‘হারিয়ে যাওয়া’ বধ্যভূমির খোঁজে

martyred-intellectuals
মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

'প্রতিদিন রাইতে মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গার থেইকা ট্রাক ভইরা মানুষ ব্রিজে আনত। রাত ১২টা পার হইতেই ব্রিজের দুপাশের বাতি নিভাইয়া শুরু হইতো গুলি। একটার পর একটা লাশ পড়ত তুরাগ নদীতে। পুরো যুদ্ধের কালে এমন কোনো রাইত দেখি নাই, যে রাইতে মিলিটারি এই ব্রিজে মানুষ মারে নাই।'

গাবতলী-আমিনবাজার সেতু দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ৭৫ বছর বয়সী মাঝি মোহাম্মদ আলী। সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রামের বাসিন্দা তিনি। রাজধানীর গাবতলীর পাশের তুরাগ নদীর উত্তর পাড়েই এই গ্রামের অবস্থান। গ্রামটি থেকে স্পষ্টই চোখে পড়ে গাবতলী-আমিনবাজার সেতু।

বছর তিনেক আগেও নদীর দুই পাড় যুক্ত করে রেখেছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। বর্তমানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিটের একটি আট লেনের নতুন সেতু, যেটি দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ স্থাপন করেছে। পুরোনো যে সেতুটি ছিল, সেটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে।

১৯৭১ সালে সেতুটিকে মৃত্যুকূপে পরিণত করার বিষয়ে মোহাম্মদ আলীর ভাষ্যের সত্যতা মিলে গণহত্যা গবেষক ডা. এমএ হাসানের সঙ্গে কথা বলেও।

তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধকালে বিহারিদের সহযোগিতায় সেতুটিতে আনুমানিক ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী।'

দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এই সেতুটিতে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এ তো কেবল মিরপুরের গাবতলীর একটি সেতুর গণহত্যার চিত্র।

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুরই পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকায় সন্ধান মিলেছিল ৭৬টি বধ্যভূমির, যার মধ্যে ২৭টির অবস্থানই মিরপুরে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও মিরপুরের কোনো বধ্যভূমিই সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান গণহত্যা গবেষক এমএ হাসান, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও অধ্যাপক শাহরিয়ার কবির।

বর্তমানে মিরপুরের ২৭টি বধ্যভূমির মধ্যে ১৭টি বধ্যভূমির অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাকি ১০টি বধ্যভূমির মধ্যে বর্তমানে কেবল জল্লাদখানা বধ্যভূমিই পুরোপুরি সংরক্ষিত রয়েছে, যা সংরক্ষণ করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এ ছাড়া মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ আংশিকভাবে সংরক্ষণ করছে।

সম্প্রতি ডেইলি স্টার মিরপুরের আটটি বধ্যভূমি ঘুরে দেখেছে। এ সময় দেখা যায়, কোনো বধ্যভূমিতে উঠেছে বহুতল ভবন, কোথাও হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আবার কোথাও মোটর ওয়ার্কশপ। এরমধ্যে একটি বধ্যভূমি পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। একটি বিলীন হয়ে গেছে গেছে তুরাগ নদে।

জানে না কেউ

সারাদেশে কত বধ্যভূমি রয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে নিশ্চিত নয় কেউই। তবে চলতি বছর পর্যন্ত ৪০ জেলায় ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট পরিচালিত জরিপ অনুসারে, এসব জেলায় বধ্যভূমির সংখ্যা ৮৫৫, গণকবর এক হাজার ২৬৪টি ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ১১৮টি। ট্রাস্ট এই স্থানগুলোর জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ম্যাপ তৈরি করছে।

এ ছাড়া, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গবেষণার মাধ্যমে দেশব্যাপী পাঁচ হাজার বধ্যভূমি খুঁজে পেয়েছে। একইসঙ্গে কমিটি এক হাজার ৪০টি বধ্যভূমি জিপিএস ম্যাপ সার্ভে সম্পাদন করেছে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও দেশের বধ্যভূমিগুলোকে সরকার তালিকাভুক্ত করতে পারেনি। এটি চূড়ান্ত ব্যর্থতা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখানে একটি বড় বাধা। আমলারা চান না এ ধরনের প্রকল্পে গবেষকরা থাকুক।'

রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে নয় মাসেই প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন বলে কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন। তবে এই ৩০ লাখের মধ্যে যুদ্ধকালীন ভারতের শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টি, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন থেকে পাঁচ লাখের মতো মানুষের মৃত্যু উঠে আসেনি বলে উল্লেখ করেছেন তারা।

এই বিরাট আকারের গণহত্যার পরিকল্পনা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই করা হয়েছিল।

প্রখ্যাত লেখক রবার্ট পেইন তার 'ম্যাসাকার: দ্য ট্র্যাজেডি অ্যাট বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য ফেনোমেনন অব মাস স্লটার থ্রোআউট হিস্টোরি' বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক সামরিক সম্মেলনে বলেন, 'তাদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাতের থাবাতেই শেষ হয়ে যাবে।'

যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বধ্যভূমি

যদিও গণহত্যা সারা বাংলাদেশেই সংঘটিত হয়েছিল, তবে সুনির্দিষ্ট কিছু বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে এ ধরনের অনেক বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রে গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অনেক যুদ্ধাপরাধীকে বধ্যভূমি এবং নির্যাতন কেন্দ্রে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে।

গণহত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে এ পর্যন্ত ১৪৩ জন যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ডসহ নানা মেয়াদে সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে ১০২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত বিচার সমাপ্ত হওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৬৩ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগের রায় বিশ্লেষণ করেছে ডেইলি স্টার। এই ৬৩ জনকে বাছাই করা হয়েছে দুটি বিষয় বিবেচনায়। প্রথমটি হচ্ছে যাদেরকে দেশের যেকোনো স্থানে যেকোনো যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যাদেরকে নির্দিষ্ট বধ্যভূমি বা নির্যাতনকেন্দ্রে গণহত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৪১ জন ১৬ জেলার অন্তত ৩৭টি বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রে গণহত্যা করেছে। এগুলোর কোনোটিই সরকারিভাবে বধ্যভূমি বা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত নয়।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলো তালিকাভুক্ত করতে সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সারাদেশে এটি করতে দুই মাসের বেশি লাগবে না। এটি চরম লজ্জাজনক যে, ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে সেই বধ্যভূমিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তালিকাভুক্তকরণের কোনো চেষ্টাই করেনি।'

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কাছে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকলে ভালো হতো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত বধ্যভূমি নিয়ে আপনারা সংবাদ প্রকাশ করলে আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব।'

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

2h ago