বিরুদ্ধ সময়ের যাত্রী সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ

এই সময়ের বাংলাদেশে প্রতিবাদের একটি বড় অস্ত্র স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ; বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেননা সিরিয়াস বিষয়ে সিরিয়াস প্রতিবাদ করলে সেখানে রাজনৈতিক তথা দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া তো বটেই—আইনি ঝামেলায় পড়ারও সমূহ শঙ্কা থাকে। সঙ্গত কারণেই নাগরিকরা এই হুজ্জত এড়াতে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সিরিয়াস বিষয় নিয়েও রসিকতা করেন।

পাক-ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ নিজের লেখালেখিতে এই স্যাটায়ারকে বেছে নিয়েছিলেন সম্ভবত দুই কারণে; ১. রসিকতা করে অনেক কঠিন কথা বলে দেয়া যায়, তাতে যাকে উদ্দেশ করে বলা হলো, তিনি চট করে এর প্রতিবাদ করতে পারেন না বা কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না এবং ২. সিরিয়াস বিষয় সিরিয়াস ভঙ্গিতে ও কঠিন ভাষায় বললে বা লিখলে সেটি অনেক সময় পাঠকের সঙ্গে সহজ যোগাযোগে অন্তরায় তৈরি করে। তাই পাঠককে দ্রুত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা এবং তাকে আনন্দ ও বিনোদনের মাধ্যমে রাজনীতি-সমাজ ও অর্থনীতির খটমট বিষয় বোঝানো সহজ হয়।

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিবিদ হিসেবেই তিনি খ্যাত হলেও তার সাহিত্য, বিশেষ করে তার সাংবাদিকতার বিষয় নির্বাচন, ভাষা ও বলার ভঙ্গি একুশ শতকে এসেও কেন প্রাসঙ্গিক, সেই প্রসঙ্গে আলোচনা। 

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং রূপসী বাংলার কবিখ্যাত জীবনানন্দ দাশের সমবয়সী আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বিভাগপূর্ব বাংলার একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক। মজার ব্যাপার হলো, গত শতাব্দীর বিশের দশকে আবুল মনসুর আহমদ, কাজী নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ—তিনজনই কলকাতায় ছিলেন।

আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা শুরু ১৯২৩ সালে এবং মাঝখানে কিছু সময় বাদ দিয়ে তা চলে ১৯৫০ সাল অবধি। জীবনানন্দ দাশও ঠিক এর আগের বছর, অর্থাৎ ১৯২২ সালে পড়ালেখা শেষ করে ইংরেজির জুনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন কলকাতার সিটি কলেজে। পরে অবশ্য বাংলাদেশ ও ভারতের নানা জায়গায় পড়িয়েছেন। আর আবুল মনসুর আহমদ পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চাকরি করেছেন। এমনকি সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৯২৩ সনে তিনি চাকরির উদ্দেশে কলকাতায় যান এবং ১৯২৯ সন পর্যন্ত কয়েকটি পত্রিকায় চাকরি করে ময়মনসিংহে ফিরে যান। জীবিকার তাগিদেই ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় এসে বাল্যবন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুসলিম জগত পত্রিকায় কাজ করেন। যদিও সেখানে কোনো নিয়মিত বেতন ছিল না। অনেকটা 'পেটে-ভাতে'।

মজার ব্যাপার হলো, আবুল মনুসর গত শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতে তৎকালীন খ্যাতিমান সাংবাদিকদের নজরে পড়েন স্যাটায়ার লিখে। ১৯২৩ সালে 'মুসলিম জগত' পত্রিকায় 'ছহি বড় সোনাভানের' অনুকরণে 'ছহি বড় তৈয়বনামা' নামে একটি স্যাটায়ার কাব্য এবং 'সভ্যতার দ্বৈত শাসন' নামে একটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখলে তিনি অনেকেরই নজরে পড়েন। ফলে দেখা যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার পেছনেও স্যাটায়ের একটা বড় ভূমিকা ছিল।

এই সময়ে সাংবাদিকতা যেমন আর দশটি চাকরির মতোই, অর্থাৎ বেতননির্ভর কাজ, গত শতাব্দীতে বিষয়টি এরকম ছিল না। তখন সাংবাদিকতা ছিল মূলত নেশা এবং অনেকেই অ্যাক্টিভিজমের পার্ট হিসেবে জার্নালিজমকে গ্রহণ করতেন। অর্থাৎ একইসঙ্গে জার্নালিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট।

১৯২৩ সনের জানুয়ারি মাসে দেশবন্ধু তার সমর্থকদের নিয়ে স্বরাজ্য দল গঠন করলে আবুল মনসুর আহমদ একজন কংগ্রেস-কর্মী ও সাংবাদিক হিসেবে প্রথমে এ দলকে সমর্থন না করলেও পরে একে সমর্থন করেন এবং ১৯২৩ সনের মার্চ মাসে আইনসভার নির্বাচনে ময়মনসিংহ অঞ্চলের স্বরাজ্য দলের প্রার্থী তৈয়বউদ্দিন আহমদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালান এবং নির্বাচনী ইশতাহারও লেখেন। 

ওই বছরের এপ্রিল মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে ঐতিহাসিক 'বেঙ্গল প্যাক্ট'সম্পাদিত হলে সাংবাদিক হিসেবে এর সমর্থন করেন এবং ছোলতান পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। তার মানে সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ তখন একইসঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীও।

আমরা দেখব, তার সমসাময়িক কাজী নজরুলের যে কবিতা, সেটিও ওই সময়ের রাজনৈতিক স্লোগান। আবুল মনসুর আহমদের কাছে সাংবাদিকতা ও লেখালেখি যেমন ছিল তার রাজনীতি, নজরুলের রাজনীতিও এগিয়ে নিয়েছে তার কবিতা। যে রাজনীতির মূল কথা দেশ ও মানুষের মুক্তি। এইখানে জীবনানন্দ কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি নীরবে নিভৃতে কিছুটা আবছায়া কিছুটা বিমূর্ত ভঙ্গিতে রাজনীতিকে দেখলেন এবং দেখালেন। যদিও তার কবিতায় দেশ তথা বাংলাদেশ এসেছে কাজী নজরুলের চেয়ে অনেক বেশি। শব্দ দিয়ে জীবনানন্দ বাংলাদেশের যে ছবি আঁকলেন, সেটি আর কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হল না। অর্থাৎ এটিও জীবনানন্দের রাজনীতি। তবে ধরনটি আলাদা।

এই সময়ে সাংবাদিকতাকে যেমন একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিশ ও ত্রিশের দশকে সেটি এত সহজ ছিল না। ছিল না বলেই সাংসারিক টানাপোড়েনের কারণে ১৯২৯ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে আইন পেশায় নামেন আবুল মনসুর আহমদ। তবে এই সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯২২ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত লেখা তার কয়েকটি ব্যঙ্গগল্প 'সওগাত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং এই গল্পগুলো সংকলিত করে ১৯৩৫ সনে তার বিখ্যাত 'আয়না' গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যকর্মও শুরু করেন। তিনি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন; দেশ ও মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন লেখালেখির মধ্য দিয়ে। সেটি হোক সাংবাদিকতা, হোক অন্য কোনো সৃষ্টিশীল লেখা।

তবে আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতা ছেড়ে খুব বেশিদিন থাকতে পারেননি। বছর দশেকের মধ্যেই ফিরে আসেন। যেহেতু তাঁর কাছে সাংবাদিকতা ছিল অ্যাক্টিভিজমের পার্ট, ফলে ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে 'নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি'র উদ্যোগে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে 'দৈনিক কৃষক' প্রকাশিত হলে তিনি এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৪১ সালে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক 'দৈনিক নবযুগ' পত্রিকা বের করেন এবং সম্পাদকের দায়িত্ব দেন আবুল মনসুর আহমদের ওপর। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ এ-দায়িত্ব নিতে রাজী হলেন না। অবশেষে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় কিন্তু সব কাজ করতেন আবুল মনসুর আহমদ। অর্থাৎ আবুল মনসুর আহমদ এবং তাঁর সমসাময়িক কবি কাজী নজরুল একই পত্রিকায় কাজ করলেও নজরুল ইস্যুতে পত্রিকার চাকরি হারান তাঁরই সমসাময়িক কবি জীবনানন্দ দাশ। সেটি ১৯৪৭ সাল এবং নজরুল তখন অসুস্থ, বাকশক্তিহীন। অর্থাৎ তার কবিতার সমালোচনায় নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের কারণে তাঁরই সমসাময়িক একজন কবি, একজন সাহিত্য সম্পাদক যে চাকরিটা হারালেন, সেটি নজরুল জানতে পারলেন না বা বুঝতে পারলেন না।

বস্তুত ১৯৪৭ সাল এই উপমহাদেশের একটি টার্নিং পয়েন্ট। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র ভাগ হয়ে গেলে মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান তথা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অংশ। তখন এই বাংলার অনেক হিন্দুকে জীবন-জীবিকার সংকটে এবং নির্যাতনের মুখে চেলে যেতে হয় ভারতে। একইভাবে ভারত থেকে অসংখ্য মুসলমানকে চলে আসতে হয় এই বাংলায়। ওই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার কালে এই বাংলা থেকে যেসব বিশিষ্টজন স্থায়ীভাবে কলকাতা তথা ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ—যিনি তখন জন্মস্থান বরিশাল শহরের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করতেন। কলকাতায় গিয়ে বেকার। সাময়িক সময়ের জন্য তিনি 'স্বরাজ' নামে একটি পত্রিকায় রবিবাসরীয় (সাহিত্য বিভাগ) সম্পাদক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকায় কাজ করেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখলে 'স্বরাজ' পত্রিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর যে বিরোধ সৃষ্টি হয়, তার ফল হিসেবে তিনি চাকরিটা ছেড়ে দেন অথবা যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাতে তিনি আর সেখানে চাকরি করতে পারতেন না কিংবা সেখানে চাকরি করাটাকে তিনি সম্মানজনক মনে করেননি।

প্রকাশ না হওয়া ওই প্রবন্ধে জীবনানন্দ লিখেছিলেন: 'নজরুল ইসলামের কবিতায় মহাকাব্যিক গভীর প্রসাদ নেই, তার প্রতিশ্রুতিও কম। কিন্তু কোনো এক যুগে কজনের কবিতায়ই বা তা থাকে?' জীবনানন্দ মনে করেন, কাব্যের সুর কি এক আশ্চর্য বৈদেহী পবিত্রতায় নিজের ধ্রুবলোকে পৌঁছেছে; এরকম দাবি নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে করা যায় না। জীবনানন্দ উল্লেখ করেন, 'কাজীর কবিতা বিশেষ একটা মাত্রার দেশে তার অতীতের ভিতরে পরিসমাপ্ত।

আজও তা পড়বার জিনিস হয়তো আবৃত্তির জিনিস; পড়া শেষ করে সময় কেটে  গেলে মানস কর্ণ তৃপ্ত হতে চায় না মন বিষয়ান্তর খোঁজে দিকনির্ণনীয় মহৎ কবিদের।' কিন্তু প্রবন্ধটি ছাপা হওয়ার আগে সম্পাদকের টেবিলে যেতেই তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। কেননা কাজী নজরুলের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। ফলেতার সমালোচনামূলক এই লেখাটি ছাপার ঝুঁকি নিতে চায়নি কর্তৃপক্ষ। পত্রিকার অন্যতম স্বত্বাধিকারী রমেশ বসু তাঁকে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেন এই বলে যে, 'জার্নালিজম তো জানেন না আপনি। কিছু জানেন না শোনেন না। আমার কথার ওপর কথা বলবেন না। এটা সাহিত্য না, প্রফেসরি না।'

এই বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সনের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা প্রকাশিত হলে আবুল মনসুর আহমদ পত্রিকাটির সম্পাদক হন। এ সময় তিনি আলীপুর জজকোর্টের ওকালতি ছেড়ে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে দৈনিক ইত্তেহাদে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ১৯৪৭ সালে এক হাজার টাকা খুবই উচ্চ বেতন।

প্রসঙ্গত, জীবনানন্দ দাশ আরও ছয় বছর বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে যখন কলকাতার হাওড়া গার্লস কলেজে যোগ দেন এবং যখন তিনি ইংরেজি বিভাগের প্রধান, তখনও তার বেতন সর্বসাকুল্যে দেড়শো টাকা। এর সাথে দৈনিক ভাতা (ডিএ) ৫০ টাকা এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আরও ৫০ টাকা। সর্বমোট আড়াইশো টাকা। এক বছর পরে বেতন ২০ টাকা বাড়লে মোট মাইনে দাঁড়ায় ২৭০ টাকা।

জীবনানন্দ দাশ ও আবুল মনসুর আহমদের মিল-অমিলের জায়গাটা হলো, আবুল মনসুর আহমদ একজন হার্ডকোর সাংবাদিক এবং একইসঙ্গে সাহিত্যিক। পক্ষান্তরে জীবনানন্দ দাশ পত্রিকায় কিছুদিন চাকরি করলেও সেটি হার্ডকোর সাংবাদিকতা নয়। বরং সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক। কিন্তু দুজনের মধ্যে মিলের জায়গাটি হলো প্রতিবাদের ধরন। জীবনানন্দ দাশ তার সমসাময়িক কবি কাজী নজরুলের কবিতা সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেটি তার যুক্তিতে সঠিক। কিন্তু এ নিয়ে সম্পাদকের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হলে তিনি আপোষ করে সেখানে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু সব সময় কথা কম বলা, ভিড় এড়িয়ে চলা এবং পারতপক্ষে কারো সঙ্গে ঝগড়ায় না যাওয়া জীবনানন্দ সেই আপোষ না করে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন।

তাদের মধ্যে মিল-অমিলের আরেকটি জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারত থেকে অসংখ্য মুসলমান বাংলাদেশে চলে এলেও কিংবা বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতায় গিয়েছিলেন তারা জন্মভূমিতে ফিরতে শুরু করলেও আবুল মনসুর আহমদ কলকাতায় থেকে যান। অর্থাৎ হিন্দুরা পূর্ব-বাংলা ত্যাগ করে পশ্চিম-বাংলায় এবং মুসলমানরা পশ্চিম-বাংলা ত্যাগ করে পূর্ব-বাংলায় যাওয়া শুরু করলেও উভয় বাংলায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়, তা প্রতিরোধে তিনি পশ্চিম-বাংলার রাষ্ট্রনেতা-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেন। শুধু তাই নয়, দেশভাগের পরপরই বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে যে আন্দোলন শুরু হয়, ইত্তেহাদ পত্রিকার মাধ্যমে সেই আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আবুল মনসুর আহমদ। অবশ্য এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে ইত্তেহাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। ধীরে ধীরে ১৯৫০ এর প্রথম দিকে ইত্তেহাদের অপমৃত্যু ঘটে এবং আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। এভাবেই অবসান হয় তাঁর পঁচিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের।

এই সময়ের মধ্যে তিনি কাজ করেছেন সাপ্তাহিক মুসলিম জগত, সাপ্তাহিক ছোলতান (১৯০২, ১৯২৩), সাপ্তাহিক মোহাম্মদী (মাসিক-১৯০৩, সাপ্তাহিক-১৯০৮), সাপ্তাহিক দি মুসলমান (১৯০৬), সাপ্তাহিক খাদেম (১৯২৯), দৈনিক নবযুগ (১৯৪১), দৈনিক কৃষক (১৯৩৮) পত্রিকায়। আর দৈনিক ইত্তেহাদ (১৯৪৭) পত্রিকায় ছিলেন প্রধান সম্পাদক।

আবুল মনসুর আহমদ কেন বাংলা ভাষার সাংবাদিকতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র? তার ভাষা ও বলার ভঙ্গি, তার সাহস তথা বিরুদ্ধ সময়ের যাত্রী হিসেবে যে নির্ভীক সাংবাদিকতার চর্চা করেছেন, সেটি সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। এখন সাংবাদিকতা যে ধরনের রাষ্ট্রীয় চাপ এবং সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আবুল মনসুর আহমদের সময়ের সাংবাদিকতাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছিল আরও কঠিন।

যেমন ওই সময়ে মুসলমান যুবকদের সাধারণত পত্রিকায় চাকরি হত না। আবুল মনসুর আহমদ বেছে বেছে মুসলমান যুবকদের পত্রিকায় চাকরি দিয়ে সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার হাতে সাংবাদিকতা শুরু করে পরবর্তীতে যারা খ্যাতিমান হয়েছে তাদের মধ্যে ইত্তেফাকের মালিক ও সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কাজী মোঃ ইদরিস, তালেব রহমান, খোন্দকার হামিদ, রশীদ করিম, কবি আহসান হাবিব, রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। অর্থাৎ এখানে আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতাকে নিজের কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষায় কাজে লাগিয়েছেন।

সাংবাদিকতা ও সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার পরেও তার লেখালেখি থেমে থাকেনি। বরং তিনি যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ এমনকি সাহিত্য রচনা করেছেন, সেখানে তার রাজনীতি স্পষ্ট। অর্থাৎ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে আবুল মনসুর আহমদের ভূমিকা ছিলো কখনও সক্রিয় কর্মীর, কখনও নেতার, কখনও পরামর্শদাতার এবং সেদিক থেকে তার সব লেখাই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও মতাদর্শের একটা অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। তিনি সাংবাদিকতার ভাষা ও বলার যে ভঙ্গি তৈরি করেছিলেন, সেটিও ছিল নতুন, হৃদয়গ্রাহী এবং একইসঙ্গে সাহসী। যে সাহস হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ।     

সাংবাদিক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ আরও যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, তিনি শুধু সম্পাদকীয় লিখতেন না, বরং সংবাদ ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদনা, শিরোনাম লেখা, সংবাদের ট্রিটমেন্ট ও মেকআপও নিবিড়ভাবে দেখতেন। তিনি কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানদের সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন। এ সময় তিনি লক্ষ্য করেন সাংবাদিকতায় জ্যেষ্ঠরা অনুজদের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পছন্দ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, 'জুনিয়র স্তরের এ খাটুনি তার জীবনে খুব কাজে লেগেছিল'।

ব্রিটিশদের শাসনাধীন থাকায় এ সময় সংবাদপত্র সম্পাদনার ক্ষেত্রে মানহানি বা রাষ্ট্রদ্রোহ এড়াতে সম্পাদনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সর্তকতা অবলম্বন করতে হতো। তিনি লেখেন, 'প্রুফরিডিং কেবল টেকনিক্যাল জ্ঞানের বিষয় নয়, এটা একটা বিশেষ আর্ট, জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা ও নিপুণতা যে এ কাজে অধিক আবশ্যক।'

আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতায় পেশাগত দক্ষতার জন্য কখনো প্রশ্নের মুখে পড়েননি। বরং অনেক সময় কর্তৃপক্ষ এবং সহকর্মীদের কূটকৌশলের শিকার হয়েছেন। সাংবাদকিতায় নৈতিকতা বজায় রাখার ব্যাপারে তিনি কখনও পিছপা হননি। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। এই পেশার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। তিনি পেশাগত উৎকর্ষের ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন।

মোদ্দাকথা হলো, আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা ছিল দেশ ও মানুষকেন্দ্রীক। তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন, রাজনীতি করতেন। রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ত্রিমুখী ধারা তার রক্তে ছিল বহমান। কিন্তু সেই রাজনীতি করতে গিয়ে সাংবাদিকতার মতো একটি মহৎ পেশাকে তিনি কলুষিত করেননি। প্রশ্নবিদ্ধ করেননি। নীতি ও আদর্শের প্রতি অটল থেকে; দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে; বিরুদ্ধ সময়ে ক্ষমতাবানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভিন্ন আঙ্গিকে সত্য কথাটি বলে দেয়ার যে কৌশল—সেটি অন্য যে কারোর সঙ্গে আবুল মনসুর আহমদকে আলাদা করে দেয়। এমনকি তাঁর দুই সমসাময়িক খ্যাতিমান কবি ও সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশের স্টাইলের সঙ্গে তুলনা করলেও আবুল মনসুর আহমদের এই বলার ঢং ও ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা।

Comments