রাষ্ট্রের সংকটে প্রাসঙ্গিক নাজমুল করিমের সাধনা
আবুল খায়ের নাজমুল করিম সর্বজনে এ কে নাজমুল করিম নামে পরিচিত। একজন সমাজ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশের সমাজ বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসেবে তিনি বরেণ্য, মান্যতাও পেয়েছেন।
'নাজমুল করিম : একজন সমাজবিজ্ঞানী ও তার দৃষ্টিভঙ্গি' শীর্ষক লেখায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, 'রবি গুহ (রবীন্দ্রনাথ গুহ) জানাচ্ছেন যে, নাজমুল করিম এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। চিঠিতে এটাও বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার পথ নেই। মনে রাখা দরকার যে চিঠিটি তিনি লিখেছেন ১৯৫২ সালে, নিউ ইয়র্ক থেকে, যেখানকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়তে গেছেন ইস্ট পাকিস্তান স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে। পেছনে ফিরে তাকালে বুঝতে পারি কত আগে তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছেন যে পূর্ববঙ্গ ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং ওই ঔপনিবেশিক শোষণব্যবস্থা থেকে বের হতে না-পারলে পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য বাঁচার কোনো উপায় নেই। এই বাস্তবটা তখন অনেকেই বোঝেননি, বুঝতে চানওনি। এমনকি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যারা ছিলেন তাঁরাও কেউ কেউ দ্বিধান্বিত ছিলেন সত্যটাকে মেনে নিতে। তারা একটি তাত্ত্বিক নিষেধাজ্ঞার ভ্রান্তিতে পড়েছিলেন।'
প্রশ্ন হল, যে বিষয়টা কমিউনিস্টরা বুঝতে পারেননি, মার্কসবাদী-সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীদের তখনো গোচরে আসেনি, এমনকি সেই অর্থে কারোর ধারণায় উপ্তও হয়নি, তখন বিষয়টা নাজমুল করিমের চিন্তায় কেনো ধরা দিল? আরও চিত্তাকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক হল, যখন বিষয়টা উনার ভেতরে দানা বাঁধছে বা একটা শিশুর জন্মের মতো করে ভ্রুনায়িত হচ্ছে তখন তিনি ইস্ট পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে গবেষণারত। বিষয়টা অনুসন্ধান ও উন্মোচনে আমাদেরকে আরও একটু পেছনে যেতে হবে। কারণ এই বিষয়ের সুলুকসন্ধান নিহিত আছে ওই ঘটনা বা লেখনীর গভীরে।
নাজমুল করিম জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায়। স্থান অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুর থানা সদরে। এই নোয়াখালীকে বিশেষভাবে মনে রাখা জরুরি। এই নোয়াখালীই কি 'লালসালু'র মজিদের জনপদ? যার চিত্র উঠে এসেছে মজিদের বয়ানে এভাবে, 'শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি'। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কোথাও বলেননি মজিদের জনপদ কোনটি, কোথায় এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের শেকড়বাকড়। বলা না হলেও যে চিত্র এঁকেছেন লেখক, তাতে কারোরই বুঝতে বাকী থাকে না পূর্ববঙ্গের কোন জনপদের চিত্র হাজির রয়েছে 'লালসালু'-তে। কেন এ প্রসঙ্গের অবতারণ তার খোলতাই একটু পরে করা যাক। শুধু এটুকু বলা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আর নাজমুল করিম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একেবারে 'হরিহর আত্মা' বলতে যা বোঝায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিশেষ।
