পরিপূর্ণ গণতন্ত্র চাইবো, সঙ্গে মানবিকতা
পৃথিবী যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। দুর্ঘটনাও নয়। অনিবার্যভাবেই তা ঘটে চলেছে। সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের ভেতর বিভাজনটা অতিপুরাতন। একালে বিভাজনটা সর্বগ্রাসী ও সর্বত্রবিস্তারী হয়েছে, এই যা। ভাগটা ওপরের ও নীচের। ওপরে রয়েছে সুবিধাভোগী অল্পকিছু মানুষ, নীচে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ, যারা শ্রম করে এবং যাদের শ্রমের ফল অপহরণ করেই ওপরের মানুষগুলো তরতাজা হয়। লেখক জনাথন সুইফট তাঁর গালিভার্স ট্রাভেলস বইতে আজব কয়েকটি দেশের কল্পকাহিনী লিখেছিলেন। দেশগুলোর একটিতে শাসকরা থাকে উড়ন্ত এক দ্বীপে, নীচে বিস্তীর্ণ এক মহাদেশ, সেখানে বসবাস প্রজাদের।
প্রজারা মেহনত করে, তাদের উৎপাদিত খাদ্য যন্ত্রের সাহায্যে তুলে নেওয়া হয় উড়ন্ত দ্বীপে; সুযোগসুবিধাভোগী রাজা, তাঁর মন্ত্রী ও পারিষদদের ভোগের জন্য। প্রজাদের বিস্তর অভিযোগ আছে। সেগুলো শোনার ব্যবস্থাও রয়েছে। উড়ন্ত দ্বীপটি যখন যেখানে যায় সেখানকার মানুষদের সুবিধার জন্য ওপর থেকে সুতো ঝুলিয়ে দেয়া হয়। প্রজারা তাতে ইচ্ছা করলে মনের সুখে নিজেদের অভিযোগগুলো কাগজে লিখে সুতোতে বেঁধে দিতে পারে। কিন্তু সেই কাগজ কেউ কখনো পড়ে বলে জানা যায় নি। তবে প্রজারা যদি ভুল করে কোথাও বিদ্রোহ করে বসে তবে তার জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা সে রাজত্বে রয়েছে। উড়ন্ত দ্বীপটি বিদ্রোহীদের এলাকায় উপরে এসে উপস্থিত হয়; ফলে সূর্যের কিরণ ও বৃষ্টিপাত, দুটো থেকেই নীচের বিদ্রোহীরা বঞ্চিত হয়ে অচিরেই নাকে খত দেয়। বিদ্রোহ দমনের আরেকটি পদ্ধতি উড়ন্ত দ্বীপ থেকে বড় বড় পাথর নীচের মানুষদেরকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা।
নীচের মানুষদের ওপর ওপরওয়ালাদের এই শাসন-শোষণের ছবিটি আঁকা হয়েছিল বেশ আগে, ১৭২৬ সালে। এর প্রায় দু'শ' বছর পরে ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নাটক লিখেছিলেন মুক্তধারা নামে। সেটাও ওই ওপর-নীচ সম্পর্ক নিয়েই। ওপরে থাকেন উত্তরকূটের রাজা-মহারাজারা, নীচে বসবাস শিবতরাইয়ের প্রজাদের। প্রজারা নিয়মিত খাজনা দেয়। তবে পরপর দু'বছর দুর্ভিক্ষ হওয়ায় খাজনা ঠিকমতো শোধ করতে পারেনি। শাস্তি হিসেবে ওপর থেকে নীচে বহমান, উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত নদীর পানি আটকে দেওয়া হয়েছে। নদীর ওপরে মস্ত এক বাঁধ কিছুকাল আগেই তৈরি করা হচ্ছিল, এখন তাকে কাজে লাগানো হলো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলেন, নদীর পানি যে মনুষ্যই নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে সেটা আগেভাগেই দেখতে পেয়েছিলেন। তবে এটা ভাবা নিশ্চয় তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয় নি যে ওপরওয়ালাদের হস্তক্ষেপে তার প্রাণপ্রিয় পদ্মানদীটি তাঁর-দেখা 'ছোট নদী'টিতে নিয়মিত পরিণত হতে থাকবে।
কিন্তু উপায় কি? যেমন চলছে তেমনভাবে তো চলতে পারে না। উপরের সুবিধাপ্রাপ্তদের সঙ্গে নীচের বঞ্চিতদের অপরিহার্য ও অনিবার্য দ্বন্দ্বের মীমাংসাটা কি ভাবে ঘটবে? আপোষে? আপোষের সম্ভাবনা তো কল্পনা করাও অসম্ভব। হ্যাঁ, মীমাংসা হবে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়েই। ওপরওয়ালারা যদি জিতে যায় অবস্থাটা তাহলে অকল্পনীয় রূপেই ভয়াবহ দাঁড়াবে। হাজার হাজার বছরের সাধনায় মানুষ যে অত্যাশ্চর্য সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার বিলুপ্তি তো ঘটবেই, মানুষের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে কি না সেটাই হয়ে পড়বে প্রাথমিক প্রশ্ন। ভাঙতে হবে তাই ওপর-নীচের ব্যবধান। ওপর শুধু সুখ ভোগ করবে, আর নীচ পোহাবে দুর্ভোগ সেটা চলবে না। ভাঙার এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা ওপরের সুবিধাভোগীরা করবে না, এটা করতে হবে নীচের মানুষদেরকেই। বিরোধটা মোটেই সামান্য নয়; অতিপুরাতন, চলমান ও ক্রমবর্ধমান একটি দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে বঞ্চিত মানুষের জেতার সম্ভাবনা না দেখা দিলে অচিরেই ঘোর অরাজকতা দেখা দেবে। সেটা সামলাবে এমন সাধ্য কারোরই থাকবে না।
জেতার জন্য আন্দোলন চাই। আন্দোলনের জন্য সংগঠন দরকার। প্রস্তুতিও চাই। লড়াইটা পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক, কিন্তু তাতে জেতার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। মিয়ানমারের মানুষ যে এতকাল ধরে সেনাশাসনকে মেনে নিয়ে চুপ করে ছিল, রোহিঙ্গাদের উৎখাতে তারা যে ধরে নিয়েছিল তাদের উপকার হচ্ছে, তাদের সেই সঙ্কীর্ণ বর্ণবাদী মনোভাবের পেছনে অবশ্যই কার্যকর ছিল সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা। তাদের সাংস্কৃতিক চেতনাটাকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। নয় বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে যে আরব বসন্তে'র প্রবল হাওয়া দোলা দিয়েছিল সেটা তো ছিল একটা জনঅভ্যুত্থান, তাতে তো মনে হচ্ছিল একটা সামাজিক বিপ্লব না-ঘটিয়ে ওই অভ্যুত্থানের সমাপ্তি ঘটবে না। সামাজিক বিপ্লব কিন্তু ঘটে নি। মিসরের কথাটাই ধরা যাক। সেখানে উত্তাল আন্দোলনটা ছিল খুবই দুরন্ত। স্বৈরশাসক হোসনী মোবারক নিশ্চিন্তই ছিলেন যে তাঁর শাসনই চলবে।
আন্দোলনের তোড়ে তিনি ভেসে গেলেন। কিন্তু তারপরে কারা এলো? এলো মুসলিম ব্রাদারহুড; যারা ধর্মরাজ্য কায়েমে বিশ্বাসী। পরিবর্তন ঘটেছে ভেবে তাৎক্ষণিক ভাবে মানুষের অসন্তোষটা কমেছিল; কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের সাধ্য কী মানুষের মুক্তি দেয়? ব্রাদারহুড ব্যর্থ হলো। আর ব্যর্থতার সেই সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নিল সেনাবাহিনী, যাদের সাহায্যে হোসনী মোবারক এক সময়ে মানুষকে পীড়ন করতেন। 'আরব বসন্ত' ব্যর্থ হবার পেছনে একটা বড় কারণ সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির অভাব। আন্দোলন ছিল মূলত তরুণদের। তারা বিদ্রোহ করেছে; কিন্তু তাদের কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। লক্ষ্য ছিল না সামাজিক বিপ্লব পর্যন্ত এগুবার। আমেরিকাতে কট্টরপন্থী রিপাবলিকানরাও সাংস্কৃতিক ভাবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। সে দেশে এখন শত ভাগ সাক্ষরতা বিদ্যমান; কিন্তু গড়পড়তা আমেরিকান তাদের দেশের বাইরে কোথায় কোন দেশ আছে সে-বিষয়ে অতিঅকিঞ্চিতকর পরিমাণ জ্ঞান রাখে। এক জরিপ বলছে ২০২০ সালে ২৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান একটিও বই পড়ে নি। (দৈনিক প্রথম আলো, ২৬.০২.২১)।
রাষ্ট্রব্যবস্থাই আমেরিকানদের সাংস্কৃতিক চেতনাকে দমিয়ে রেখেছে। অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি জগৎবিখ্যাত বিল গেটস। কথা বলেন, চিন্তা করেন। যাই বলেন সেটা প্রচার পায় ও প্রভাব ফেলে। ক'দিন আগে তিনি জানিয়েছেন যে করোনা মোকাবিলার তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা অনেক কঠিন কাজ। তবে বলেন নি যে দু'টোই একটি অভিন্ন রোগের দু'টি ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। আর বলেন নি যে রোগটির নাম হলো পুঁজিবাদ। সেটা বললে বিশ্ববাসীর সাংস্কৃতিক উন্নতিতে সাহায্য করা হতো। সাংস্কৃতিক উন্নতিটা আজ বিশ্বব্যাপী জরুরী। ওই উন্নতি দাতব্যে ঘটে না, জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে।
বোঝাই যাচ্ছে সংশোধনে কুলাবে না। প্রয়োজন হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে ফেলবার জন্য সামাজিক বিপ্লবের। গত শতাব্দীতে কয়েকটি দেশে সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজ টিকে থাকতে পারে নি, বড় কারণ পেছনকার সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিটা পরিপূর্ণ ছিল না। পরিবর্তিত বিশ্বে সামাজিক বিপ্লব কোনো একদেশে ঘটবে না, ঘটবে সারা বিশ্বে। প্রত্যেকটি দেশেই মীমাংসা ঘটা চাই ওপর ও নীচের ভেতরকার শ্রেণী-সম্পর্কের। সেটা ঘটাতে হবে প্রতিটি দেশকে তার নিজের মতো করেই, তবে আবার বিশ্বজনীন-ভাবে ও পদ্ধতিতে। বিশ্বজনীন না হলে পরিবর্তন স্থায়ী হবে না।
আমরা পরিপূর্ণ গণতন্ত্র চাইবো। কিন্তু সে গণতন্ত্র পুরোপুরি মানবিক হওয়া চাই। সুইডেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা প্রায় আদর্শস্থানীয় বলে বিখ্যাত। বসবাসের জন্য ওই রাষ্ট্রটি নাকি অতুলনীয়। কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দেখা গেল আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় সুইডেনে মানুষ মারা গেছে অনেক বেশী। প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডে ছয় শ'; নরওয়েতেও তাই; ডেনমার্কে এক হাজার; কিন্তু সুইডেনে মৃত্যু ঘটেছে বারো হাজার মানুষের। সুইডেনে বসবাসকারী এক বন্ধু লিখেছেন, রাষ্ট্র সেখানে গণতান্ত্রিক বটে, কিন্তু বড়ই নিঃস্পৃহ। তাঁর উপলব্ধি হচ্ছে এমন নিঃস্পৃহতায় কুলাবে না। তিনি যা লিখেছেন আমরাও সেটাই বলি। কেবল গণতান্ত্রিকতা নয়, মানবিকতাও অত্যাবশ্যক। আর মানবিকতা বস্তুগত অবস্থার ওপর নির্ভরশীল বটে।
বস্তুগত অবস্থাটা মানবিকতার পরিপোষক হবে তখনি যখন সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটবে। আর সে জন্যই কেবল মাত্র অভ্যুত্থান নয়, সামাজিক বিপ্লবই চাই। মুক্তি আসলে ততোটাই দূরে সমাজ বিপ্লব যতটা দূরবর্তী।
Comments