে তিনি যেমন সক্রিয় ছিলেন গভীরভাবে-প্রত্যয়ের সঙ্গে। ঠিক তেমনই কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রেও সক্রিয় ছিলেন বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে। এ কারণে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার্থী সংগ্রহে নেমে যখন দেখলেন, পর্দা হবে না জেনে অভিভাবকেরা মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চান না, তখন নিজে পর্দাপ্রথার বিরোধী হয়েও কেবল শিক্ষার্থী সংগ্রহের জন্য নিজেকে পর্দায় আবদ্ধ করেছেন।
উল্লেখ্য, রোকেয়ার বয়ানে আমরা জানি যে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই উনি পর্দা বা বোরকা পরা শুরু করেন। পরে যখন নিজেই হয়ে উঠেছেন নিজের অভিভাবক কিংবা আপন মতামত প্রকাশের অধিকারী, তখন পর্দা ছেড়েছেন। আবার নিজের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংগ্রহের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় পর্দা নিয়েছেন। সন্তান হারানোর বেদনা, দাম্পত্য সঙ্গী না থাকার নিঃসঙ্গতা, সমাজের ভ্রুকুটি- কোনোটাই উনার শ্রম নিবেদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অবশ্য তার মাশুলও দিয়েছেন, শারীরিকভাবে দুর্বল ও নানাবিধ রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। জীবনের এই বিপর্যাস অকাল মৃত্যুকে করেছে নিশ্চিত ও অবশ্যাম্ভাবি। কিন্তু রোকেয়ার 'অ্যাক্টিভিজম'কে প্রতিহত করতে পারিনি। এখানেই তিনি অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অনুকরণীয় একজন বুদ্ধিজীবী। রোকেয়া এ কারণে কেবলই কোন একটি নাম বা শব্দরূপ নয়, রোকেয়া একটা প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন প্রতিবাদী লেখক-প্রাবন্ধিককে, একজন মানবদরদী নারীবাদীকে, একজন হিতকারী সমাজ সংস্কারককে, একজন রেনেসাঁ নারীকে, একজন বন্দিত অ্যাক্টিভিস্টকে।
আমরা মনে করি, রোকেয়ার অ্যাক্টিভিজম- উনার সাধনারই সম্প্রসারিত রূপ। তিনি অ্যাক্টিভিজমকে সাধনায় রূপান্তরিত করেছিলেন, অথবা সাধনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অ্যাক্টিভিজমের স্তরে। এই যে, স্তরায়ন কিংবা একের অন্যরূপে-রূপান্তর এবং সেটা মনস্কামনা বা মনোবাঞ্ছা অনুযায়ী পরিচালন জারি রাখা। এমনতর চর্চা কেবল মহৎ মানুষের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। কেননা, মহত্তর সাধনায় ব্যাপৃত মানুষ লক্ষ্যকে কখনো উপলক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হতে দেন না। লক্ষ্যকে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে, এককথায় সর্বাবস্থায় সাধনা হিসেবে নেন। তখন সাধনার ধন ব্যতীত পৃথিবীর সকল কিছু উনাদের কাছে গৌণ হয়ে যায়। মহাভারতের অর্জুনকে আমরা দেখি এই রূপে। এ কারণে অর্জুন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। শিকারকে তীরবিদ্ধ করার জন্য যখন সে উদ্যত হয়, তখন তার চোখ কেবল শিকারকে দেখে। আশেপাশের সবকিছু সেই মুহূর্তে তখন 'নাই' বা শুন্য হয়ে যায়। লক্ষ্য আর সাধনা তখন একাকার হয়ে যায়। যে সাধনা জীবনভর জারি রেখেছিলেন রোকেয়া।
আমরা জানি না, সাধনার এই শক্তি রোকেয়া কোথা থেকে অর্জন করেছিলেন। কোন মন্ত্র বলে? দধীচির কাছে থেকে? দধীচি-কে, কী তার পরিচয়, তা হলে এক্ষণে জেনে নেয়া যাক। 'দধীচি' একটা পৌরাণিক চরিত্র, যার শব্দগত অর্থ হল বিশ্বের হিতার্থে আত্মদানকারী মহাপুরুষ। দধীচি'র রয়েছে আরও একটা পরিচয়। দধীচি শক্তির যোগান নিয়েছেন নিজের শরীর থেকে, অন্যের শরণাপন্ন বা দ্বারস্থ হননি কখনোই। রোকেয়া কি দধীচির মতো নয়, অবশ্যই। কেননা তিনিও শক্তি সঞ্চয় করেছেন নিজের থেকে। সব প্রতিকূলতাকে পরাভূত করে জয়ী হয়েছেন আপন সাধনা গুণে। পাশে পেয়েছেন কখনো ভাইদের-কখনোবা দাম্পত্যসঙ্গীকে। আবার সবসময় যে কাউকে না কাউকে পেয়েছেন, এমনও নয়। না পেলে একা হেঁটেছেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, একলা চলো রে' নীতিতে প্রত্যয়ী হয়েছেন। দধীচির মতোই তিনি পরের হিতার্থে এক জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
রোকেয়া এর চেয়ে আর কী করতে পারতেন? আর কিছু করার সুযোগ কি ছিল, ছিল না। তিনি লেখালেখি করছেন। এবং সেই লেখা কেবলই গল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধ কিংবা উপন্যাস নয়। ফর্মের আদলে হয়তো যথার্থ অর্থে সেগুলো তাই-ই। কিন্তু আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করি, তা হলে দেখব উনার লেখামাত্রই ফর্মের আকার থেকে বেরিয়ে এসে, কিংবা ফর্মের ভেতরে থেকেও গল্প-প্রবন্ধ-নিবন্ধ কিংবা উপন্যাসেরও 'অধিক কিছু' হয়ে উঠেছে। এবং রোকেয়ার সাধনা ছিল এই 'অধিক কিছু' হয়ে ওঠা-র নিমিত্তে। বেদনার হল, রোকেয়ার সৃজনশিল্পের এই 'অধিক কিছু'র জায়গাটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না বিদ্যায়তনিক জায়গায়। আমাদের বিদ্যায়তন এখনও আপাদমস্তকে ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোয় আবর্তিত ও সমর্পিত। ফলে, তার অন্বেষণ যতটা না দেশীয় ও আঞ্চলিক রেনেসাঁয়, আপন ভূগোলের মনীষায়, রাষ্ট্র-সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ ও পরম্পরতায়, তার চেয়ে অধিক প্রীতি অন্যত্র-পাশ্চাত্যে-ঔপনিবেশিকতায়। এই চর্চা ও অভ্যাসদাসত্বের কারণেই ফর্ম ভাঙা রোকেয়াকে ফর্মের ভেতরেই অন্বেষণ করা হয়।
রোকেয়া সারা জীবন উজানে হেঁটেছেন, লড়েছেন এবং লিখেছেন। যখন নারীর জন্য শিক্ষা ছিল অপরাধ, ছিল না নারীশিক্ষার কোন স্কুল কিংবা কলেজ। তখন তিনি নিজে লেখাপড়া শিখেছেন, চারদেয়ালের মধ্য থেকে। তারপর গণ্ডি ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন, ঘেরাটোপ মুক্ত হয়েছেন, নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন, নারীর উন্নতিকে সর্বাগ্র জ্ঞান করে নারীসংঘ-সমিতি করেছেন। এই যে নারীকে, চার দেয়ালের বাইরে বের করে আনার লড়াই-এটাকে রোকেয়া সাধনার স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার প্রথম রূপ, উনি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। দ্বিতীয়রূপ, লেখালেখিতে মূর্ত করে তুলেছেন। সুলতানার স্বপ্ন, মতিচুর সেসবের অনুপম সাক্ষ্য। তৃতীয়রূপ, উনার প্রতিষ্ঠান ভাবনা। শিক্ষাব্রতী ও সমাজসংস্কারক ভূমিকা।
রোকেয়ার বাংলায়-বাংলাদেশে এখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে 'রোকেয়া' নামে ছাত্রীনিবাসের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রোকেয়া'র নামে বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রংপুরে। স্কুল-কলেজও রয়েছে। আছে রোকেয়া দিবস, যা পালিত হয় জাতীয়ভাবেই। রোকেয়া স্মরণ-বন্দনার কমতি নেই মোটেই। কার্পণ্য আছে বলেও মনে হয় না। আয়োজন করে দেয়া হয় 'রোকেয়া পদক'। রোকেয়াকে ঘিরে সবই হচ্ছে, কেবল উনার পথে হাঁটা হচ্ছে না। আমাদের নারীরা-রোকেয়ারা, কেউই সদর্থক অর্থে 'রোকেয়া' হয়ে উঠছেন না।
অথচ রোকেয়ার নারীবাদে রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীবাদী ভাবনার আলোকায়ন। আমরা, আমাদের বিদ্যায়তন, শাসক ও প্রশাসকবর্গ কি সেই আলোকায়নের গুরুত্ব হার্দিকভাবে উপলব্ধি করবে কবে? আর কত রোকেয়া নাম্নী অবকাঠামো, দিবস ও পদক প্রদানের পর আমাদের উপলব্ধি হবে যে, এভাবে-এরূপে আর যাই-ই হোক একজন 'রোকেয়া' তৈরি হবে না। আমাদের চারপাশ দেখে কেউ কি বলবে যে, এখানে একজন রোকেয়া আবির্ভূত হয়েছিলেন নারীর মুক্তির লক্ষ্যে, নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায়-জ্ঞানবিজ্ঞানে নারীকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয়ে, বলবে না। কবে এদেশ-রাষ্ট্র-সমাজে নারীকে রোকেয়া হয়ে ওঠার মন্ত্রে জাগরিত করবে? নাকি, কেবলই স্মরণ-বন্দনার নামে আড়াল করা হবে রোকেয়া-র সাধনা, নারীর মুক্তি আর মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার লড়াই ও সংগ্রামকে।
Comments