নাজমুল করিম নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করলেও পৈতৃক নিবাস ছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ফাল্গুনকরা গ্রাম। সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন 'ডেইলি স্টার বাংলা'য় এক সাক্ষাৎকারে জানান, এই গ্রামে বন্ধুসূত্রে এসেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। এবং বন্ধুর দাদার কবর দেখে তিনি মজিদের মাজারের ধারণাটা হেফজ করেন। নাজমুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় দুটি প্রবন্ধ লিখে বিদ্বৎসমাজে সাড়া ফেলে দেন। এক. ধর্মের বিবর্তন ও মার্কসবাদ (অরণি, কলকাতা) এবং দুই. 'ভূগোল ও ভগবান' (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী।
নাজমুল করিম যখন প্রবন্ধ দুটো লিখছেন তখন পাকিস্তান আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে এবং তুঙ্গ ছুঁইছুঁই। ইসলামের জজবায় তরঙ্গায়িত হচ্ছে বাঙালি মুসলমান। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান, যারা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ রদে মনে করেছে তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বতন্ত্র সত্তা নির্মাণের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এমনকি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের নবজাগরণের যে ঢেউ সূচিত হয় তার পর্বান্তর তখনও ঘটেনি। এ সময়ে নাজমুল করিম উল্লিখিত প্রবন্ধ দুটোর মধ্য দিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন এবং দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম নিয়ে আকর চিন্তার খোরাক যুগিয়েছেন। উদ্দিষ্ট বিষয়ের কোনো প্রসঙ্গেই তিনি 'ঢাক ঢাক গুড় গুড', আড়াল বা অবগুণ্ঠনের চেষ্টা করেননি ; তা সে যতই সংবেদনশীল হোক না কেন।
প্রবন্ধ দুটোতে ধর্ম আলোচনার ভরকেন্দ্র হলেও পাটাতন কিন্তু সমাজ। নির্দিষ্ট বা একক কোন ধর্ম উনার আলোচনার বিষয়ও নয়। সব ধর্মকে ধরেই তিনি আলোচনা ব্যাপ্ত করেছেন। ধর্মের উৎপত্তি থেকে তার পর্যায়ক্রমিক বিকাশ অঞ্চলভেদে কীভাবে-কীরূপে-কী প্রয়োজনে, কোন আদলকে সামনে রেখে হয়েছে তার একটা চিত্র হাজির করেছেন। লেখকের নিয়ত যে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ তা নিয়ে বাৎচিত করার সুযোগ নেই। সেই সময়ে এ ধরণের প্রবন্ধ লেখা ঝুঁকিপূর্ণ, লেখক সেখানে বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নেও কামিয়াব হয়েছেন। সমাজ সংলগ্নতায় ও ভাবনায় এবং সমাজকে অন্বেষণ-অনুসন্ধান ও বিনির্মাণের প্রশ্নে তিনি যে তাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানী হয়ে উঠবেন তার দালিলিক প্রমাণ ও সমাজমনস্ক মনের উপস্থিতি রয়েছে ওই লেখায়। যে কারণে নাজমুল করিমই কেবল (এমনকি কমিউনিস্টরাও না) ১৯৫২ সালেই ভাবতে পেরেছিলেন আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছি। এক উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে আমরা আরেক উপনিবেশের ভেতর আটকা পড়েছি।
আবারও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ওই লেখা থেকে উদ্ধৃত করি, 'তাদের (কমিউনিস্টদের) ধারণা ছিল পাকিস্তান নিজেই একটি উপনিবেশ, আর তাই যদি হয় তা হলে পূর্ব পাকিস্তান কী করে তার উপনিবেশ হবে, উপনিবেশ কী করে উপনিবেশের মালিক হয়? বুঝতে চাননি যে উপনিবেশের অধীনে উপনিবেশ না-থাকুক, আধা উপনিবেশ তো থাকতেই পারে। তারা ভাবছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনেই শ্রেণীযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদেরকে শত্রু বলে মনে করছে সেই সত্যটা বরঞ্চ জাতীয়তাবাদীরা বুঝেছিলেন, এবং তাই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ পুঁজিবাদে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হলো, সমাজতন্ত্রীরা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলেন।' সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এ মন্তব্যের সূত্র ধরে এই সিদ্ধান্তে কি আসা যায়? এদেশের কমিউনিস্টদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও গৌরবজনক অবদান থাকলেও, মনেপ্রাণে সমাজতন্ত্রের ধারক বাহক হলেও, উনারা বাংলাদেশের সমাজটাকে যথার্থ অর্থে বুঝতে চাননি, পূর্ববঙ্গের সমাজের গড়নটাকে আবিষ্কার করতে পারেননি। সমাজের পালস বা নার্ভ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা অনুভব করেননি। সমাজের ভেতরে প্রবহমান তরঙ্গকে পরখ করে উঠেননি । একটা সমাজের ভেতরে যে অনেকগুলো স্তর থাকে (কমিউনিস্টদের ভাষায় শ্রেণী) তার প্রত্যেকটিকে শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। ফলে, সমাজের ভেতরে ভেতরে সংঘটিত পরিবর্তনকে বোঝা সম্ভব হয়নি। যেটা বুঝতে পেরেছিলেন নাজমুল করিম। এ কারণে, ১৯৫২তেই তিনি বিষয়টা অনুভব করেছিলেন , ১৯৭১-এ এসে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্যে দিয়ে বিষয়টা আক্ষরিক অর্থেই সত্যে পরিণত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকে অবিভক্ত বঙ্গে নবজাগরণ সংঘটিত হলেও, প্রধানত তার ঢেউ সীমাবদ্ধ ছিল কলকাতা ও তার আশেপাশেই। বেঙ্গলি রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত এই নবজাগরণের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পৃক্ততা ছিল না। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পূর্ববঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের নবজাগরণ সংঘটিত হয়। এই নবজাগরণ ছিল তিন পর্বের সময়সীমায়। প্রথম পর্ব ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ পর্যান্ত, যাকে বলা যেতে পেরে সূচনা বা উন্মেষকাল। দ্বিতীয় পর্ব ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যান্ত, এই সময়সীমা হল বিকাশকাল । তৃতীয় পর্ব হল ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যান্ত, যাকে বলা যেতে পারে নির্মাণকাল বা চূড়ান্ত পরিণতি পর্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের নবজাগরণ তার বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।
এই নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য হল, এর উন্মেষ, বিকাশ ও নির্মাণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ঢাকায় সংঘটিত হলেও ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিনের পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র। নাজমুল করিম এই ঢেউ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। উনার সমাজমনস্ক মন এই ঢেউকে অবলোকন করতে সমর্থ হয়েছিল। সমাজের এই পাঠে তিনি আগ্রহী ছিলেন, পুরো বিষয়টাকে সাধনা হিসেবে জ্ঞান করেছিলেন। এ কারণেই উনার পক্ষে ১৯৫-তেই পাকিস্তান প্রশ্নে এরকম একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়েছিল। বেদনা ও পরিতাপের বিষয় হল, নাজমুল করিম বাংলাদেশটাকে আরও সফল ও স্বার্থকভাবে নির্মাণের প্রশ্নে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার ফেরিওয়ালা সেভাবে দৃশ্যমান নয়। স্বাধীন বাংলাদেশর বয়স যত বেড়েছে তার সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গাগুলোকে তত শিথিল করে তোলা হয়েছে। সমাজ যে মানুষের সভ্যতার সবচেয়ে আদি ও গুরুত্ববহ সংগঠন সেই চেতনাও আড়ালে পড়ে রয়েছে। যে সব উপাদান ও উপকরণের মধ্যে দিয়ে সমাজ শক্তিশালী হয়, দেশের মানুষের কল্যাণ, শান্তি, উন্নয়ন, ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হয় সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সামাজিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে প্রযত্ন না দিয়ে নানা কৌশলে দূরীভূত করা হয়েছে। ফলে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা কল্যাণ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারিনি। মানবতাবোধ নিশ্চিত করা যায়নি। সব মানুষের ন্যায্য অধিকার আজোও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সামাজিক সংগঠন ও সমাজ- সংস্কৃতির গভীরেই যে কল্যাণ রাষ্ট্রের বীজ নিহিত রয়েছে সেই কথাও আমরা ভুলতে বসেছি। বাংলাদেশের প্রকৃত মঙ্গল সমাজের অভ্যন্তরেই বিরাজিত। কারণ প্রাচ্য সমাজ নির্ভর সভ্যতার প্রতিভূ। এই সভ্যতাকে বুঝতে হলে প্রদীপ জ্বালাতে হবে সমাজের অভ্যন্তরে। যার সুলুক সন্ধান জারি রয়েছে নাজমুল করিমের 'ধর্মের বির্বতন ও মার্কসবাদ' এবং 'ভূগোল ও ভগবান' প্রবন্ধসহ অন্যান্য লেখালেখিতে-সমাজ বিজ্ঞান চর্চায় এবং জ্ঞানকাণ্ডের ভেতর-বাহিরে।
মোহাম্মদ আজম 'গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ : ওয়ালীউল্লাহ্ চর্চা প্রসঙ্গে' এক লেখায় উল্লেখ করেছেন (প্রবন্ধটি অপ্রকাশিত), ''ওয়ালীউল্লাহ করাচীতে বদলি হয়ে বন্ধু নাজমুল করিমকে লিখেছিলেন, ভালোই আছি। বোধ হয়, 'আমারপূর্ব-পুরুষরা আরব অঞ্চল থেকে এসেছে বলে' নৈকট্যজনিত খারাপ লাগছে না। মকসুদ সাহেব এ বিবৃতির জন্যও কৈফিয়ত দেবার দরকার বোধ করেছেন। এরকম উদাহরণ দেখি 'করাচী লেখক সম্মেলন '৫৯'-এর বর্ণনায়ও। ওয়ালীউল্লাহ্ এ সম্মেলনে বিশেষ তৎপর ছিলেন না, সরকারি চাকরির কারণে একেবারে যোগ না-দিয়ে পারেননি, এরকম একটা ভঙ্গিতে তিনি পুরো বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ অন্য সব বাংলাদেশি লেখকরা-যে ভীষণ আগ্রহের সাথে দুইমাস পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন সরকারি টাকায়, তারও উল্লেখ করেছেন । এ দ্বারা কী বোঝায়? ওয়ালীউল্লাহ কি তখনি বেশ 'পাকিস্তান-বিদ্বেষী' হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে পূর্ব বাংলার গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের প্রায় সবাই ছিলেন যথেষ্ট 'পাকিস্তানবাদী'?''
অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ''ওয়ালীউল্লাহর মতাদর্শ, সাহিত্যিক সহযাত্রী ও রাষ্ট্রপক্ষের সাথে সম্পর্ক শনাক্ত করতে করতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ পাকিস্তান রাষ্ট্র ও 'পাকিস্তানবাদী' মানসিকতার বিরোধী এক প্রবল পক্ষ সাব্যস্ত করেতে চেয়েছেন। ঢাকার সংস্কৃতিতে আশির দশকে প্রবল হয়ে ওঠা এ প্রভাবশালী ডিসকোর্স তিনি কেবল সম্পূর্ণ অনুমোদনই করেন নাই, ওয়ালীউল্লাহকে অবলম্বন করে তাতে বাড়তি মেদ সঞ্চারেও প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু একটা আসলে ভিত্তিহীন বাইনারী। ঢাকার প্রভাবশালী শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে পাকিস্তান আমলের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এমন কিছু আসলে ছিল না, যাকে পাকিস্তান রাষ্ট্র-বিরোধী বলে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। ওয়ালীউল্লাহর 'পাকিস্তান-বিরোধী ' অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য আবুল মকসুদ যেসব তথ্য ব্যবহার করেছেন সেগুলো একটি আরেকটিকে খারিজ করে, তাঁকে বাদ দিয়ে বাকি বিপুল লেখক-সাহিত্যিককে বিপরীত কোটায় ফেলে দেয়, আর এভাবে শেষ পর্যন্ত পুরা বাইনারিটিই ধসে পড়ে।''
এক্ষণে আমরা যদি ১৯৫২-তে রবি গুহকে লেখা নাজমুল করিমের চিঠির উপর্যুক্ত বক্তব্য স্মরণ করি, তাহলে কী দাঁড়ায়? মোহাম্মদ আজম যেভাবে সৈয়দ আবুল মকসুদকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, যেভাবে 'বাইনারী' ধসে পড়ার যুক্তি দেখিয়েছেন তা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? আমাদেরতো এটাও স্মরণে রাখতে হবে নাজমুল করিম ও ওয়ালীউল্লাহ্ ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হরিহর আত্মা বিশেষ ছিলেন; যা এ লেখায় পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। দুজনের সম্পর্ককে আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াও যৌক্তিক যে, নাজমুল করিমের সমাজ ভাবনা-সমাজের গভীরপাঠ, অনুসন্ধান ও উন্মোচন ওয়ালীউল্লাহ্-কে প্রভাবিত করেছিল। যার সাক্ষ্য মেলে অনুপম সেনের সাক্ষাৎকারেও। নাজমুল করিমের বন্ধুতায় ওয়ালীউল্লাহ্-কে 'লালসালু'র মতো উপন্যাস, 'নয়নচারা', 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী'র মতো সমাজঘনিষ্ঠ লেখার প্রেরণা যুগিয়েছিল। আমাদেরকে এটাও স্মরণে রাখা জরুরি যে, 'লালসালু' উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য কী? যার সহজ ও যুতসই উত্তর রয়েছে এই উপন্যাসের ইংরেজি নামকরণের মধ্যে 'ট্রি উইদাউট রুটস'।
নাজমুল করিম সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে সমাজের অভ্যন্তরে আমাদের রুটস অর্থাৎ শেকড় খুঁজতে ব্রতী হয়েছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ লেখক হিসেবে কথা সাহিত্যের ভেতর দিয়ে শেকড় খুঁজতে চেয়েছেন, 'লালসালু'র আড়ালে কী রয়েছে তা তালাশের চেষ্টাকে সাধনা হিসেবে নিয়েছেন। দু'জনের ভরকেন্দ্র সমাজ। কারণ সমাজের গভীরেই সুপ্ত রয়েছে মানুষের শেকড়, সভ্যতার অগ্রগমনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মোহাম্মদ আজম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র পাকিস্তান সরকারের চাকরির উদাহরণ টেনেছেন এবং সময়কে-ষাটের দশককে গুরুত্বের সঙ্গে হাজির করে সৈয়দ আবুল মকসুদের যুক্তিকে খারিজ করে দিয়েছেন।
নাজমুল করিম যখন বন্ধু রবী গুহ ওই চিঠি লিখছেন তখন পঞ্চাশের দশকের সূচনালগ্ন, তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন এবং সেটা তৎকালীন সরকারের দেয়া বৃত্তির বদৌলতে। তা হলে সৈয়দ আবুল মকসুদ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র পাকিস্তান বিদ্বেষ প্রশ্নে যে অবলোকন জারি রেখেছেন তাতো মান্যতা পাওয়ারা যৌক্তিক দাবি রাখে। আর একথা তো সত্যি ৫২-তে এসে বাঙালিদের কাছে অনেককিছুই পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করে। সমাজের ভেতরে যদি ওরকম কোন তরঙ্গ না দেখা দেয় তা হলে, বায়ান্নোর ভাষার আন্দোলন এভাবে কি সর্বপ্লাবি হয়ে উঠতো? নাজমুল করিমের সমাজ অনুসন্ধানকে বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে ভ্রান্তির অবকাশ নিশ্চিতভাবেই ঠুনকো হয়ে আসে।
এবার আসা যাক, আকবর আলি খানের সমাজ-অনুসন্ধান প্রশ্নে। উনার বহুল আলোচিত বই 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য'। এখানে তিনি বাংলায় অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে কেনো ইসলাম প্রচার এতোটা সাফল্য পেলো তার প্রকৃত কারণ ও গুঢ় রহস্য অনুসন্ধান ও উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। এবং শেষে একে 'প্রহেলিকা' আখ্যা দিয়ে ইতি টেনেছেন। বিষয়টা কিন্তু মোটেই প্রহেলিকা নয়, যদি আমরা বাংলার সমাজটাকে বুঝতে পারি। আকবর আলি খান সমাজকে ভরকেন্দ্রে রেখে কিছু যুক্তি হাজির করেছেন। বাংলার 'সমাজের গড়ন' নিয়ে কথা বলেছেন কিন্তু পুরো বিষয়টাকে পাখির দৃষ্টিতে দেখেননি।
বাংলার সমাজের অতীত, বিশেষ করে দেড় হাজার বছরের অতীত, তার ভাঙ্গা গড়াকে যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখার চেষ্টা করা হয় তাহলে 'প্রহেলিকা'র পর্দা ক্রমশ সরে যেতে বাধ্য। এর সঙ্গে যদি আমরা বাংলার নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, অভিবাসনের ইতিহাসসমূহ, ভূমির গড়ন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদীসমূহের বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়ার ধরণ, জলবায়ুর প্রভাব, ঋতুবৈচিত্র্য, মৌসুমী বায়ুর প্রতি দৃষ্টি দিই তাহলে বাংলায় কেন ইসলাম প্রচারের এরূপ সাফল্য ঘটল তার উত্তর অনেকাংশেই পাওয়া যায়। এর সঙ্গে যদি বাংলার সমাজের সঙে রাজা-বাদশাহ-জমিদারদের সম্পর্ক, প্রশাসনিক লেনদেন, জাতপাত ভেদ কেমন ছিল সেটা বোঝার চেষ্টা করা হয়, তাতেও 'প্রহেলিকা' অনেকাংশেই খোলতাই হয়ে ওঠে। এখানকার সমাজের সঙ্গে আঞ্চলিক অর্থাৎ ভারতবর্ষীয় এলাকার এবং এর বাইরে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক কেমন ছিল সেটার প্রতি আলোকপাত করা যায় তাহলে 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য' কোন 'প্রহেলিকায়' আবদ্ধ না থেকে পরিষ্কারভাবে ধরা দেয়।
আমাদের সমাজের এই রূপকে, খোলনলচেসহ বুঝতে এক জীবনের লিপ্ততা জারি রেখেছিলেন নাজমুল করিম। এ কারণেই অন্যদের কাছে যা 'বাইনারী ধসে পড়ার শামিল', 'প্রহেলিকা' উনার কাছে সেটা প্রত্যক্ষরূপেই ধরা দেয়। সমাজের ভেতর-বাহির ও এর গভীরে থাকা ইতিহাসকে তিনি কেবল অন্বেষণ করেননি এর রূপটিরও নিবিড় পাঠ দাঁড় করিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের জনক। উনার অগ্রণী চেষ্টাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। বেদনার হল, রাষ্ট্র নামক প্রপঞ্চের চাপে ও তাপে আমাদের সমাজ দ্রুত সংকুচিত ও গৌণ হয়ে পড়ছে।
সমাজের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত প্যারামিটারগুলো (চরিত্র নির্ধারক বৈশিষ্ট্যসমূহ) দুর্বল ও অকেজো হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রকে সকল শক্তির আধার ও ক্ষমতার কাঠামোর মৌল ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানোর কোশেশ জারি করা হচ্ছে। ফলে, রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে শুভবোধ, কল্যাণ চিন্তা, সমগ্র হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, নৈতিকতা চর্চার বাসনা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্য, বাক্ স্বাধীনতার ন্যায্যতা ক্রমশ অপসৃয়মান হচ্ছে। এ অবস্থা রোধে নাজমুল করিমের সাধনা আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে উঠতে পারে। উনার সমাজ ভাবনায় রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার-কল্যাণ ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিগণিত করার বারতাও রয়েছে। এ কারণে নাজমুল করিমের সাধনা আমাদের দেশ-সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এক নির্দেশিকা।
Comments