যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ

mirpur_buddhijibi_smritishoudho
রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ছবি: বাসস থেকে নেওয়া

স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে না। বহু আত্মত্যাগ, লড়াই, সংগ্রাম আর রক্তনদী পেরিয়ে আসে। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি আর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন ত্রিশ লাখ শহিদ। তাদের মধ্যে যেসব কীর্তিমান ও বরেণ্য ব্যক্তি স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে অন্তিম মুহূর্তে, পরাজয় আসন্ন জেনে, দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন, ইতিহাসে তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন বরেণ্য শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ও সমাজসেবক। দীর্ঘ এ তালিকা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পেশাদার একটি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিষ্ঠুর তাণ্ডবলীলার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে একে একে হত্যা করে দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পুরো দেশের নানা শ্রেণি পেশার মেধাবী মানুষকে হত্যা পরিকল্পনার ছক আঁকে তারা। তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী চষে বেড়ায় পুরো দেশ।

২৫ মার্চের কালরাত্রে তাদের আক্রমণের বড় একটি লক্ষ্যস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেমন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি তারা এ দেশে ভাষাভিত্তিক উদার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুক্তিসংগ্রামের সব মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন হয়।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বর্ণোজ্জ্বল পুরো ষাটের দশকের সাহসী সব তরুণেরা ঢাকার রাজপথে সেদিন মুক্তির মিছিলে ছিলেন অগ্রসেনানী। মাতৃরূপী দেশের দুখের রাতে সুখের স্রোতে তারাই মুক্তির স্বপ্নতরী ভাসিয়েছিলেন একদিন। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শিক্ষকরা ছিলেন নেপথ্যে। তাই পাকবাহিনীর সবসময় বিশেষ ক্ষোভ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি।

তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রথম ধাপে আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথ হল, ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), রোকেয়া হলে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লাশের সারি পড়ে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এ. এন. এম. মুনিরুজ্জামান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকসেনাদের হাতে নিজ বাসভবনে খুন হন। শুধু তাকে নয়, তার বড় ছেলে, এক ভাই ও ভাগ্নেও একই সঙ্গে হত্যার শিকার হন। ওই বাড়িতেই নিচতলায় থাকতেন ইংরেজির খ্যাতিমান অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। হানাদার বাহিনী ঘর থেকে তাকেও ধরে নিয়ে যায়। দুজনকেই নিচের সিঁড়িতে নিয়ে গুলি করে।

এ বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন উপমহাদেশে দর্শনের কিংবদন্তী অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। সিলেটের বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রামে জন্ম নেওয়া নিরহংকার, সহজ-সরল এই পণ্ডিত মানুষটি ছিলেন খুবই উদার ও অসাম্প্রদায়িক। দর্শনের মৌলিক গবেষণা ছাড়াও ইউরোপ রেনেসাঁর উৎসভূমি হলেও রেনেসাঁয় ও 'বিশ্বসভ্যতায় মুসলিম দার্শনিকদের দান', 'মুসলিম দার্শনিকদের স্বকীয়তা'র মতো প্রবন্ধ লেখা অজাতশত্রু এই ঋষিশিক্ষকও রেহাই পাননি সে রাতে। শত্রুর গুলিতে নিকষ কালো রাত্রির অন্ধকারে শহীদ হন গোবিন্দ দেবসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের দোসরদের ক্ষোভ ছিল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার রূপরেখার সমর্থনকারী সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের উপরও। তাই ২৫ মার্চে তারা বেশ কয়েকটি পত্রিকা অফিসেও আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রতিভাবান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের দৈনিক 'সংবাদ'র কার্যালয়েই থাকতেন। পাকবাহিনী সে ভবনে আগুন দিলে তিনি দগ্ধ হয়ে নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হন। শহীদ হন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন।

প্রতিভাবান কবি মেহেরুন্নেসাও মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে শহীদ হন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর, রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর চামেলীবাগের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় ইত্তেফাকের সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাই চলে এমন অনেক নির্মম হত্যার ঘটনা। শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও আইনজীবী। পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৪৮ সালে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিলেন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে তার উপর 'এবডো' প্রয়োগ হয়। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকে বন্দী করা হয় এবং রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় রাখতে বাধ্য করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী অ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ৮৫ বছর বয়সী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

রসায়নের অধ্যাপক ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, ৭৮ বছর বয়সী কিংবদন্তী দানবীর ও সমাজসেবক শিক্ষানুরাগী রণদা প্রসাদ সাহা, চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরীর প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সমাজসেবক নতুন চন্দ্র সিংহ, ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতি জাগরুক রাখে যে গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটির সুরকার আলতাফ মাহমুদ—তারা সবাই নানা সময় এ দেশীয় রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। তারা এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সহায়তায় এ দেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, শিল্পী সাহিত্যিক, চিকিৎসকসহ গুণী ব্যক্তিদের হত্যা করার জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তারা ঢাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা অনুসারে তুলে নিয়ে যায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কিংবদন্তি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা, ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ইংরেজির অধ্যাপক রাশীদুল হাসান। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক নিজামউদ্দীন আহমদ ও আ ন ম গোলাম মোস্তফা, খ্যাতনামা চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী ও মোহাম্মদ মোর্তজা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্যাতনের সাক্ষ্যবহন করা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছিল মিরপুর ও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। কারো কারো লাশও পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার জহির রায়হানের হদিস।

এমন লাখো শহীদদের রক্তে ভিজে আছে আমার এ দেশের সবুজ ঘাস, বেদনার্ত উর্বর ফসলি মাটি। তাদের শোকে আজো অশ্রুসজল স্বজনদের মায়াময় চোখ। এ দেশের মুক্তির জন্য যারা একদিন প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা সবাই এ জাতির সূর্যসন্তান। তাদের অসীম আত্মত্যাগ আমাদের চিরকালের প্রেরণা।

প্রতি বছরই আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় আর নতুন শপথে তাদের স্মরণ করি। সবুজ জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত বিজয়ের পতাকা ওড়ানোর মাস ডিসেম্বর এলেই তাদের রক্ত আর অশ্রুতে ভেজা মাটিতে আমরা বড় গর্ব করে গাই বিজয়ের গান, 'ওরা আসবে চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।'

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

alo.1971@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago