‘যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না’

শহীদ শাফী ইমাম রুমী (বীর বিক্রম)। ছবি: জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর, সাইফ ইমাম জামী’র সৌজন্যে

১৯৫১ সালে এক চিকিৎসক তার তত্ত্বাবধানে সদ্য ভূমিষ্ঠ এক নবজাতক সম্পর্কে তার মাকে বলেছিলেন, ‘এখন ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পরে ৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে।’

সেদিনের সেই শিশু ৭১ সালে তারুণ্যে টগবগ করছে। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল থেকে মাধ্যমিকে ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে মেধা তালিকায় অবস্থান নিয়ে পাশ করার পর সে পড়ার সুযোগ পায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)।

এরপর নিজের প্রখর মেধা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য পড়ার সুযোগ পান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। সেই সময়ে তৃতীয় বিশ্বের এক ছেলে নিজের যোগ্যতায় বিশ্বখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার বিষয়টিই ছিল অভাবনীয়।

১৯৭১ সালের আগস্টে তার আমেরিকা যাওয়ার কথা এবং ক্লাস শুরুর সময় ছিল সেপ্টেম্বর। অবসর সময়টুকু কাজে লাগাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অর্থনীতি বিভাগে ক্লাস করতে লাগলো ছেলেটি।

মার্চের প্রথম থেকেই দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করলে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই উত্তাল সময়গুলোর প্রত্যক্ষদর্শী স্বাধীনতাপ্রেমী ছেলেটি। রেসকোর্সে ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শীও সে।

পরবর্তীতে যুদ্ধ শুরু হলে মা জাহানারা ইমামের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলো ছেলেটি। কিন্তু, মা তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কিছুতেই যুদ্ধে পাঠাতে রাজি হলেন না। এমন মেধাবী ছেলেকে কোন মা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন? আর কদিন পর ছেলেটি পড়তে যাবে যুক্তরাষ্ট্রে। এর মধ্যে যদি কিছু হয়ে যায়!

ছেলেটির তীব্র জেদ— দেশের এই অবস্থায় কিছুতেই যাবে না সে। এভাবে উটপাখির মতো মাখা গুটিয়ে  বাঁচবে না সে। মায়ের অনড় ভাব দেখে ছেলেটিই বলেই ফেললো, ‘আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তা হলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?’

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উজ্জ্বল তারকা রুমী কখনোই বিতর্কে হারেনি প্রতিপক্ষের কাছে, আজই বা হারবে কেন?

তাইতো মা জাহানারা ইমাম দু চোখ বুজে বললেন, ‘না তা চাইনে, ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবান করে, যা তুই যুদ্ধে যা।’

এরপর বাবা-মাকে বিদায় দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ৭১ এর ২ মে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশের প্রয়াস চালায় ছেলেটি, যদিও নানা প্রতিবন্ধকতায় সেবার তারা সফল হননি। এরপর ভারতে প্রবেশের জন্য আমার চেষ্টা করেন রুমী। সেই দফায় সফল হন তারা। প্রায় দেড় মাস পর প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অন্যান্য গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করেন রুমী।

মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে ও মেজর হায়দারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে ঢাকা শহরের একদল মুক্তিপাগল তরুণকে নিয়ে গঠিত হয় ক্র্যাক প্লাটুন। রুমী যোগ দেন দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনে। ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা হাতের তালুর মতোই চিনতেন ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি। এই তারা কয়েকদিনের মধ্যে হারাম করে দেয় পাকিস্তানি হানাদারদের ঘুম।

রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার মূল কারণগুলোর একটি ছিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা করা। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলার পর তারা চালান আরও কয়েকটি অভিযান। এর মধ্যে একটি ছিল ধানমন্ডির ১৮ ও ৫ নম্বর সড়কে হামলা। সেখানে একটি পাকিস্তানি সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙে ‘দেখো দেখো, একটি জিপ আমাদের অনুসরণ করছে’ বলে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করেন। তার গুলিতে জিপের চালকসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গাড়িটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খায়।

তার দ্রুত সিদ্ধান্ত ও আক্রমণের কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন সহযোদ্ধারা।

গেরিলা আক্রমণের মূল বিষয় হলো ‘হিট অ্যান্ড রান’। ধানমল্ডিতে অপারেশনের পর সহযোদ্ধাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন রুমী।

একের পর এক অতর্কিত এই অপারশনগুলোই রীতিমতো ঘুম কেড়ে নেয় পাকিস্তানিদের। আরবান গেরিলাদের ধরতে উন্মাদের মতো গোপনে সাঁড়াশি অভিযানে নামে পাকিস্তানি হানাদাররা। একটি অপারেশনের পর ২৯ আগস্ট নিজ বাড়িতেই ছিলেন রুমী। ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত ১২টার দিকে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে তাদের কণিকা বাড়ি থেকে রুমী, তার বাবা শরীফ ইমাম ও ছোটভাই সাইফ ইমাম, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান আর্মি। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে রুমী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায় হানাদাররা।

জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি বলেন, ‘পাকবাহিনী আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব আমি নিজেই নিচ্ছি।’

দুই দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর তাকে ছাড়া পরিবারের বাকি সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ফিরে আসার সময় তার বাবা পাকিস্তানি কর্নেলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কবে ছাড়া পাবে রুমী? জবাবে কর্নেল বলেছিলেন, ‘সে যাবে একদিন পর, তার জবানবন্দী নেয়া এখনো শেষ হয়নি।’

আটক হওয়ার একদিন পরই রুমীর সঙ্গে নিখোঁজ হন তার সহযোদ্ধা বদি ও চুল্লু। ধারণা করা হয়, তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছিল।

ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তার জন্য তার বাবাকে আবেদন করতে বলেছিলেন। কিন্তু, রুমী যে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের  কাছেই ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা দেশপ্রেমিক শরীফ ইমাম রাজি ছিলেন না। আবার ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হবে এটা জানতো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। কিন্তু, সেই সিদ্ধান্ত তাদের মনঃপুত হয়নি বলে অনেকে এর বিরোধিতাও  করেছিলেন। তাই ৪ সেপ্টেম্বর রাতে তাড়াহুড়ো করে আটককৃত বহু মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। ধারণা করা হয়, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন ছিলেন শাফী ইমাম রুমী।

জীবনের শেষ দিকে এসে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখতে বসেছিলেন তার আত্মজীবনী। সেই গ্রন্থের এক পাতায় রুমীকে নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করা সেই ডাক্তারের প্রশ্নের প্রতি-উত্তরে হিসেবে জাহানারা ইমাম  লিখেছিলেন, ‘রুমী ১৯৭১ সালে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি, তবে কিছু একটা হয়েছিল। সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছিল।’

ধরা পড়ার একদিন আগে ২৮ আগস্টের ঘটনা এটি। মা জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, ‘রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’

রুমী মুখ তুলে কী একরকম যেন হাসল। মনে হলো অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো জানি না, ভোগও করিনি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য, তিক্ততা-বিষ—সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না।’

আজ বাংলার রাজপুত্র শহীদ শাফী ইমাম রুমী’র (বীর বিক্রম) জন্মদিন। ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা এই কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধার প্রতি।

তথ্যসূত্র: একাত্তরের দিনগুলি- জাহানারা ইমাম, অন্য জীবন- জাহানারা ইমাম, নিঃশঙ্ক যোদ্ধা শহীদ শাফী ইমাম- জয়া শহীদ

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago