জগন্নাথ হল গণহত্যায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন যিনি

‘এরপর ইদু মিয়াই আমাগোরে মাঠ থেকে বের কইরা বকশীবাজার নিয়া গেল। খালি আমরা না, ওই রাইতে ইদু মিয়ার লাইগাই বহু লোক বাঁচার পারছে।’
জগন্নাথ হল গণহত্যা
জগন্নাথ হলের গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

'রাইতে গুলির শব্দে ঘুম ভাইঙে গেল। আমার বাপরে লাশ টানার কথা কইয়া মিলিটারি ধইরা নিয়া গেল। অবস্থা দেইখা মা লগে লগে বেহুঁশ হইয়া গেল। খানিক বাদেই গুলির শব্দ শুইনা বাইর হইয়া দেখি হলের মাঠে কিছু মানুষ পইড়া আছে, আর কিছু মানুষ খাড়ানো। এরপর মিলিটারি আবার যখন গুলি করল, খাড়ানো সবটি কলাগাছের লাহান পইড়া গেল। এর বাদে মিলিটারি কই যেন গেল। আমি দৌড়াইয়া গেলাম। দেখি মাঠের মধ্যে আমার বাপ পইড়া আছে। কইল মা জল দে। জল আগাইয়া দেওয়ার লগে লগে শেষ। একদিকে বাপ মরা, আরেকদিকে মা বেহুঁশ। এমন সময় কোন দিক থেইকা ইদু মিয়া আইয়া কইল 'মিলিটারি আবার আসপো। তরা জলদি পালা।'

২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সংগঠিত গণহত্যায় বাবা শহীদ দাসু রাম রায়কে হারানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে গিরিজা রাণী রায়ের চোখ ছলছল করে উঠে। একইসঙ্গে জনৈক ইদু মিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে তার দৃষ্টি।

গিরিজা রাণী ফের বলেন, 'এরপর ইদু মিয়াই আমাগোরে মাঠ থেকে বের কইরা বকশীবাজার নিয়া গেল। খালি আমরা না, ওই রাইতে ইদু মিয়ার লাইগাই বহু লোক বাঁচার পারছে।'

শহীদ দাসু রাম রায়ের মেয়ে গিরিজা রাণী রায়। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যায় জগন্নাথ হল পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সেই মৃত্যুপুরীর মাঝে জগন্নাথ হলে অবস্থানরত কয়েকজন ছাত্র, কর্মচারীই শুধু প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন। আর যার সহায়তায় তারা বাঁচতে পেরেছিলেন তিনি একজন বই বিক্রেতা। নাম তার ইদু মিয়া। নৃশংস সেই রাতে ইদু মিয়া অবতীর্ণ হয়েছিলেন ত্রাণকর্তার ভূমিকায়।

ইদু মিয়া কে 

জগন্নাথ হলের প্রবীণ কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) মসজিদ সংলগ্ন ছিল বই বিক্রেতা ইদু মিয়ার দোকান। বর্তমানে সেই দোকানটি আর নেই। বছর কয়েক আগে মারা গেছেন ইদু মিয়া। কিন্তু ২৫ মার্চ কালরাতে ইদু মিয়ার অবিশ্বাস্য কীর্তি তাকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী, জগন্নাথ হলের কর্মচারী ও প্রাক্তন ছাত্রদের মাঝে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তী সম্পাদিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা: ১৯৭১ (জগন্নাথ হল)' বইয়ে পাওয়া যায় ইদু মিয়ার সেই রাতের অসীম মানবিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয়। একইসঙ্গে জগন্নাথ হল গণহত্যার বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছেও শোনা যায় তার মানবিকতার কাহিনী।

রতনলাল চক্রবর্তীকে দেওয়া ইদু মিয়ার ভাষ্যে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাত ৮টার সময় তাস খেলতে গিয়ে ইদু মিয়া জানতে পারেন আজ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালাতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা বইতে প্রকাশিত ইদু মিয়ার বীরত্ব। ছবি: সংগৃহীত

এদিন রাত ১১টায় পাকিস্তানি সেনারা জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকের দেয়াল ভেঙে গুলি করতে করতে মাঠে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে হানাদারদের তাণ্ডবে জগন্নাথ হল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। এক পর্যায়ে সেনারা পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যসহ একাধিক শিক্ষার্থীকে মাঠে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। বুয়েট মসজিদ থেকে পুরো দৃশ্যই দেখছিলেন ইদু মিয়া।

প্রথমে সেনারা জগন্নাথ হলের কর্মচারীদের দিয়ে মরদেহ টানালেও, কাজ শেষে তাদেরকেও লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এরপর সেনারা কিছুক্ষণের জন্য চলে গেলে দ্রুতই মসজিদ থেকে বেরিয়ে হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে পড়েন ইদু মিয়া। তিনি কর্মচারীদের বলেন, 'তোমরা তাড়াতাড়ি তোমাদের সব টাকাপয়সা ও গয়নাগাটি নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।'

রতনলাল চক্রবর্তীর বই সূত্রে শহীদ স্বজন ও ইদু মিয়ার বর্ণনায় আরও পাওয়া যায়, ইদু মিয়া জগন্নাথ হল মাঠে ঢোকেন। মাঠে পড়ে থাকা লাশের স্তুপ থেকে কালি নামের এক শিক্ষার্থী ইদু মিয়াকে দেখে বলেন, 'আমাকে নিয়ে যান। আমার শরীরে গুলি লাগেনি। ওরা যখন আমাদের উপর গুলি চালাল তখন আমি মৃতের ভান করে পড়েছিলাম।'

ইদু মিয়া তৎক্ষণাৎ তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। চারদিকে তখন মরদেহ আর মরদেহ। সেখানে ইদু মিয়া কর্মচারী চানদেবকে আবিষ্কার করেন। তিনি তাকে কোলে করে ঠিকাদারদের মালপত্র রাখার গোডাউনে রেখে আবার মাঠে ফিরে আসেন। ইদু মিয়ার তখন একটাই লক্ষ্য। যে করেই হোক আহত বা জীবিত মানুষদের উদ্ধার করে তাদের বাঁচাতে হবে।

উদ্ধারের এক পর্যায়ে ইদু মিয়া আবিষ্কার করেন একটি পরিবারের সব সদস্যই গুলিবিদ্ধ। সেই পরিবারের সদস্যদের বকশীবাজার পৌঁছিয়ে ফের জগন্নাথ হলে ফিরতে গেলে সঙ্গীরা তাকে নিষেধ করেন। কিন্তু ফের জগন্নাথ হলে ফিরে আসেন ইদু মিয়া। এসেই দেখতে পান হলের পুকুরের স্বল্প পানিতে চানদেব ও হরিধন দাসের মাথা ভেসে আছে। তাদের উদ্ধার করে মেডিকেলে পাঠান ইদু মিয়া।

'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল' বইয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ও ইদু মিয়ার দেওয়া ভাষ্যে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে এক মুহূর্তের জন্যও দম ফেলার সময় পাননি ইদু মিয়া। শেষরাতে ইদু মিয়াকে অ্যাসেম্বলির ভেতর দেখতে পান হলের শিক্ষার্থী যশোদা জীবন সাহা। 

যশোদা জীবন সাহা বলেন, 'আমি ইদু মিয়াকে বললাম, আমি ও আমার ভাই এখানে আটকা পড়েছি। আমাদের নিয়ে চলুন। তখন তিনি আমাদের উদ্ধার করে বুয়েট মসজিদে নিয়ে গেলেন।'

ফিরে এসে ইদু মিয়া দেখলেন হলের মাঠে ও ভবনের পাশে অগণিত মরদেহ পড়ে আছে। শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও শিক্ষকের বাইরে তাদের বেশিরভাগই বস্তিবাসী। 

শেষরাতের দিকে ফ্যাকাল্টি কোয়ার্টারের ৩৪ নাম্বার বাড়িতে যান ইদু মিয়া। এই ভবনটিতে থাকতেন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনিসুর রহমান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের পরিবার। এ সময় অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের পরিবারকে কোয়ার্টার থেকে বাইরে নিয়ে এলেন ইদু মিয়া।

রতনলাল চক্রবর্তী তার বইয়ে লিখেছেন, 'জগন্নাথ হলের মাঠে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও বস্তিবাসীকে হত্যার পর হানাদাররা যখন মরদেহ চাপা দেওয়ার জন্য বুলডোজার জোগাড় করতে গেল তখন ইদু মিয়া হলে, পুকুর পাড়ে ও মাঠে মৃতের ভান করে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলে বেঁচে গিয়েছিল চানদেব, মতি, কালী, হরিধন দাস, যশোদা জীবন সাহা, ধীরেন বাবুসহ বহু মানুষের প্রাণ।'

একই সূত্রে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। পরে ২৭ মার্চ আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়।

খবর শুনে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে গিয়েছিলেন ইদু মিয়া।

ইদু মিয়াকে দেখে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা বলেছিলেন, 'তুমি হয়তো মনে করেছ আমি ভালো আছি। কিন্তু আমি বাঁচব না। আমি মেডিকেলে শুনেছি, তুমি হলের অনেক শিক্ষার্থীকে প্রাণে বাঁচিয়েছ। আমি যদি থাকতাম তবে আমি সে কথা প্রকাশ করতে পারতাম।'

এর তিন দিন পর ৩০ মার্চ ঢাকা মেডিকেলে মারা যান জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। তার মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই ইদু মিয়া ছুটে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী বাসন্তী গুহ ঠাকুরতার কাছে। বাসন্তী গুহঠাকুরতা ইদু মিয়াকে দেখে বলেছিলেন, 'যদি পারেন আপনাকে তার মরদেহ যে করেই হোক এনে দিতে হবে। মিলিটারিরা যদি তার মরদেহ নিয়ে যায় আমি ভীষণ কষ্ট পাব।' ইদু মিয়া জবাবে বলেছিলেন, 'আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, স্যারের মরদেহ কোনোভাবেই মিলিটারিকে নিতে দেবো না।'

কিন্তু মেডিকেলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের নিয়ে বহু অনুসন্ধানের পরও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মরদেহ আর পাননি ইদু মিয়া। কারণ ততক্ষণে তার মরদেহ গুম করে ফেলেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

 

Comments

The Daily Star  | English
Pro-Awami League journalist couple arrested

The indiscriminate arrests and murder charges

Reckless and unsubstantiated use of murder charges will only make a farce of the law, not bring justice to those who deserve it.

13h ago