‘বঙ্গবন্ধুর মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে’

ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে বলে জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভার বক্তারা।

আজ সোমবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে 'বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা' শীর্ষক এ আলোচনা সভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। 

এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তফা ওসমান তুরানের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও বিশেষ কারণে উপস্থিত হতে না পারলেও সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন।

নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়ের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। সূচনা বক্তব্য দেন 'তুরস্কে বঙ্গবন্ধু' শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা তুরস্কের টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি।

আলোচনা সভার শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নির্মিত 'তুরস্কে বঙ্গবন্ধু' প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেতা আরমা দত্ত এমপি এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাট্যনির্দেশক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ও তার শহীদ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, 'বঙ্গবন্ধু শোষিতের পক্ষ নিয়ে রাজনীতি করতেন। জনগণ যেন স্বাধীনভাবে নিজেদের নেতা নির্বাচিত করতে পারে সেজন্য তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন '

বঙ্গবন্ধু ধর্মহীনতার কথা কখনো বলেননি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ইসলাম হতে পারে না। রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? ধর্ম যার যার উৎসব সবার। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। দেশের সব নাগরিক স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করবেন- এমন মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, 'বঙ্গবন্ধু সময়োপযোগী উদার রাজনৈতি দর্শনের ধারক ও বাহক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উদারনৈতিক রাজনৈতিক দর্শন শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বের জন্য সমান প্রয়োজনীয়।'

শাকিল রেজা ইফতিকে তার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, 'শাকিল রেজা ইফতি শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে যে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসা দাবি রাখে। আমি বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের শাকিলের মতো এমন বস্তুনিষ্ট প্রামাণ্যচিত্র আরও বেশি করে তৈরি করার আহ্বান জানাচ্ছি।'

লিখিত মূল বক্তব্যে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত জনাব মুস্তফা ওসমান তুরান বলেছেন, 'বিংশ শতাব্দীর মহান নেতা হিসেবে তুর্কির জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু নিজেও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও আধুনিক চিন্তাধারার বাহক কামাল আতার্তুকের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আঙ্কারাতে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। গত বছর তার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আঙ্কারাতে একটি পার্কের নামকরণ ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। কামাল আতাতুর্কের স্মরণে খুব শিগগিরই বাংলাদেশের কামাল আতার্তুক অ্যাভিনিউতেও তার ভাস্কর্য স্থাপন ও একটি পার্কের নামকরণ করা হবে। কামাল আতার্তুক ও বঙ্গবন্ধু  দুজনই দুটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুজনই আধুনিক দেশ গঠনের জন্য মৌলিক নীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। আমাদের দুদেশের জাতির জনকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভবিষ্যতে দুদেশের বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে যাব।'

শাকিল রেজা ইফতিকে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'নিরলস পরিশ্রম এবং একাগ্রতার মাধ্যমে যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছে সেজন্য ইফতিকে ধন্যবাদ জানাই। এই ধরনের কাজগুলো তরুণদের আরো বেশি বেশি করা প্রয়োজন। সরকারের উচিৎ এসব কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করা।'

সভাপতি ভাষণে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, 'বাংলাদেশের ইতিহাসের কালপঞ্জিতে আগস্ট শোকের মাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শোষিত, নির্যাতিত, শৃঙ্খলিত বাঙালি জাতির ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং '৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার দর্শন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছিল তার জীবদ্দশায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্যাতিত জাতিসমূহের মুখপাত্র। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য- ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আলোকাভিসারী এক জাতিকে পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে।

'এ বছর ১ আগস্ট শোকের মাসের প্রথম দিন জাতির পিতার ৪৭তম শাহাদৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। অনুষ্ঠানে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র তুরস্ক শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রতিভাবান তরুণ লেখক ও চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতির বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তুরস্কে নির্মিত 'তুর্কিয়ে বঙ্গবন্ধু'য়ু আনিওর' (তুরস্কে বঙ্গবন্ধু) শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এই প্রামাণ্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন সম্পর্কে তুরস্কের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা কী ভাবছেন, কেন বঙ্গবন্ধুর দর্শন এখনো সংঘাত ও সন্ত্রাস কবলিত বিশ্বে প্রাসঙ্গিক- এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ইফতির এই প্রামাণ্যচিত্র ভ্রাতৃপ্রতীম তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আরও নিবিড় করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আশা করব বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন ও ব্যবস্থাপত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমাদের সরকার এবং প্রবাসী বাঙালিরা বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।'

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সভাপতি নাট্যজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর জীবনই তার আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যেদিন থাকবে না, সেদিন বাংলাদেশও থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজীবন বহমান থাকবে। আমরা তার লেখা পড়ে জানতে পারি সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু, আপসহীন বঙ্গবন্ধু এবং মানবিক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। তিনি গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন গণতন্ত্র শাসককে শোষকে পরিণত করে। কিন্তু তিনি বলতেন আমার গণতন্ত্র হবে শোধিতের গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। সবশেষে তিনি ইফতিকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই ধরনের নির্মাণ আমাদের গর্বিত করে।'

বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আরমা দত্ত বলেন, 'ইফতির নির্মাণ করা প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি সন্তোষ জ্ঞাপন করছি। বঙ্গবন্ধু এবং কামাল আতাতুর্কের মধ্যে ধর্ম-নিরপেক্ষতা নীতির গভীর মিল রয়েছে। আমার দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন শেখ মুজিব হচ্ছে গণদেবতা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল একটি মানবিক দর্শন। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল, আছে এবং থাকবে।'

শাকিল রেজা ইফতির প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাট্যনির্দেশক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, 'বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রচলিত সংস্কৃতি আমাদেরকে আতঙ্কিত করে। সমাজটি বিভাজিত হয়েছে। সমাজ আর আমাদের হাতে নেই। একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজকে বিভাজিত করছে। বঙ্গবন্ধু এ সবের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার দর্শনের প্রধান উপাদান ধর্ম-নিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রবাদী মানুষ ছিলেন। তিনি একইসঙ্গে গণতন্ত্রকামী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। তিনি ভাষা এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ।'

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের যেসব সদস্য ১৯৭৫-এর কালরাত্রিতে নির্মমভাবে শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সূচনা বক্তব্যে তুরস্কের টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ও প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার আদর্শ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আজ বহির্বিশ্বে প্রশংসিত, চর্চিত। 'তুর্কিয়ে বঙ্গবন্ধু'য়ু আনিওর প্রামাণ্যচিত্রে তুরস্কের বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের বঙ্গবন্ধুর এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিমত মেনে একজন বাঙালি হিসেবে আমি অভিভুত হয়েছি। প্রামাণ্যচিত্রটির বিশেষ দিক হচ্ছে এই যে, এখানে তুর্কি নাগরিকবৃন্দ তুর্কি ভাষায় আমাদের কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তুর্কি ভাষায় নির্মিত এটিই প্রথম প্রামাণ্যচিত্র। বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল ইস্তাম্বুল এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এটি নির্মাণ করতে পেরেছি। আমি মনে করি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের মিশনগুলোর উচিত প্রবাসী বাঙালি এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করা।

 

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

10h ago