যেমন আছে মিরপুরের বধ্যভূমিগুলো

মিরপুর বাংলা কলেজ বধ্যভূমির স্মৃতিবহনকারী আমগাছ। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

(মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মিরপুর ছিল জলজ্যান্ত এক কসাইখানা। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির অনুসন্ধানে পাওয়া ঢাকার ৭৬টি বধ্যভূমির মধ্যে ২৭টিরই অবস্থান মিরপুরে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেও মুক্ত হয়নি মিরপুর। দেড় মাস অবরুদ্ধ থাকার পর মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মুক্ত হয়। মিরপুর মুক্ত হওয়ার ৫২তম বার্ষিকীতে এখানকার ৮টি বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করেছে দ্য ডেইলি স্টার। দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব থাকছে আজ।)

সরেজমিনে সারেংবাড়ি বধ্যভূমি, গোলারটেক বধ্যভূমি, রাইনখোলা বধ্যভূমি ও মিরপুর বাংলা কলেজ বধ্যভূমি।

মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের শাহ আলী মাজার। মাজারের পূর্ব-উত্তর কোণের গলি ধরে কিছুটা ডানে বামে এগুলেই রাস্তার বামে চোখে পড়বে মনির উদ্দিন শাহের মাজার। মনির উদ্দিন শাহ একসময় সারেং থাকায় তার নামেই এলাকাটির নাম সারেং বাড়ি।

সারেংবাড়ি বধ্যভূমির কুয়ার অবস্থান দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজন আবদুল মালেক। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা উত্তরকালে এই এলাকায় তীব্র পানি সংকটের জন্য মাজারের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে খনন করা হয়েছিল দুটি কুয়া। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই দুটি কুয়া ও মাজারের সুয়ারেজটি পরিণত হয়েছিল এক ভয়াল মৃত্যুকূপে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারেরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করে কুয়া ও সুয়ারেজ রিজার্ভারে চাপা দিতো।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে স্থানীয় বাসিন্দারা শহীদের লাশে পূর্ণ কুয়া দুটি আবিস্কার করেন। ১৯৯১-৯২ সালের দিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মাজার সংলগ্ন সুয়ারেজ ট্যাংকটি পরিষ্কার করতে গেলে বেরিয়ে আসে অজস্র মাথার খুলি, হাড়, গুলির খোসা, জুতাসহ দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসসেই সঙ্গে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের এক পৈশাচিক গণহত্যার বয়ান। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সারেং বাড়ি গণহত্যায় বাবাকে হারিয়েছিলেন স্থানীয় মুদি দোকানি আবদুল মালেক। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সারেং বাড়ি তখন নিচু এলাকা ছিল। যুদ্ধের সময় ভয়ে আমরা এলাকায় থাকতে পারিনি। আমার বাবার পরে আসার কথা ছিল কিন্তু তিনি আর আসতে পারেননি। এখানেই তাকে মেরে ফেলা হয়। যুদ্ধ শেষে আমরা যখন এলাকায় ফিরে এলাম তখন দেখি চারদিকে শুধু লাশের গন্ধ। মানুষের কঙ্কাল আর খুলিতে ভর্তি কুয়া।'

বাংলা কলেজ বধ্যভূমির এই স্থানেই ছিল দুটি কুয়া। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে কুয়া দুটি ছিল শহীদের লাশে পূর্ণ। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

সম্প্রতি ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক সরেজমিনে সারেংবাড়ির বধ্যভূমির অবস্থান ঘুরে দেখেন। বর্তমানে কুয়া দুটির অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। বছর কয়েক আগে একপাশে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। অন্যপাশে নতুন আরেকটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত সারেংবাড়ি বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মিরাজ মিজু রচিত 'মিরপুরের ১০ বধ্যভূমি' শীর্ষক গ্রন্থে 'গোলারটেক বধ্যভূমি' পরিচ্ছেদে বলা হয়, 'শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পশ্চিমে এখন যে মাঠটি 'গোলারটেক ঈদগাহ মাঠ' নামে পরিচিত তার দক্ষিণ দিকে একটি কুয়া ছিল। কুয়াটি পরিপূর্ণ ছিল শহীদের লাশে। এছাড়া দক্ষিণ পার্শ্বে আমগাছের পেছনের জায়গাটি ছিল ডোবা। ডোবাটি ভর্তি ছিল শহীদের লাশে।'

গোলারটেক বধ্যভূমির স্মৃতিবহনকারী আমগাছ। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

সম্প্রতি গোলারটেক মাঠের বর্তমান অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। গোলারটেক মাঠের কুয়াগুলো বিলীন হয়ে গেছে। একইসঙ্গে ভরাট হয়ে গেছে ডোবাটিও। তবে গোলারটেক বধ্যভূমির নৃশংসতার সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে আমগাছটি। আমগাছের পাশেই কয়েকটি লোহার ছোট পাইপ জানান দিচ্ছে পূর্বে থাকা কুয়ার অস্তিত্ব।

বর্তমানে গোলারটেক মাঠের একাংশ জুড়েই রাখা দারুস সালাম থানার বিভিন্ন মামলার নমুনা হিসেবে আটক হওয়া যানবাহন। যা চলে আসছে গত কয়েক বছর ধরেই।

মিরপুর দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের থানার জন্য এখনো পর্যন্ত স্থায়ী কোনো জায়গা বরাদ্দ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই মামলার প্রমাণ সাপেক্ষে গাড়িগুলো আপৎকালীন গোলারটেক মাঠে রাখতে হচ্ছে। মাঠের বধ্যভূমির বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি নির্বাচনের কয়েক দিন আগে এই থানায় যোগ দিয়েছি।'

মামলায় জব্দ যানবাহন রাখা হয়েছে গোলারটেক মাঠে। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়কের দিকে কিছুটা এগোলেই রাস্তার বাম পাশে পড়বে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিউনিটি সেন্টার। পাশের সরু গলি দিয়ে সামান্য এগুলেই দেখা মেলে ছোট একটি মাঠের। এটিই রাইনখোলা বধ্যভূমি।

সম্প্রতি রাইনখোলা বধ্যভূমির স্থানটিতে গিয়ে দেখা যায় ছোট মাঠটির মাঝখানে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে খেলছে। মাঠজুড়েই যত্রতত্র ময়লার স্তুপ। একপাশে পড়ে আছে রিকশা ভ্যান থেকে ঢালাইয়ের মেশিন। নিম্ন আয়ের মানুষেরা মাঠজুড়ে কাপড় শুকোতে দিয়েছেন। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি বধ্যভূমি।

দুই দশক আগে রাইনখোলা বধ্যভূমিতে স্থানীয় তরুণদের উদ্যোগে একটি দেয়ালে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হলেও বর্তমানে এটি বিস্মৃত।

রাইনখোলা বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা। ছবি: শেখ এনাম/ স্টার

'মিরপুরের ১০ বধ্যভূমি' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, 'মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাইনখোলা বধ্যভূমির স্থানটিতে একটি দোতলা সুয়ারেজ রিজার্ভার ও ট্যাংক হাউস ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ও গুলি করে হত্যা করে সুয়ারেজ রিজার্ভারে ফেলে দিতো। ১৯৭২ সালে মিরপুর ও হরিরামপুর ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা ফকির শফির উদ্দিন ও স্থানীয়রা রাইনখোলা বধ্যভূমিটি আবিস্কার করেন। তখন পুরো সুয়ারেজ রিজার্ভারটিই ছিল গলিত ও অর্ধগলিত লাশে পূর্ণ। পড়ে স্থানীয়রা একে রাইনখোলা বধ্যভূমি নামেই চিহ্নিত করেন। তখন দেহাবশেষ ও খুলিগুলো রিজার্ভারের পাশে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।'

১৯৯৩ সালে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মাটি ভরাটের সময় সুয়ারেজ রিজার্ভারের ওপরের পাম্পটি ভাঙার প্রয়োজন হয়। তখন ২৫ ফুট গভীরতার সুয়ারেজ রিজার্ভারটি থেকে প্রায় ৫০০ মাথার খুলি পাওয়া যায়।

তৎকালীন সময় রাইনখোলার নকশা প্রণয়নের সময়ে রাইনখোলা বধ্যভূমির জায়গাটি বরাদ্দ বহির্ভূত জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

২০০০ সালে একটি দখলদার চক্র রাইনখোলা বধ্যভূমির জায়গা দখলের চেষ্টা করলেও স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে তা ভেস্তে যায়।

দীর্ঘদিন ধরেই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (ডুইপ) প্লট মালিক কল্যাণ সমিতি। সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করেছি। আমি তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি সংরক্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আমরা কাউন্সিলরসহ সংসদ সদস্যদের কাছে বারবার আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই বাস্তবায়িত হয়নি।'

মিরপুর বাংলা কলেজের প্রশাসনিক ভবনের এক পাশে টিচার্স কমনরুমের অবস্থান। টিচার্স কমনরুম ঘেঁষেই একখণ্ড বাগান। ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট বাগানটি দেখে কে বলবে এখানেই ছিল সাক্ষাৎ দুটি মৃত্যুকূপ।

মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে টিচার্স কমনরুমের দক্ষিণ পাশের এই বাগানটিতেই ছিল দুটি কুয়ার অবস্থান। বর্তমানে কুয়া দুটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দুটি কুয়াতে হত্যা করা হয়েছিল অসংখ্য মানুষকে।

ড. সুকুমার বিশ্বাস রচিত 'একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর' শীর্ষক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মিরপুর বাংলা কলেজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চার সেল। সেসময় পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালীদের কলেজে ধরে এনে গুলি ও জবাই করে হত্যার পর টিচার্স কমনরুমের পার্শ্ববর্তী কুয়া ও কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের পার্শ্ববর্তী কুয়ায় ফেলে দিতো। মুক্তিযুদ্ধের পর সবগুলো কুয়াই শহীদের লাশে পূর্ণ ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী একইসঙ্গে মুক্তিকামী বাঙালীদের ধরে এনে অধ্যক্ষের বাসভবন পার্শ্ববর্তী আমবাগান ও গাবগাছের নিচে হত্যা করতো। পরে লাশগুলো কলেজের পেছনের লেকের পানিতে ফেলে দিতো।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বাঙলা কলেজের পেছনেও বহু নরকঙ্কাল, টুকরো হাড়, চাপ চাপ জমাট রক্ত এবং শাড়ি, ব্লাউজ, বোরখা, চুড়ি প্রভৃতি পাওয়া গেছে।'

সম্প্রতি ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক সরেজমিনে বাংলা কলেজ বধ্যভূমি ঘুরে দেখেন। বর্তমানে মিরপুরে কেবল জল্লাদখানা বধ্যভূমি বাদে বাংলা কলেজ বধ্যভূমিই চিহ্নিত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নৃশংসতার সাক্ষ্য বহনকারী আমগাছটি এখন আর নেই। মরে যাওয়া সেই আমগাছের শিকড় থেকে জন্মেছে বর্তমানের আমগাছটি। গণহত্যা জাদুঘর ও কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ২০২০ সালে সেখানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

এ বিষয়ে ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গণহত্যা জাদুঘর থেকে মিরপুর বাংলা কলেজ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ৩টি স্থানকে গণহত্যার কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করা সহজতর, কিন্তু বর্তমানে যেহেতু স্থান সংকট সুতরাং এটি জটিলতর হয়ে গেছে। এটি দুঃখজনক। সময়ের সঙ্গে এই প্রক্রিয়া আরও জটিলতর হবে।'

মিরপুরের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত এবং সংরক্ষণ না করার পেছনে মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের দায় দেখছেন গণহত্যা গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সরকার শুরু থেকেই বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা সেল বা আর্কাইভ নেই। আমলারাই ঠিক করে কোন প্রকল্পটি হবে কোনটি হবে না। অথচ তারা জানেই না কোথায় কোন বধ্যভূমি রয়েছে। সারা দেশের কথা বাদ দিলেও, ঢাকায় কয়টি বধ্যভূমি আছে এটিই তারা উত্তর দিতে পারবে না। আমি নিজেই মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ঢাকার বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণের বিষয়ে কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছি, কিন্তু এ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমলারা কেবল চিন্তা করে কোথায় বড় বাজেটে বধ্যভূমির ওপরে কমপ্লেক্স করবে কারণ সেখানে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। চাইলে এখনো সরকার মিরপুরের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা সাপেক্ষে কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করতে পারে।'

Comments