আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা
(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে একুশ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করেছে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১টি জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। একুশের একাত্তরের সর্বশেষ পর্বে রইল ঢাকার ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)
ভাষা আন্দোলনে ঢাকা ছিল সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা আন্দোলনের সুতিকাগার ছিল ঢাকা। ঢাকা থেকে পরিচালিত ভাষা আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সমস্ত জনপদে।
১৯৪৭ সালের মে এবং জুলাই মাসে পৃথক দুটি প্রস্তাবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও খলীকুজ্জমান। সে বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের মানুষের ইসলামিক চেতনা শক্তিমান করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস। তমদ্দুন মজলিস সহসাই বাংলা ভাষা আন্দোলনে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস 'পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু?' শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে। প্রকাশিত বইয়ে লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান। একই সঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম তুলে ধরেন কিছু সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাও।
প্রস্তাবনায় বলা হয়: পূর্ব-পাকিস্তানে তথ্য আদান-প্রদান, আদালত এবং দাপ্তরিক কাজের ভাষা হবে বাংলা। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার প্রধান মাধ্যমও হবে বাংলা। উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা। উর্দু কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের যে সমস্ত মানুষ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করতে যাবে তারাই উর্দু শিখবে। কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয়ই কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার হবে।' তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রমের মাধ্যমে শাসক মহলের কাছেও এটি প্রতীয়মান হয় যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড নয়।
কিন্তু বাংলার বুদ্ধিজীবীদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হঠকারী এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী, এ কে এম আহসান, কল্যাণ দাসগুপ্ত প্রমুখ। সভা শেষে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেটিই ছিল সর্বপ্রথম প্রতিবাদ মিছিল।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গণপরিষদের মুসলিম লীগের সদস্যরা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতায় বলেন, 'পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক।' মুহূর্তেই গর্জে উঠে ঢাকার ছাত্রসমাজ।
গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়েছিল ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে ছাত্রদের উদ্যোগে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে শামসুল হককে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। পরিষদ থেকে সংগঠনগুলো থেকে দুজন করে প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। বৈঠকে ১১ মার্চে ধর্মঘট পালনের আহ্বান করা হয়। একই সঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরদিনের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
১১ মার্চ ভোরে ছাত্ররা বিভিন্ন হল থেকে বের হয়ে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পূর্ব নির্ধারিত তিনটি স্থানে উপস্থিত হয়। ছাত্রদের উদ্দেশ্য ছিল অফিসগামী কর্মচারিরা যেন নীলক্ষেত, পলাশী ব্যারাক থেকে না বের হতে পারে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ও তমদ্দুন মজলিস।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এদিন আন্দোলনকর্মীদের নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল কাসেম, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শহীদুল্লা কায়সার, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ।
এসময় সি এস পি আবদুল গফুরের নির্দেশে তৎপর হয়ে উঠে পুলিশ। শুরু হয় আন্দোলনকর্মীদের উপর পুলিশের বেদম লাঠিচার্জ। এদিন ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশি লাঠিচার্জে আহন হন শেখ মুজিবুর রহমান, এম এ ওয়াদুদ, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ। তোপখানা রোডে লাঠিচার্জে আহত হন শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকে। জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনেও বেশ কয়েকজন আন্দোলনকর্মী আহত হয়েছিলেন। হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদের পিকেটিং করার সময় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক উপস্থিত হলে তিনিও পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন।
একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পরদিন সেনাদের পদাতিক সেনারা গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানা দিয়ে গোপনে বের করে। বিকেলে ছাত্ররা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয়। এদিন মোট ৬৯ জন নেতাকর্মীকে আটক করেছিল পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ।
১১ মার্চের ধর্মঘট ও হরতালের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা প্রথমবারের মতো বেজে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৯, ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে এই দিনটি রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১১ মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট পালন করেছিল। তীব্র আন্দোলনের মুখে খাজা নাজিমুদ্দীন আসন্ন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরের কারণে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১ এবং ২৪ মার্চ রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে দেয়া বক্তব্যে জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন- 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়'। এসময় উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে 'না, না' বলে চেঁচিয়ে উঠে। ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু জিন্নাহ্ খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন।
২৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করার আগমুহূর্তে রেডিওতে জিন্নাহ তার পূর্ববর্তী অবস্থানই ব্যক্ত করেন। জিন্নাহ্র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ ও তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহার কাছে হস্তান্তর করেন।
১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ তাকে 'বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবী' সংবলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসভায় লিয়াকত আলী খানকে বাংলা ভাষার দাবি সম্বলিত এক মানপত্র দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু দুবারই এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন লিয়াকত আলী খান।
এর কিছুদিন পরে পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মওলানা আকরাম খাঁ' নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে একটি প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। যদিও তা ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি। এসময় ভাষার বিষয়টি সমাধানের জন্য আরবি হরফে বাংলার লেখার সুপারিশও হয়েছিল। তখন ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। পূর্ব বাংলার ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও এই নীতির নিন্দায় ছাত্রদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ সিএপিতে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পুনঃপ্রবর্তন করে বাংলার জন্য আরবি লিপির প্রতিস্থাপনের জন্য চাপ দেয়। তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ বেশ কয়েকজন বিধায়ক বাংলাকে পরিবর্তন করার পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, 'বাংলা লেখার জন্য বিদেশি লিপি প্রবর্তন করে পূর্ব বাংলার মানুষকে নিকৃষ্ট শ্রেণীর নিরক্ষর নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে।'
১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'। এরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকার ছাত্রসমাজ। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ২৯ এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ৩০ জানুয়ারির এক সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলাতে আসন্ন ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মঘট এবং মিছিলের আহ্বান জানানো হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক সরকার পরদিন থেকে পরবর্তী ১ মাস ঢাকা শহরে সমস্ত সভা সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা। সভায় ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে এদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের পৃথক সভায় ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন।
২১ ফেব্রুয়ারি পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। এসময় তারা ১৪৪ ধারার বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনরাও উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ সভাস্থলের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল।
বেলা ১১টার কিছুক্ষণ পর ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে গেলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় কিছু ছাত্র ঢাকা মেডিকেলের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকি ছাত্ররা পুলিশের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে ছিল। এসময় তারা পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। তখন বেশ কয়েকজন ছাত্রকে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এসময় বাকি ছাত্ররা পুনরায় বিক্ষোভ শুরু করে।
দুপুর ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা বাধা দেয়। তখন ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয় আইনসভায় গিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করার। ছাত্ররা আইনসভার দিকে রওয়ানা দিতেই দুপুর ৩টার দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার প্রমুখ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হন সচিবালয়ের পিয়ন আবদুস সালাম। পরবর্তীতে ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন।
ছাত্র হত্যার খবর মুহূর্তেই বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ঢাকা শহরে। সঙ্গে সঙ্গে শহরের সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রেডিও শিল্পীরা এদিন ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনে যোগ দেয় সর্বস্তরের মানুষ।
ছাত্রদের মিছিলে পুলিশি গুলিবর্ষণের খবর আইনসভায় পৌঁছামাত্র আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। এসময় তিনি আহত ছাত্রদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মনোরঞ্জন ধরসহ বেশ কয়েকজন সদস্যের অনুরোধের পরও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন স্থগিতের বিষয়ে অপারগতা জানান।
২২ ফেব্রুয়ারি চরম উত্তাল হয়ে পড়ে ঢাকা। এদিন সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল সহযোগে বের হয় শহীদ স্মরণে মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হয় গায়েবী জানাজা। জানাজা শেষে প্রায় ৩০ হাজার জনতার এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।
বেলা ১১টার দিকে মিছিলটি কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে পুলিশ বাধা দেয় এবং একপর্যায়ে মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসময় শহীদ হন বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতা। এদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক মিছিল বের হয়েছিল।
এদিন বিকেলে নবাবপুর রোডের মিছিলে পুলিশের অতর্কিত গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ৮ বছর বয়সী অহিদুল্লাহ, সিরাজুদ্দিন, রিকশাচালক আবদুল আউয়াল, সিরাজুদ্দিন প্রমুখ।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে ছাত্রহত্যার প্রেক্ষিতে প্রথম গান রচনা করেছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী। এটি মূলত কবিতা হলেও পরবর্তীতে গানে রূপান্তরিত হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাইওনিয়ার প্রেস থেকে মিছিলে গুলির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছাপা হয়েছিল একুশের প্রথম লিফলেট। লিফলেটের শিরোনাম ছিল 'বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব'।
প্রায় ২/৩ হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ওইদিনই ছড়িয়ে দেয়া হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রদের হাতে এক রাতের মধ্যে গড়া হয়েছিল ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শুরু হওয়া শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিলো ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। এদিন সকালে নবনির্মিত শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ শফিউরের বাবা। ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের আবাসিক হোস্টেল অবরুদ্ধ করে শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সঙ্গে প্রশাসনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: 'উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।'
সূত্র-
ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক
ভাষা আন্দোলন কোষ প্রথম খণ্ড/ এম আবদুল আলীম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র প্রথম খণ্ড
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রথম ও তৃতীয় খণ্ড / বদরুদ্দীন উমর
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments