স্বাধীনতার পথে উত্তপ্ত ষাটের দশক

ইনার গ্রুপ, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট, অপূর্ব সংসদ ছাড়াও ষাটের দশকের শুরুতেই স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে প্রচারণার জন্য ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপনে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি বিশেষ গ্রুপ। যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। 
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে সাধারণ ধর্মঘটের মিছিলে নারীরা। ছবি: সংগৃহীত

(১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রহর প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নানা তৎপরতার শুরু হয়েছিল আরও কয়েক দশক আগে। দ্য ডেইলি স্টারের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রকাশিত দ্বিতীয় পর্বে থাকছে ১৯৬০'র দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি।)

ইনার গ্রুপ, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট, অপূর্ব সংসদ ছাড়াও ষাটের দশকের শুরুতেই স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পক্ষে প্রচারণার জন্য ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপনে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি বিশেষ গ্রুপ। যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। 

মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ লিখেছেন, '১৯৬২ সালে একদল সচেতন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিউক্লিয়াস গঠন করে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে এদের ভূমিকা ছিল অন্যান্য বিপ্লবী দল থেকে আলাদা ধরনের।'

মহিউদ্দিন আহমদের 'প্রতিনায়ক' ও মোরশেদ শফিউল হাসানের 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, 'নিউক্লিয়াসের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনজন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান, সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও ঢাকা মহানগর সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ।

সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

১৯৬২ সালে নিউক্লিয়াসের ভাবনা এলেও নিউক্লিয়াসের মূল কাঠামো তৈরি হয় ১৯৬৪ সালে। প্রথম দিকে নিউক্লিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করা। ছাত্রলীগের মধ্যে নিউক্লিয়াসের মতাদর্শ প্রচার করতেন কাজী আরেফ আহমেদ, সদস্য বাছাইয়ের দায়িত্ব ছিল আব্দুর রাজ্জাকের, নতুন সদস্যদের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিতেন সিরাজুল আলম খান। নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে একটি প্রচারপত্রও বের করা হয়েছিল। পরবর্তীতে একটি মুদ্রণযন্ত্র কিনে মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় এটি বসানো হয়। নিউক্লিয়াসের কাজে তাত্ত্বিকভাবে সহযোগিতা করেন কামরুদ্দিন আহমেদ। 

শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমতিক্রমে নিউক্লিয়াসের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো। নিউক্লিয়াস থেকেই প্রতিটি থানায় ১০ সদস্যের একটি করে গ্রুপ খোলা হয়েছিল। নিউক্লিয়াসের যারা সদস্য হতেন তাদের একটি করে প্রচারপত্র দেওয়া হতো, যেখানে নিউক্লিয়াসের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গেরিলা যুদ্ধের কৌশলসহ নানা বিষয় উল্লেখ থাকতো। 

১৯৬৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমান নিউক্লিয়াসের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকে জানানো হয় ইতোমধ্যে ২০০ থানায় নিউক্লিয়াসের কমিটি গঠিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভায় বক্তৃতা করছেন সিরাজুল আলম খান। ছবি: সংগৃহীত

নিউক্লিয়াসের কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'নিউক্লিয়াস অসম্ভব গোপন সংগঠন ছিল। নিউক্লিয়াসের বলয়ে আমি যখন এলাম তখন আমাকে বলা হলো, কারা নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিল, কারা নিউক্লিয়াসে কাজ করছে এসব কিছুই আমার জানার প্রয়োজন নেই। কেবল আমি যাদের নেবো তাদের বিষয়ে আমি জানবো।'

লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিউক্লিয়াস মূলত ছাত্রলীগের যে কমিটি ছিল সেই কমিটির মাধ্যমে তাদের তৎপরতা চালিয়েছিল। অন্য সংগঠনগুলো সম্পর্কে সেসময় কিছুটা জানা গেলেও আমরা নিউক্লিয়াস সম্পর্কে জানতে পারি ১৯৭২ সালে এসে।'

ছয় দফা দাবি উপস্থাপনের পর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে লাহোর থেকে ফিরছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুদ্ধে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধটিও নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ব পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনীতিবিদ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় হামলার নিন্দা ও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের এক জনসভায় শেখ মুজিব কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য জাতিসংঘের সমালোচনা করেন।

পাক-ভারত যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে হলেও যুদ্ধে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সেনারা। কিন্তু ১৭ দিনের যুদ্ধকালীন সময়ে চরম অরক্ষিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানে এসময়ে হামলা করতো তবে প্রতিরোধ করার মতো কোনো সামর্থ্যই পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এসময় পুরোপুরি অনুধাবন করে তারা কতোটা অবহেলিত, অরক্ষিত এবং নিগৃহীত।

আফসান চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানান, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে ভারতকে গালি দিয়েছে। ৬৫'র যুদ্ধের সময় অরক্ষিত বিষয়টি প্রচার পায়নি। কিন্তু ৬৬ সালে ছয় দফার সময় রাজনৈতিক প্রচারে ৬৫'র যুদ্ধে অরক্ষিত থাকার বিষয়টি বেশ প্রচার পেয়েছিল।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের পরবর্তীতে ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। ছবি: সংগৃহীত

৬ দফা দাবিতে উত্তপ্ত রাজপথ

স্বাধীনতার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সফলতম পদক্ষেপ ছিল ৬ দফা। ৬ দফা ছিল মূলত স্বাধীনতারই এক দফা। ছয় দফার মধ্যেই নিহিত ছিল স্বাধীনতার বীজ। 

প্রাবন্ধিক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসানের 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থের সূত্রমতে 'তাসখন্দ চুক্তি' স্বাক্ষর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে দুই দিনব্যাপী নিখিল পাকিস্তান জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয়। সম্মেলনটি হয় নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী নিয়ে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এসময় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানসহ বৈঠকে উপস্থিত কেউই এ নিয়ে আলোচনা করতে রাজি না হওয়ায় প্রতিবাদে চার সঙ্গীসহ বৈঠক বর্জন করেন শেখ মুজিব। ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফা দাবি জনসমক্ষে তুলে ধরেন শেখ মুজিব।

১. শাসনতন্ত্র কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতিতে ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ। ২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল থাকবে দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতিতে। অন্যান্য বিষয়ে প্রদেশের ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ। ৩. দুটি পৃথক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা। ৪. রাজস্ব কর ও শিল্প ব্যবস্থায় থাকবে প্রদেশের সার্বভৌম ক্ষমতা। ৫. বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা ও বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে নিজ নিজ প্রদেশের আওতাধীন। ৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা।

অলি আহাদ রচিত 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৬ সালের ১৯ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফাকে সাংগঠনিক কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ২০ মার্চ তা অনুমোদিত হয়। 

আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে জনতার মিছিল, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার

৬ দফা উত্থাপিত হওয়ার পরপরই এর মর্মবাণী সারাদেশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে দেশব্যাপী ঝটিকা সফরে বের হন শেখ মুজিব। এসময়ে সর্বমোট ৮ বার গ্রেপ্তারের শিকার হন তিনি। সে বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষে ফেরার পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে দেশরক্ষা আইনে আটক হন শেখ মুজিব। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৩ মে ঢাকার পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৭ জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ৭ জুন হরতালের দিনে কেবল নারায়ণগঞ্জেই পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হয়। সরকারি হিসেবে এদিন সারাদেশে ১০ জন নিহত হয়। 

৬ দফা প্রচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৫ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার ও ১৬ জুন ইত্তেফাকের মুদ্রণাগার দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে ইত্তেফাক প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। যদিও আদালতের রায়ে শেষ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়নি।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'পঞ্চাশের দশক আর ষাটের দশকের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রাম যাই বলি না কেন, স্বাধীনতার প্রথম ধাপ ছিল ৬ দফাই। ৬ দফার মাধ্যমেই আসলে স্বাধীনতার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলো।' 

গুলিবিদ্ধ আসাদকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

৬ দফার পরবর্তীতেই শেখ মুজিবসহ বাঙালি সামরিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে পাকিস্তান সরকার। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ৬ দফার বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকারের কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে আফসান চৌধুরী তার 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, '১৯৬৭ সালে ৬ দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজাচ্ছে।' 

১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি এক প্রেস নোটে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির যোগসাজশে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে ১৮ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার।

১৯৬৬ সালের ৮ মে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি মুক্তির আদেশ পেয়েছিলেন শেখ মুজিব। এদিন রাতেই কারাগার ফটকে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম ও প্রধান আসামি দেখিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়।

অলি আহাদের 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫' ও ডা. মাহফুজুর রহমানের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ' গ্রন্থ সূত্র অনুযায়ী  '২১ এপ্রিল আইয়ুব খান অর্ডিন্যান্স জারি করলে ক্যান্টনমেন্টেই বিশেষ আদালত বসিয়ে ১৯ জুন থেকে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়। বিচারের শুরুতেই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মিথ্যা মামলা বলে আন্দোলন শুরু করে। 

৬ দফা দাবির পক্ষে তখন এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষুব্ধ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যেন আগুনে ঘি ঢালে। আফসান চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে নানা বৈষম্যের কারণে বাঙালি অফিসার ও সেনারা নানাভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারাই মূলত সংগঠিত হয়ে দেশ স্বাধীনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। শেখ সাহেবের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও তিনি এই বিষয়টি জানতেন। যখন এই তথ্য প্রকাশ পায় তখন দেড় হাজার বাঙালিকে আটক করেছিল ওরা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টি এসেছিল সেই ধারা থেকেই। মূলত ৬ দফার প্রেক্ষিতেই শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে মামলাটি রাখার একটি সুযোগ পেল সামরিক সরকার।'  

১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় 'পুলিশের গুলীতে ছাত্র নিহত' শিরোনামে আসাদের মৃত্যুর খবর। ছবি: সংগৃহীত

অলি আহাদের 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫' গ্রন্থ সূত্রে, ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে জনসভা শেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি মিছিল গভর্নর হাউসের উদ্দেশ্যে গমন করলে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে।

অন্যদিকে, ৭ ও ৮ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী বৈঠকে ৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জমিয়ত-উল-উলামা ইসলামী, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, নেজামে ইসলামী পার্টি, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (ড্যাক)।

১৭ জানুয়ারিতে দেশব্যাপী দাবি দিবস পালন করার আহ্বান জানায় ড্যাক। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে মোনায়েম প্রশাসন যেকোনো মিছিল ও শোভাযাত্রায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অনুষ্ঠানের পর ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে মিছিল বের করলে ইপিআর ও পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। মিছিলে নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৮ জানুয়ারি থেকেই মূলত গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ে।

২০ জানুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে সেন্ট্রাল ল কলেজের ছাত্র আসাদ শহীদ হলে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শহীদ আসাদের রক্তভেজা শার্ট নিয়ে মিছিল বের হয়। মুহূর্তেই মিছিলের শহরে পরিণত হয় ঢাকা। বেপরোয়া পরিস্থিতিতে ২৪ জানুয়ারি রাত ৮টায় ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে প্রশাসন। ২৫ জানুয়ারি কারফিউ অমান্য করা মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবদুল লতিফ ও আনোয়ারা বেগম।  

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মিছিলের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই স্লোগানগুলো ছিল 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা', 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি'। এই স্লোগানগুলো উদ্ভাবন, প্রচলন ও জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের ছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকা। 

১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক শহীদ হলে পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ উপেক্ষা করেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। ১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও আন্দোলনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বেয়নেটের আঘাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হলে আন্দোলনের সীমা চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায়।

অলি আহাদের 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, একপর্যায়ে আন্দোলনের তীব্রতায় ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমান ও বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সামরিক প্রশাসন। 

২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে রেসকোর্স ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়। প্রায় দশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। সমাবেশে তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান করেন।

মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে সব দলই অংশ নিয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের ফসলটি গেছে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের ঝুলিতে। এর একমাত্র কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর আপসহীনতা।'  

 

Comments

The Daily Star  | English

Informal Sector Workers: Their rights glossed over, always

Of the over 7 crore people employed in Bangladesh, 85 percent (nearly 6 crore) are vulnerable as they work in the informal sector, which lacks basic social and legal protection, and employment benefits.

1h ago